১ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্য হতে আবারও আইন লঙ্ঘন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট গঠন-প্রক্রিয়া, এতে কারা থাকবেন, কতজন সদস্য হবেন, তা আইনে সুস্পষ্ট করা আছে। এগুলো মেনে সিনেট গঠন করাটা আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইনের সেই বাধ্যবাধকতা না মেনেই সিনেট অধিবেশনে তিনজনের প্যানেল নির্বাচন করা হয়েছে। এ ছাড়া সিনেট অধিবেশনের কোরাম পূরণ নিয়েও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।
গত ২৯ জুলাই সিনেটের বিশেষ অধিবেশন হয়। সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য আইনকে পাশ কাটাতে প্রশাসন কৌশলের আশ্রয় নেয়। এর সবকিছুর লক্ষ্য হলো উপাচার্য পদে তৃতীয় মেয়াদে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নিয়োগ নিশ্চিত করা। আইনের ওই অপপ্রয়োগের প্রধান সুবিধাভোগী উপাচার্য নিজেই। উপাচার্য প্যানেলে তাঁর নামটি রয়েছে সবার ওপরে। তালিকায় থাকা অপর দুজন হলেন বর্তমান কোষাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিন এবং আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের আহ্বায়ক আবদুল আজিজ। আনুষ্ঠানিকতার জন্যই বাকি দুজনের নাম দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ-১৯৭৩ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে ২০(১) এবং ২১(২) ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। অনুকূল পরিবেশ, যথেষ্ট সময় ও সুযোগ এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ২০(১) ধারার আলোকে সিনেট পরিপূর্ণভাবে গঠন করা হয়নি। এই ধারায় সিনেটে ১০৫ সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন আছেন মাত্র ৫৫ জন। কর্তৃপক্ষ ৫০টি শূন্যপদ পূরণের ব্যবস্থাও নেয়নি। এর মধ্যে ২০ জন মনোনীত, ২৫ জন নির্বাচিত রোজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এবং ৫ জন ডাকসুর মনোনীত ছাত্র প্রতিনিধি।
তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ২১(২) ধারা অনুযায়ী বিশেষ অধিবেশন ডাকার ক্ষেত্রে সিনেটের ৩০ জন সদস্যের লিখিত সুপারিশ প্রয়োজন ছিল। তা ছাড়া সিনেটের সঙ্গে কোরামেরও কোনো সম্পর্ক নেই। ডাকার জন্য নয় বরং সিনেটের কোনো অধিবেশন পরিচালনার জন্য সেখানে কমপক্ষে ২৫ জন সদস্য উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বর্তমান প্রশাসন কোরামকেই মূল বিবেচ্য ধরছে।
গতকাল সোমবার রাতে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, নানাজনে নানা কথা বলছেন। এটা তাঁদের অধিকার। এ নিয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই। অবশ্য গত ২৮ জুলাই তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
সবকিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন বর্তমান উপাচার্য পূর্ণাঙ্গ সিনেট গঠন
না করেই প্যানেল নিয়োগের কাজ সারলেন, তা আমার বোধগম্য নয়। এটি যৌক্তিক হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এটি নৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে কতটা সঠিক, তা বিবেচনার দাবি রাখে।’
সাবেক উপাচার্য ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ও স্বৈরাচার এরশাদের সময়ও সিনেট পূর্ণ ছিল। গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও ১৯৯৬ সালে সিনেট অধিবেশনে ৭৮ জন উপস্থিত ছিলেন। ২০০৪ সালে ছিলেন ৮৫ জন। কিন্তু ৪ বছর ৭ মাস অনির্বাচিতভাবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন এবং সব মনোনীত পদ পূরণ না করেই সিনেট অধিবেশন ডাকেন বর্তমান উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক। যে সিনেটে ১০৫ জন থাকার কথা, সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৩৬ জন, আর সিনেটে মোট সদস্য ছিলেন ৫০ জন। আর এবার সিনেটের মোট সদস্য ছিলেন ৫৫ জন। অধিবেশনের দিন উপস্থিত ছিলেন ৪৭ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান উপাচার্য প্রথম মেয়াদে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান। অনির্বাচিতভাবেই তিনি ৪ বছর ৭ মাস দায়িত্ব পালন করেন। তাই অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিককে নির্বাচিত করার জন্য বিশেষ সময়ের কারণে ৩৬ জনকে নিয়েই অধিবেশন বসে। আর এটি ছিল আমাদের সম্মিলিত ভুল। কিন্তু এবার তো নির্বাচন দিতে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। এ কারণে এবারের সিনেট অধিবেশন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’
অধ্যাদেশের ২০(১) ধারা অনুযায়ী সিনেটের ১০৫ জন সদস্যের মধ্যে থাকবেন উপাচার্য, দুজন সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সরকার মনোনীত ৫ জন সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত ৫ জন সাংসদ, আচার্য মনোনীত ৫ জন শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত ৫ জন গবেষক, একাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত অধিভুক্ত কলেজের ৫ জন অধ্যক্ষ ও ১০ জন শিক্ষক, ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ২৫ জন নির্বাচিত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ৩৫ জন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ডাকসু মনোনীত ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি।
দেখা গেছে, বর্তমান সিনেট কমিটিতে পদাধিকার বলে ৫ জন সদস্য আছেন। তাঁরা হলেন উপাচার্য, দুজন সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। আচার্য, সরকার ও স্পিকারের মনোনীত ৫ জন করে মোট ১৫ জন সদস্যও সিনেটে আছেন। কিন্তু সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের মনোনীত ১৫ জন সদস্য সিনেটে থাকার কথা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় ১০০ কলেজ থাকা সত্ত্বেও সেখান থেকে ১৫ জনকে মনোনীত করতে দেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভাপতি হলেন উপাচার্য। একইভাবে ৪৪ হাজার রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটের মধ্যে ২৫ জন প্রতিনিধি রাখতে নির্বাচন দেওয়ার জন্য সময় ও পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠান করেনি।
সাবেক দুজন উপাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন উপাচার্যের ওপর সব সময় নির্ভর করে না। ১৯৯১ সালের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে ছিল না। ক্ষমতাসীনেরা মনে করে, এই নির্বাচন তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে নড়বড়ে করতে পারে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর সেই অবস্থা নেই। উপাচার্য হওয়ার আগে আরেফিন সিদ্দিকও বিভিন্ন সময়ে ডাকসু নির্বাচনের দাবি করেছেন। উপাচার্য হওয়ার পরও ডাকসু নির্বাচন করার কথা বলেছেন। তাই ৫০ জন প্রতিনিধি নির্বাচন না করে উপাচার্য প্যানেল নিয়োগের যৌক্তিকতা প্রশাসন দেখাতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য নীলিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ সিনেট অধিবেশন যেখানে পূর্ণাঙ্গ হতে ৩০ জন সদস্যের অনুমতি লাগে। সেখানে ২৫ জনের কোরামের কথা বলে যেভাবে নির্বাচন হলো, তার যুক্তি থাকতে পারে না। প্রশাসনকে আইন মেনে চলা উচিত।
নীল দলের একটি অংশকে সিনেট অধিবেশনের বাইরে রাখতে উপাচার্য একতরফা নির্বাচনের পথে গেছেন বলেই অভিযোগ তাঁদের। গত মে মাসে সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শিক্ষকদের নীল দল দুটি অংশে ভাগ হয়ে আলাদা প্যানেল দেয়। বর্তমান উপাচার্যবিরোধী একটি অংশের অভিযোগ ছিল, উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের বাদ দিয়ে নীল দলের ৩৫ জনের প্যানেল ঘোষণা করা হয়। এই অংশও পরে পাল্টা ৩৫ জনের আরেকটি প্যানেল ঘোষণা করে। কিন্তু এই প্যানেল নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দেয়। তখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
বাতিল হওয়া প্যানেলের একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপাচার্য বলেছিলেন বাদ পড়া ১৪ জনকে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি বা অন্য শ্রেণিগুলো থেকে সিনেটে যুক্ত করবেন। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন দিলে এই পক্ষকে সিনেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হতো।
রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনের আগেই গত ১৬ জুলাই সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্তের পর গত ২৪ জুলাই উচ্চ আদালতে ওই ১৪ শিক্ষকের ১২ জন ও ৩ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিষয়ে রিট করেন। আদালত তখন অধিবেশন ডাকার চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত করেন। দুই দিন পর চেম্বার বিচারপতি ওই আদেশ স্থগিত করে ৩০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ দেশে না থাকায় ৬ আগস্ট শুনানির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1272861/