১ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১০

আগামী নির্বাচনও কি মামাবাড়ির আবদারই হবে?

খান মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী

ছোট সময় মা যখন কোন মজার খাবার আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন, তখন যদি কেউ বলতো “আমি খাবো না”। তা শুনতে খুব ভালো লাগতো। এ বয়সেও কোন অনুষ্ঠানে যদি বন্ধুদের মধ্যে কেউ বলে, দই মিষ্টি খাবো না, আমার সমস্যা আছে। তখনও খুশি লাগে। কারণ খাবারটা অন্যজনে না খেলে আমি খেতে পারবো। মনে হচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগেরও একথাটা শুনতে এত মজা লাগে, যা অন্য কথায় লাগে না। সেটা কোন কথা? যদি বিএনপি বা তার জোট বলে নির্বাচনে যাবো না। বিএনপির নির্বাচনে যাবো না ফিলোসোফিতে আওয়ামী লীগ এতটাই মজা পেয়েছে যে, একথা না শুনলে আর ভালোই লাগে না। এ কারণেই একটার পর একটা এমন পরিবেশ তৈরি করে, যেনো বিএনপি বলতে বাধ্য হয় নির্বাচনে যাবো না। পাঠকবৃন্দের মনে থাকার কথা এ মজাটা আওয়ামী লীগ প্রথম করে পেল। ’৭০-এর কথা বলছি না তখন তো ৩০০ আসন এর মধ্যে ২৯৪ আসন পেয়েও তারা খুশি হতে পারেনি, কারণ আওয়ামী লীগ-এর বিপক্ষে প্রার্থী আছে এটাই বড় ক্ষোভ। তাই সিরাজ সিকদারকে নাকি মহান সংসদের মধ্যেই চেয়ার দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। সেদিকে যাবো না এ দলটি মজা পাওয়া শুরু করেছে ’৮৬ সাল থেকে। যখন বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী মিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছে, এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে। আমি তখন একজন সাধারণ ছাত্র। শরীয়তপুর শহর একটি ছোট শহর সেখানেও আন্দোলনে রাজপথ আন্দোলিত। হঠাৎ রাত ১২টার দিকে শুনি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে চলে গেছে, জনাব এরশাদের হাত ধরে। ৩টি দলের মধ্যে এ দলটি যখন এমন আচরণ করলো তখন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও চিন্তাশীল দল জামায়াতে ইসলামী দেখলো আওয়ামী লীগ একাই গোল দিতে চায়। তাই জামায়াতও নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস ভঙ্গকারী বললেও জামায়াতকে বলতে পারেনি কারণ, জামায়াত অবস্থা বিবেচনা করেই অংশ নিয়েছে। এর পর থেকে যতবার বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলেছে ততবারই আওয়ামী লীগ খুশি হয়েছে। আবার যখন বিএনপি বলেছে খালি মাঠে গোল দিতে দিবো না, তখন এমন এক অবস্থার জন্ম দিয়েছে যেনো বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব না হয়। অসম্ভবকে সম্ভব করে হলেও যখন নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। তখন শাসকগোষ্ঠীর খোচানী কে সইবে? “বিএনপির এবার শুভবুদ্ধি উদয় হলো, তারা জানে নির্বাচনে না গেলে অস্তিত্ব থাকবে না, নেতা কর্মীরা বিএনপি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বিএনপির পায়ের তলায় মাটি নেই ইত্যাদি”। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের উপর নির্ভর করা হলো। সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলো। ক্ষমতাশীনদের অধীনে নির্বাচন। এটা কি কোন যুক্তিতে পরে? কিসের যুক্তি সংবিধানে আছে এটাই বড়। তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করা চলবে না। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল। তাও সহ্য হয় না। এটাও নাকি সংসদ সদস্যরা ঠিক করে দিবে। কে বিচারক হবেন, তা যদি নির্ধারণ করে দেয় সংসদ সদস্যরা তা হলে বিচারকগণের হাত পা বাঁধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না আওয়ামী লীগ যা বলবে সেটাই আইন। তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের পর এবার নতুন ফন্দি নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা। যদি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন হয় তবেই নাকি ফেয়ার নির্বাচন সম্ভব। তাই তারা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাজনীতি কারে কয় তা আওয়ামী লীগ খুব ভালোই জানে। যাদের কাছ থেকে কমিশনের তালিকা চাওয়া হয়েছে তাদের তালিকার বাইরে পছন্দের লোকটিকে রেখে দিয়ে বলে দেয়া হলো কারো কথায় নয় তালিকার বাইরে থেকে একেবারে নিরেট নিরপেক্ষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার। মজার বিষয় হলো- মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্যার দায়িত্ব নিয়ে কুমিল্লার সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে প্রমাণ করে দিলেন তিনি একেবারেই নিরপেক্ষ। এরপর থেকে তিনি এমন কার্যক্রম শুরু করলেন যে, ইতঃপূর্বে সমালোচিত সিইসিগণ কোন রোডম্যাপ তৈরি করতে হলে অন্তত বিরোধীদলসহ অন্যান্য দলকে জিজ্ঞেস করতেন। এবার দেখা যাচ্ছে তিনি একাই রোডম্যাপ তৈরি করেছেন। এ বিষয় প্রধান বিরোধীদলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বললেন, “ম্যাপ তো পরে রোডটা কোথায়”। আর সরকারী দলের মহাসচিব বললেন, “নির্বাচন কমিশন সংবিধানের বাইরে গেলে সমালোচনা করবো।” এই যে দুই বড় নেতার দু’রকম বক্তব্য এটাই তো আমাদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিবে। এদিকে জনাব নাসিম সাহেব একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী এবং নেতাও তিনি বলেছেন, “বিএনপির কোন কথাই শুনা হবে না”। এসব কথা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ নয় বরং বিভাজন করবে যা কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ সকল ধরনের কৌশলই প্রয়োগ করেছে। ফখরুদ্দিন মঈনউদ্দিন সরকারকে আশির্বাদ মনে করা থেকে এক তরফা নির্বাচন, ধাপে ধাপে নির্বাচন, অন্যদলের প্রার্থীকে গুম করা, জেলে নেয়া থেকে শুরু করে কিনা করেছে। জেল, জুলুম, ফাঁসি, নিবন্ধন বাতিল, প্রতিক বাতিল থেকে শুরু করে কি না করা হলো।
একটার পর একটা পলিসির সর্বশেষ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ। ইতিপূর্বে স্বচ্ছ ভোট বাক্সে ভোট গ্রহণ করার কৌশলও জাতি দেখেছে। ইভিএম হোক আর স্বচ্ছ ভোট বাক্স হোক সব বিষয়ই অন্যসব দলের সাথে আলোচনা করা দরকার। তা যদি নাসিম সাহেবের দরকার না হয় তথাপি নির্বাচন কমিশনের দরকার হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশন যদি রাজনৈতিক নেতাদের মতোই ভূমিকা পালন করেন তা জাতির জন্য হবে এক বড়ই বেদনাদায়ক বিষয়। এ বিষয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, “শুধু রোডম্যাপ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। রোডম্যাপ হচ্ছে একটি আইনী প্রক্রিয়া। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করতে হবে। কোন দলকে বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নয় আবার কোন দল নির্বাচন বর্জন করলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না।” অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বাঘা নেতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বিএনপি মুখের বিষ দিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশটাকে বিষাক্ত করছে।” বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন কিনা এ নিয়েও ওবায়দুল কাদের সাহেব মহা টেনশনে পড়ে গেছেন। লন্ডনে খালেদা জিয়া কি করছেন, কোন্্ ধরনের চক্রান্ত করছেন এ নিয়েও তো এ নেতার টেনশনের শেষ নেই। অথচ আওয়ামী লীগ যে কেন লন্ডন সম্মেলনে যোগ দিল না এর কোন ব্যখ্যা এ গুণী ব্যক্তির বক্তব্যে নেই। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বিগত লন্ডন সম্মেলনে যে ভুল তথ্য দিয়ে তুলোধুনোর সম্মুখীন হয়েছিলেন এবার গিয়ে কি বলবেন তা সাজিয়ে গুছিয়ে সারতে পারেননি বলেই মনে হয়। যাক অন্যের ব্যথা-বেদনা নিয়ে ভাবাটাও একটি মহৎ কাজ। ইতিপূর্বে বিএনপির মহাসচিব কে হবেন এ নিয়ে ওনারা যতটা চিন্তিত ছিলেন বিএনপি থাকবে কিনা নাকি নামসহ মুছে যাবে। আর জামায়াত! বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (প্রায়ত) বলেই দিয়েছেন, “কই জামায়াত নাকি কত শক্তিশালী, তাদের নেতাদের ফাঁসি দিল অথচ একটা মাছিও নড়লো না।” জনাব লতিফ ছিদ্দিকী বলেছিলেন, “রায় দরকার নাই আগে ফাঁসি দাও।” “খালেদা জিয়ার বাংলাদেশে থাকার দরকার নাই পাকিস্তান চলে যাক।” দুঃখজনক হলেও সত্য বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জামায়াতের মাছি নড়া দেখে যেতে পারলেন না আর জনাব লতিফ সিদ্দিকী থেকেও আজ আমাদের সামনে নেই অথচ খালেদা জিয়া বাংলাদেশেই আছেন। “নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত কোন সুবিধাই করতে পারবে না কারণ তারা মানুষ হত্যা করেছে গাড়ি পুড়িয়েছে।” আরেক বাঘা নেতা জনাব শাজাহান খানের উপরোক্ত বক্তব্য শুনলে তো মনে হয় এ দেশে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কোন দলই নেই, তারা ’৭০-এর নির্বাচনের মতো ২৯৪ আসনই পাবে। তবে কেন বিএনপি-জামায়াত জোট নিয়ে এত কথা বলে সময় নষ্ট করা? গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে যে কিভাবে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া বানানো যায় তা তো আমরা বুঝতেই পারছি আর সে কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় বলছেন, “উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই আওয়ামী লীগকে আরো একবার ক্ষমতায় থাকা দরকার।” অতএব কিভাবে আরো একবার ক্ষমতায় থাকা যায় সে চেষ্টা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেই যাচ্ছেন, সাথে যদি বর্তমান মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহযোগিতা করেন তবে আর লাগে কি? সিইসি স্যার যে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করবেন তা ছিমটম দেখেই বুঝা যায়। শোনা যায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এডভোকেট আজমত উল্লাহ খানের প্রার্থীতা প্রায় চূড়ান্ত, এ বিষয় তরুণ নেতা এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলমকে প্রয়োজনে বলি দেয়া হবে। এর অর্থই হলো রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ প্রবেশদ্বার নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর তাদের কব্জায় রাখতে হবে। মূল রাজধানীর দু’সিটি তো হাতে আছেই। এরপর সারা দেশে নিজের মতো করে নির্বাচনী নাটক মঞ্চায়ন করা হলে কেউ ঢাকায় এসে আন্দোলন করবে দু’দিক থেকে দু’মেয়র মহোদয় তা যোগ্যতার সাথে পাহারা দেবেন আর মূল ঢাকায় তো দু’তরুণ মেয়র আছেনই। রাজনীতি আর নির্বাচন কাকে বলে তা অন্যদের শিখিয়ে দেয়ার এক মহাপরিকল্পনা চলছে। তাইতো বলা হয়, এবারের নির্বাচনও কি মামা বাড়ির আবদার হবে? কেউ কেউ বলেন, মামা বাড়ির নয় এটা হবে পিতার সম্পদ রক্ষার চেষ্টা কারণ এ দেশ স্বাধীন করেছে আওয়ামী লীগ। সে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোন দলের তো রাজনীতি করার অধিকারই নাই। বরং তারা যে রাজনীতি করতে দিচ্ছে এটাই তো বড় মহত্বের পরিচয়, এর চেয়ে বেশি চাওয়া কি ঠিক হবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/294216-