৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৯:০২

অধ্যাদেশ দিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনীর চাপ

পরিচালকদের সংখ্যা ও মেয়াদ বৃদ্ধি

তর সইছে না বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের। তারা জাতীয় সংসদকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনটি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ আকারে বাস্তবায়ন দেখতে চান। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে তারা চাপও সৃষ্টি করে চলেছেন বলে জানা গেছে। গত মে মাসে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত এই সংশোধনীতে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংক পরিচালকদের সংখ্যা ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রস্তাবটি এখন ভেটিংয়ের (মতামত) জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। পরে তা অনুমোদনের জন্য সংসদে উত্থাপন করার কথা রয়েছে।
বর্তমানে এক ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালক হতে পারেন না। মন্ত্রিসভায় সংশোধনের মাধ্যমে তা চারজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে পরিচালকরা তিন বছর করে দুই মেয়াদে টানা ছয় বছর পরিচালক থাকতে পারেন। সংশোধনের মাধ্যমে তা করা হয়েছে তিন বছর করে তিন মেয়াদে টানা ৯ বছর। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) দাবি ও তোড়জোড়ের মুখেই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত ৮ মে সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০১৭-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন (সংশোধন) ২০১৭ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য একটি চাপতো আমাদের ওপর রয়েছেই। গত মে মাসে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর সংশোধনীটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে মতামত পাওয়ার পর তা উত্থাপনের জন্য সংসদ সচিবালয়ে পাঠানো হবে। এটি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ব্যাংক পরিচালকদের অনেকের মেয়াদ খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। পরিচালনা পর্ষদে তাদের মেয়াদ টিকিয়ে রাখার জন্য এদের অনেকে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনীটি অর্ডিন্যান্স আকারে জারি করার জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করেছে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্ডিন্যান্স আকারে এটি বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটি কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে তা বাস্তবায়ন করা হবে। তবে ওপর থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হয় সে ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারাটি এখন পর্যন্ত ছয়বার সংশোধন করা হয়। এ ধারায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একজন পরিচালক কত বছর পরিচালক থাকতে পারবেন তা নির্ধারণ করা রয়েছে। ধারাটি সর্বশেষ সংশোধন হয় ২০১৩ সালে। এবার ষষ্ঠবারের মতো সংশোধন করা হলো।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকেরা তিন বছর করে দুই মেয়াদে টানা ছয় বছর পরিচালক থাকতে পারেন। দুই মেয়াদ শেষে তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারো তিন বছরের জন্য পরিচালক হতে পারেন। আইন সংশোধনের ফলে তারা তিন বছর করে তিন মেয়াদে টানা ৯ বছর পরিচালক থাকতে পারবেন। ৯ বছর মেয়াদ শেষে তিন বছর বিরতি দিয়ে পুনর্নিয়োগের সুযোগ পাবেন। তিন বছর বিরতি দিয়ে আমৃত্যু পরিচালক থাকতে আইনে কোনো বাধা নেই। সংসদে এ আইনটি পাস হলে একটি ব্যাংকে এক পরিবারের চারজন একই সাথে পরিচালক থাকার সুযোগ পাবেন।
মন্ত্রিসভায় সংশোধনীটি অনুমোদেনর পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিসভা বিভাগের সচিব শফিউল আলম বলেছিলেন, ব্যাংক পরিচালকদের সুযোগ বাড়িয়ে আইন সংশোধন করতে ব্যাংকারদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল। কোনো ব্যাংকে একই সময়ে একই পরিবারের দুইজনের বেশি সদস্য পরিচালক পদে থাকতে পারতেন না। ওই ধারা সংশোধন করে একই পরিবার থেকে চারজন পরিচালক করার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পারিবারিকভাবে ইনভেস্ট করেন এ জন্য তাদের এফিলিয়েশন থাকে। ব্যাংক মালিকদের দাবি ছিল, যারা প্রতিষ্ঠাকালে পরিচালক হিসেবে ইনভেস্ট করেন তাদের পরে কিছু বলার থাকে না। অন্য লোকজন এসে মাঝখানে কিছু নিয়ে চলে যায়। যারা ফাউন্ডিং ডাইরেক্টরস, তাদের যেন একটা রোল থাকে। তিনি বলেন, একই পরিবার থেকে কোনো ব্যাংকে চারজন পরিচালক থাকলে ভালো-মন্দ দুটোই হতে পারে
জানা গেছে, এতদিন বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকগুলোকে পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ‘মনোনয়নের আগে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হতো। সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ‘নির্বাচন বা মনোনয়নের পর তাকে নিয়োগ দেয়ার আগে’ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। পরিচালক পদে সরকার কাউকে মনোনয়ন দিলে তাদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কোনো ব্যাংকের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কাউকে নির্বাচিত বা মনোনীত করার পর বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন না দিলে তার নিয়োগ হবে না। এ আইন সংশোধনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত কী ছিল জানতে চাইলে শফিউল আলম বলেন, ১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ সম্পর্কিত ধারাটি পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ধারাটি সংশোধন করা হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইনে তিনটি ধারার পরিবর্তনে বাংলাদেশ ব্যাংকও সম্মতি দিয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা এই আইনের সংশোধনের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এক শ্রেণীর ব্যাংক পরিচালকদের অবৈধ সুবিধা দেয়ার জন্য এই আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এতে করে দেশের ব্যাংকিংখাতের নৈরাজ্য আরো বৃদ্ধি পাবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239927