প্রধান রাস্তার এই বেহাল দশা ঢাকার ফার্মগেটে। ইনসেটের ছবিটি যাত্রাবাড়ীর-সমকাল
৩০ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:৫১

এর নাম ঢাকার রাস্তা

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বাইপাস সড়কটি অল্পস্বল্প ভাঙাচোরা থাকলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত মোটামুটি ব্যবহারের উপযোগী ছিল। গত সপ্তাহের বৃষ্টিপাতে রাস্তাটিতে পানি জমে যায়। সর্বশেষ ভারি বৃষ্টির পর পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেরোতে থাকে ভাঙাচোরা কঙ্কালসার সড়ক। সেখানে কেবলই গভীর গর্ত। আর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ইট-সুরকি-পাথর। এমনভাবে ভেঙেচুরে তছনছ হয়েছে যে, একপাশ দিয়ে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ রাজপথের এখন এ রকমই হাল।

সাম্প্রতিক ভারি বর্ষণে যেসব সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে জেগে উঠছে তছনছ হয়ে যাওয়া ভাঙাচোরা রাস্তা। অলিগলির সড়কগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। এককথায়, পুরো রাজধানীর সব সড়কই এখন ক্ষতবিক্ষত ও গায়ে

দগদগে ঘা। এরই মধ্যে নগরজুড়ে চলছে বেপরোয়া খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তির অন্ত নেই।

যানবাহনগুলোকে অনেক সাবধানে হেলেদুলে চলতে হচ্ছে রাজপথ দিয়ে। খানাখন্দে পড়ে যত্রতত্র ইঞ্জিন বিকল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতেও দেখা যাচ্ছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর সব রাস্তাই বিটুমিন (পিচ)

দিয়ে তৈরি। বিটুমিনের প্রধান শত্রু পানি। বিটুমিনের ওপর পানি জমা থাকা অবস্থায় যানবাহন চলাচল করলেই রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সামান্য বিটুমিন উঠে গেলেই খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তা ভেঙে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়। ইট-সুরকি বেরিয়ে পড়ে। সেসব সুরকি চাকার নিচে পড়লে দ্রুত আশপাশের সড়কও ভেঙে যায়। এমন অবস্থা এখন অন্তত ৫০ শতাংশ রাস্তার, যা দ্রুত মেরামত করা দরকার।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক জানান, বর্তমানে মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। ওই এলাকার সব রাস্তা, ফুটপাত ও ড্রেনের আধুনিকায়ন করা হবে। এ ছাড়া বৃষ্টিতে যেসব রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে যানবাহন চালু রাখার জন্য মেরামতের কাজ চলছে। এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে যেসব রাস্তা ভেঙেচুরে গেছে সেগুলো মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক কার্যালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিজ নিজ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার তালিকা করতে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে নগরবাসীর ভোগান্তি দূর করতে কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, সেটাও জানাতে প্রকৌশল বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বর্তমানে রাস্তার দৈর্র্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সম্প্রতি গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা এলাকায় যেসব রাস্তার আধুনিকায়ন করা হয়েছে, সেগুলোরও বিভিন্ন স্থান বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডিএসসিসি এলাকায় সম্প্রতি যে শতাধিক উপসড়কের আধুনিকায়ন করা হয়েছে, জলাবদ্ধতার কারণে সেগুলোরও অনেক স্থান ভেঙে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

এসব সড়ক ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কই এখন ভাঙাচোরা। যেসব এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বা বিভিন্ন সেবা সংস্থার ভূগর্ভস্থ লাইন স্থানান্তর করা হচ্ছে সেগুলোতে চলাচলকারী মানুষের জন্য দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় তীব্রতর হয়েছে যানজট।

খুবই নাজুক অবস্থা কাকরাইল থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত সড়কের। গর্তগুলোকে দেখে ম্যানহোল ভেবে ভুল করছেন অনেকে। কিছু এলাকায় পানি স্থায়ীভাবেই জমেছে। অনেক স্থানে রিকশা-অটোরিকশা-ট্যাক্সি যেতে চায় না। গেলেও দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া হাঁকেন চালকরা।

ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরতুল্লাহ বলেন, ডিএনসিসি এলাকার মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ রাস্তা রয়েছে মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। এ দুটি এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। অন্যান্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার মেরামতও দ্রুত করা হচ্ছে।

ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কী পরিমাণ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটার তালিকা তৈরির কাজ চলতি সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাবে। কিছু সড়কে একেবারেই নতুন করে কার্পেটিং করতে হবে। তালিকাটা পেলেই তারা সেসব সড়ক আধুনিকায়নের কাজ দ্রুত শুরু করবেন। আপাতত যানবাহনগুলো চলতে যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য চলছে মেরামতের কাজ।

সরেজমিন চিত্র :শান্তিনগর থেকে বাড্ডা পর্যন্ত সড়কে সরেজমিনে দেখা যায়, ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজে আগে থেকেই কাটাকুটি চলছিল। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে পুরো সড়ক পানিতে ডুবে যায়। এক নাগাড়ে পাঁচ ফুট দৈর্ঘ্যেরও সমতল কোনো অংশ নেই।

রামপুরার বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শেখ হাসান তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করে বলেন, চাকরির কারণে তাকে প্রতিদিন গুলিস্তান থেকে বারিধারা যাতায়াত করতে হয়। বাসে গেলে কখন যে পেঁৗছবেন তার নিশ্চয়তা নেই। কখন বাস কোন দিকে হেলে পড়ে সেই আতঙ্কে সারাক্ষণ থাকতে হয়। কখনও কখনও বাস বিকলও হয়ে পড়ে।

এ সড়কে চলাচলকারী বলাকা পরিবহনের চালক ইছানুর বলেন, ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে বাসের নাটবল্টু খুলে খুলে পড়ে যায়। ইট-সুরকিতে টায়ার কেটে-ছিঁড়ে যায়। এ সড়কে চলাচলকারী প্রতিটি পরিবহনের আয়ু অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে ঢাকা-গাজীপুর তিনটি ট্রিপ দিতে পারতেন, এখন সেখানে এক ট্রিপের পর দ্বিতীয়টি শেষ করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে মহাখালী পর্যন্ত সড়টিরও এখন বেহাল দশা। রাস্তাটি সমতল নয়, আগে থেকেই উঁচু-নিচু ছিল। বৃষ্টির পরে ভেঙেচুরে একাকার। বিজি প্রেসের সামনে থেকে ফ্লাইওভারে ওঠার লেনটি এতই খারাপ যে মাঝে মধ্যে ইট-সুরকি ঢেলে চালু রাখার চেষ্টা করেও কখনও লেনটি বন্ধ করে দিচ্ছেন ট্রাফিক সদস্যরা।

মিরপুর রোডের কল্যাণপুর থেকে টেকনিক্যাল পর্যন্ত সড়কটির অবস্থাও প্রায় বর্ণনার অতীত। চলতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত পথচারীদের।

মেট্রোরেলের জন্য :মিরপুরের পল্লবী থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত সড়কে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন যানবহন খুঁড়ে রাখা গর্তের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি রাতের বেলায় একটি দোতলা বাস ধীরে ধীরে কাত হয়ে গর্তে পড়ে যায়। এ সড়কে পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইভেট কারের গর্তে পড়ে থাকা নৈমিত্তিক দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। ওই এলাকায় মেট্রোরেলের জন্য কয়েক মাস ধরেই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। তার ওপর ভারি বর্ষণ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে। প্রকল্পের কারণে খোঁড়ার পাশে চলাচলের অংশ যেটুকু ছিল, তাও তছনছ।

অলিগলি :প্রধান সড়কগুলোর যখন এই অবস্থা, তখন অলিগলির অবস্থা আরও খারাপ। কারণ সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর নেই। কল্যাণপুর ও মিরপুর বাঙ্লা কলেজ থেকে পীরেরবাগের ভেতর দিয়ে রোকেয়া সরণিতে যুক্ত হওয়া রাস্তাটিতে হেঁটে চলাফেরা করতে আতঙ্কে থাকতে হয় পথচারীদের। নেহাত জরুরি কাজ ছাড়া এলাকাবাসীর অনেকে ঘর থেকে বের হতে চান না।

তালতলা থেকে জনতা হাউজিং পর্যন্ত সড়ক দিয়ে কোনো রিকশাচালক যেতে চান না।

যাত্রাবাড়ী থেকে কাজলা পর্যন্ত সড়কটির এতই বেহাল অবস্থা যে, চলতে গেলে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে গাড়ি উল্টে যাবে। উত্তর যাত্রাবাড়ীর অলিগলির বেহাল অবস্থার সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা যুক্ত হয়ে পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের মোড় থেকে বারিধারা ডিওএইচএস পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা একেবারেই বাজে।

বনশ্রী এলাকার এ থেকে এম ব্লক পর্যন্ত এলাকার বেশ কয়েকটি রাস্তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বি ও সি ব্লকের মূল সড়কটি চলাচলের অনুপযোগী। ডি, ই, এফ, জি ব্লকের মূল সড়কেরও একই অবস্থা। রামপুরা টেলিভিশন ভবন থেকে বনশ্রী আবাসিক এলাকায় যাতায়াতের রাস্তাটি তো প্রায় অচল।

সমন্বয়হীন :সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসা, তিতাস, ডিপিডিসি, বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একেবারেই সমন্বয় নেই। সমন্বয়হীন কাটাকাটির ফলে নগরবাসীর ভোগান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়। আবার এসব সংস্থা ভালো রাস্তা কাটার পর সেটা ঠিকমতো মেরামত করে যায় না। করলেও আগের আদলে ফিরে আসে না। ঠিকাদাররাও যত্রতত্র নির্মাণসামগ্রী ফেলে রেখে বিদায় নেন।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, এই সমন্বয়হীনতার কারণে নগরবাসীর ভোগান্তি তো আছেই। এবার বৃষ্টিতে রাস্তাগুলোর যে বেহাল অবস্থা হয়েছে, তাতে ওই ভোগান্তির মাত্রা আরও কয়েকগুণ বাড়বে। এ জন্য সেবা সংস্থাগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা দরকার। সেটা না হলে এমনটা চলতেই থাকবে।

http://bangla.samakal.net/2017/07/30/312540