৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৯:০৩

সঠিক মূল্যায়ন হলে পাসের হার আরো কমত!

পরীক্ষকদের অভিমত

পরীক্ষার হলে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চতকরণ, সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়নসহ পরীক্ষার প্রতিটি স্তরে যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা থাকলে পাসের হার আরো অনেক কম হতো বলে জানিয়েছেন কলেজের অনেক পরীক্ষক ও শিক্ষক। আরো ধস নামত জিপিএ ৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে। অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকৃত মেধা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হলে কোনো কোনো বোর্ডে পাসের হার ৫০ এর অনেক নিচে নেমে আসত। আবার সঠিক মূল্যায়ন হলে প্রকৃত পাসের হার এত কমে নেমে আসার কথা জানিয়েছেন কোনো কোনো পরীক্ষক ও শিক্ষক যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এবারের এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর খাতা দেখার সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। পরীক্ষকদের কথায় আবারো ফুটে উঠল শিক্ষার মান ধসের বিষয়টি।
এবার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আগের অভিযোগ না থাকলেও পরীক্ষার হলের পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেক শিক্ষক এমনকি পরীক্ষার্থীরাও জানিয়েছেন, পরীক্ষার হলে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে পাসের হার ব্যাপকভাবে কমে যেত। অনেক পরীক্ষা কেন্দ্র এবং কলেজের পাসের হার বৃদ্ধির পেছনে পরীক্ষার হলে ব্যাপকভাবে অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে কলেজের পরীক্ষায় ফেল করা অনেক শিক্ষার্থী বোর্ডের পরীক্ষায় শুধু পাস নয়, অনেক ভালো ফল করেছেন। এর কারণ পরীক্ষার হলে সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না বিভিন্ন কেন্দ্রে। বিশেষ করে গ্রামের অনেক কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের অন্যের খাতা দেখে লেখা, নকলসহ বিভিন্নভাবে অসদুপায় অবলম্বনের অবাধ সুযোগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি শিক্ষকের পরীক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেয়াসহ যাবতীয় সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে অনেক কেন্দ্রে। এ ছাড়া কোনো কোনো কেন্দ্রে পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁসেরও অভিযোগ রয়েছে। এসব ঠেকানো গেলে পাসের হার অনেক কমত বলে জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক।
অনেকে জানিয়েছেন, গ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি কলেজ যার সাথে ক্ষমতাবান রাজনীতিকসহ নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা জড়িত সেসব কলেজের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়ে প্রভাবশালীদের কারণে।
এক শিক্ষক বলেন, ২০০১ সালে একটি বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ১৮ ভাগ। এবার তা হয়েছে ৭০ ভাগ। সবাই জানেন আগের চেয়ে শিক্ষার মান কমেছে। সুতরাং কী এমন হলো যে পাসের হার এভাবে বেড়ে যেতে পারে? আসলে কোথাও বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতিতে। এর প্রতিকার না হলে শিক্ষার মান আরো খারাপ হতে বাধ্য।
ময়মনসিংহ জেলার সরকারি কলেজের এক তরুণ শিক্ষক জানান, আমরা যখন পরীক্ষার হলে যাই তখন অনেক পরীক্ষার্থীর চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে। অনেকের চেহারায় কান্নার ভাব ফুটে ওঠে। কারণ তারা জানে আমরা থাকলে পরীক্ষার হলে কোনো অসদুপায় অবলম্বন চলবে না। কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না।
এ শিক্ষক আরো জানান, খাতা দেখার বিষয়ে আগের মতো হাত খুলে নম্বর দেয়ার নির্দেশনা এবার ছিল না এটা সত্য। কিন্তু পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বনের ব্যাপক সুযোগ রয়ে গেছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। বিশেষ করে বেসরকারি বিভিন্ন কলেজে এটি হচ্ছে।
যশোর অঞ্চলের নামকরা একটি বেসরকারি কলেজের এক পরীক্ষক জানান, বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে এ অভিযোগ সত্য নয়। কোথাও কোথাও হতে পারে।
এক পরীক্ষক জানান, আগের বিভিন্ন বছর খাতা দেখার ক্ষেত্রে তাদের নির্দেশ দিয়ে বলা হতো, শিক্ষার্থীরা আপনাদের শত্রু নয়। আপনারা তাদের প্রতিপক্ষ নন। তাদের পাস করাতে হবে। খাতায় যাই লিখুক নম্বর দিতে হবে। ফেল করানো যাবে না। তারা যদি আপনার সন্তান, ভাই বা বোন হতো এবং ফেল করত তাহলে আপনার কেমন লাগত। এভাবে নির্দেশনা আসত। এ ছাড়া নম্বর কম দিলে সরাসরি ডেকে নিয়ে ধমকানো হতো। কিন্তু এবার সে ধরনের কোনো নির্দেশনা ছিল না। তাই তারা অনেকটা স্বাধীনভাবে খাতা দেখতে পেরেছেন। খাতা মূল্যায়ন মোটামুটি সঠিক হলেও আরো বিভিন্ন সমস্যা রয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
ঝালকাঠি জেলার একটি বেসরকারি কলেজের এক ইংরেজি পরীক্ষক জানান, শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স খুবই হতাশাজনক। স্বাধীনভাবে খাতা মূল্যায়ন করতে পেরেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাধীনভাবেই খাতা মূল্যায়ন করেছি। এবার কোনো বাজে নির্দেশনা ছিল না আগের মত। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রামের বিভিন্ন পরীক্ষার হলের অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানান তিনি। খাতা মূল্যায়নের মতো পরীক্ষার হলেও সুষ্ঠু পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পাসের হারে আরো ধস নামত বলে জানান তিনি।
যশোর অঞ্চলের ভূগোলের এক পরীক্ষক জানান, পরীক্ষা দিলেই পাস, খাতায় যাই লেখা হোক নম্বর পাওয়া যাবে গত কয়েক বছর এ ধারণা ছড়িয়ে পড়ায় পরীক্ষার্থীরাও খাতায় যা মনে চায় লিখেছে। এক পরীক্ষার্থী তার পুরো খাতা ভরে নানা ধরনের গান লিখে ভরে রেখেছে। সেখানে ভূগোলের কোনো বিষয় ছিল না। এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। এটা এবার বন্ধ হয়েছে যা খুবই ভালো। তবে অন্যান্য সব খারাপ পথও বন্ধ করতে হবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239931