৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:৫২

সওজের শুভঙ্করের ফাঁকি

বাড়েনি সড়ক-মহাসড়ক

দেশের সড়ক মহাসড়ক উন্নয়নে গত পাঁচ বছরে ২৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন বাদ দিলেও এ বরাদ্দ দাঁড়ায় সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ এই পাঁচ বছরে দেশে সড়ক-মহাসড়কের দৈর্ঘ্য এক বাড়েনি। যোগ হয়নি এক কিালোমিটার সড়কও। তার উপর চলতি অর্থবছরে সড়ক খাতে ৯ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা সাসেক রোড করিডোরের তিনটি রুট গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এর মধ্যে ৮৯ শতাংশ সড়কই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির। কোনো বিবেচনাতেই এসব সড়ক উপআঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত নয়।
ভুক্তভোগিদের মতে, ঈদ এলেই মহাসড়কগুলোর বেহাল অবস্থা সারোদেশের মানুষ জানতে পারে। ঈদে ঘরমুখি যাত্রীদের ভোগান্তির সীমা থাকে না। আর তখনই মহাসড়কগুলো সংস্কারে তোড়জোড় শুরু হয়। এসব কারণেই প্রশ্ন উঠেছে সড়ক খাতে বছরের পর বছর ধরে বিশাল এই বরাদ্দ তাহলে কোথায় যাচ্ছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের এই শুভঙ্করের ফাঁকি আর কতোদিন? এ প্রসঙ্গে এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, আমাদের দেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের খরচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এটার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দেখি না। তিনি বলেন, ভৌগলিক দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের দেশে যে পরিমাণ সড়ক-মহাসড়ক আছে তা একেবারে কম নয়। দৈর্ঘ্য বাড়ানোর চেয়ে এগুলো চলাচলের উপযোগি করে রাখা জরুরী। এই উপযোগি করে রাখার কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ও সঠিকমানের হচ্ছে না বলেই মনে হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে মহাসড়ক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই কাজ বর্ষায় করতে হবে কেনো। এটা কোনো বর্ষার আগেই করা হলো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছর সংশোধিত বরাদ্দ রয়েছে ৯ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। অথচ গত ঈদুল ফিতরে সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কের বেহাল অবস্থার কারণে ঘরমুখি যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তার আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৭৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছর তিন হাজার ৬২৫ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছর তিন হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। যদিও এ সময় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের সড়কের দৈর্ঘ্য না বেড়ে উল্টো ১৫২ কিলোমিটার কমেছে। তারপরেও পরের বছর সড়ক খাতে ১৬ হাজার ৮২০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও মানসম্মত সড়ক বা মহাসড়ক কোনোটাই হচ্ছে না। এমনকি সময়মতো সেগুলো মেরামতও করা হয় না। বর্ষা বা ঈদ এলে শুরু হয় মেরামতের নামে তোড়জোড়। তড়িঘড়ি করে যা হয় তা অনেকটাই লোক দেখানো জোড়াতালিমার্কা কাজ। এ কারণে সেগুলোও টেকসই হয় না। গত ঈদে গাজীপুর অংশে যে সব সড়ক বা মহাসড়ক মেরামত করা হয়েছিল সেগুলোর বেশিভাগ এক মাসের ব্যবধানে খানাখন্দ হয়ে গেছে। যদিও সড়ক ও জনপথের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, বর্ষার কারণে ক্ষতিটা একটু বেশি হয়েছে। বর্ষা না হলেও সেগুলো বেশিদিন টেকসই হতো তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে এলজিইডি’র সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, সরকারের পরিকল্পনা কমিশন সড়ক মহাসড়কের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে দেয়। কোন কাজ কখন করতে হবে তার বিস্তারিত গাইডলাইন দেয়া থাকে। এর পরেও দেখা যায়, সে মোতাবেক কাজ করা হয় না। তিনি বলেন, বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে-এটাই স্বাভাবিক। এটাকে মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। উন্নয়ন কাজ কোনোভাবেই বর্ষায় করা উচিত নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটা অঙ্কের বরাদ্দ সত্তে¡ও দেশের বেশিরভাগ সড়ক-মহাসড়কের দৈর্ঘ্য কমার পাশাপাশি গুণগত মানেরও উন্নয়ন হয়নি। এখনও দেশের অধিকাংশ সড়কই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির। সড়ক ও জনপথের হিসাবেই দেশে প্রথম শ্রেণির সড়ক রয়েছে মাত্র চার শতাংশ। ইউএন-এসকাপের ‘এশিয়ান হাইওয়ে ডাটাবেজ’-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের তিনটি রুট গেছে। এক হাজার ৭৪১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কের প্রায় পুরো অংশই নিম্নমানের। এর মধ্যে এক কিলোমিটার সড়কও নেই এশিয়ান হাইওয়ে মানের। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৫-এর তথ্য মতে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোয়ালিটিতে বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯। এশিয়ার মধ্যে যে অবস্থান সবার নিচে। সড়ক অবকাঠামো সূচকে ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর দুই দশমিক ৯। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্কোর তিন দশমিক আট। এ ছাড়া এই সূচকে পাকিস্তানের স্কোর তিন দশমিক আট, শ্রীলংকার পাঁচ দশমিক এক, থাইল্যান্ডের চার দশমিক পাঁচ এবং চীনের স্কোর চার দশমিক ছয়। দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা সাসেক রোড করিডোরের তিনটি রুটও গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এগুলোর দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। এর মধ্যে এক হাজার ৩১৮ কিলোমিটার বা ৮৯ শতাংশ সড়কই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির। কোনো বিবেচনাতেই এসব সড়ক উপআঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সড়কের ভারবাহী ক্ষমতাও (এক্সেল লোড) দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অব এশিয়ান হাইওয়ে’র মতে, এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোর ভারবাহী ক্ষমতা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় অর্ধেক। পাকিস্তান এমনকি ভুটানের চেয়েও বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোর ভারবাহী ক্ষমতা কম।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে তিন হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। গত বছরও এর পরিমাণ একই ছিল। গত অর্থবছরে যুক্ত হয়েছে ২৬৯ কিলোমিটার। মূলত কিছু আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন কোনো সড়ক যুক্ত হয়নি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরও ছয় কিলোমিটার সড়ককে মহাসড়কে উন্নীত করা হয়। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩১ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক কমেছে। এর আগের তিন বছর তা অপরিবর্তিতই ছিল। চলতি অর্থবছর জেলা সড়ক কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার। ২০১২-১৩ অর্থবছর যা ছিল ১৩ হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার।
সওজের তথ্য মতে, গত কয়েক বছরে ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণও খুব একটা কমেনি। এইচডিএম এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে ৩৭ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। বাকি সড়কের মধ্যে ২৪ শতাংশ মোটামুটি চলনসই। ভালো অবস্থায় রয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ সড়ক। আর ২০১২ সালে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক ছিল ৩৮ শতাংশ। অনেকের মতে, এই প্রতিবেদনটি বর্ষার আগে করা। বর্তমানে সারাদেশের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ।
এর বাইরে রয়েছে চার লেনের মহাসড়ক। বহুল আলোচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পের কাজ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই দুই প্রকল্পে চার বছরে ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। কাজ শেষ করার পর ধরা পড়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই চার লেনের মহাসড়কের নকশাই ভুল ছিল। সার্ভিস লেন না থাকায় সব ধরণের যানবাহন চলাচল করায় চার লেনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে নতুন করে আবার এগুলোতে সার্ভিস লেন তৈরী করা হচ্ছে। যা অপরিকল্পিত কাজেরই নমুনা। এ দুটি মহাসড়কের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর সড়ক মহাসড়ক নির্মাণ ও মেরামতে দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, আমাদের দেশে কাজ করলে সেখানে ‘চুরি’ হবে-এটা অনেকটা স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই চুরির পরিমাণ কতো তা দেখার কেউ নেই। কাজ হচ্ছে-এটাই যেনো এখন বড় কথা। কাজের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি না তা দেখারও যেনো কেউ নেই। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে ফোন করলে অসুস্থতার জন্য তিনি কথা বলতে পারেন নি।

https://www.dailyinqilab.com/article/89622/