৩১ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:১০

সাভার ট্যানারিও যেন 'হাজারীবাগ'!

দূষণ পিছু ছাড়ছে না চামড়া শিল্পের

পরিবেশ দূষণ পিছু ছাড়ছে না চামড়া শিল্পের। রাজধানীর হাজারীবাগে অপরিকল্পিত ট্যানারির কারণে বছরের পর এর আশপাশের এলাকা বিশেষ করে বুড়িগঙ্গায় দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে এক যুগের বেশি সময়ের প্রচেষ্টায় সাভারে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাভারেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। ট্যানারির তরল ও কঠিন বর্জ্য ওই এলাকার জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুড়িগঙ্গার জায়গায় ধলেশ্বরী দূষণ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে ট্যানারি চালু করার পরিণতিতে এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এর সমাধান করা উচিত। এদিকে কঠিন বজ্র্যের সাময়িক ব্যবস্থাপনায় শিল্প মন্ত্রণালয় কিছু উদ্যোগ নিলেও এর প্রতিকার হচ্ছে না। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা চাইলেও তা পায়নি শিল্প মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি চামড়া শিল্পনগরীতে সরেজমিন ঘুরে বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণের ঘটনা চোখে পড়ে। হেমায়েতপুরের বাঘবাড়ি মোড় থেকে হরিণধরার দিকে এগোতেই চামড়ার পচা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। শিল্পনগরীর ভেতরে ঢুকে কিছুটা এগোতেই মিতালী ও সমতা ট্যানারির পাশের সড়কের ওপর তরল বর্জ্য ভাসতে দেখা যায়। চালু থাকা এ দুই ট্যানারির মাঝখানের পথ ময়লা পানিতে ডুবে আছে। এর ডানদিক দিয়ে খানিকটা এগোলে নবারুণ ও আইয়ুব ট্যানারির পাশের সড়কও বর্জ্যের পানিতে ডুবে রয়েছে।

কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) ভেতরে দেখা যায়, দুটি মডিউল দিয়ে চলছে বর্জ্য পরিশোধনের কাজ। অন্য পাশে চীনা নির্মাণ শ্রমিকরা বাকি দুটি মডিউলের যন্ত্রপাতি স্থাপন করছেন। কয়েক দফা মেয়াদ শেষ হলেও সিইটিপি নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেনি চীনা প্রতিষ্ঠান। দুটি মডিউলে তরল বর্জ্য পরিশোধন করার পর পানি একটি চৌবাচ্চায় ফেলা হচ্ছে। এই পানি দেখতে স্বাভাবিক পানির মতো নয়। এর রঙ কালো এবং তা থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। দূষিত এ পানি পাইপ

দিয়ে ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। পরিবেশ অধিদপ্তর সিইটিপি চালুর পর পাঁচবার পরীক্ষা করে চৌবাচ্চা এবং একই সঙ্গে ধলেশ্বরীর পানিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পেয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, এ পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বেশি। দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম। ক্রোমিয়াম ও লবণের পরিমাণ রয়েছে অতিমাত্রায়। জৈব রাসায়নিক উপাদানও গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। ফলে প্রতিনিয়ত নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।

শিল্পনগরীর পাশের গ্রাম ঝাউতলার বাসিন্দা মো. শাহজাহান এ প্রতিবেদককে বলেন, ট্যানারির ময়লার কারণে গন্ধে ঘরে থাকা দায়। ট্যানারি চালু হয়েছে এক বছরও হয়নি। এর মধ্যে তার ঘরের চালের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। জামা-কাপড়ে রঙ থাকছে না। স্বর্ণের গহণার রঙ বদলে যাচ্ছে। গৃহস্থালি সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। একই গ্রামের মো. সাইফুল ইসলাম জানালেন, সাভার এখন চরম দূষণের কবলে পড়েছে। আগে থেকেই কল-কারখানার বর্জ্যের কারণে কিছু দূষণ ছিল। এখন ট্যানারির বর্জ্যের কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েছে ।

এদিকে তরল বর্জ্য পরিশোধনের কাজ শুরু হলেও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না। সিইটিপির বিপরীত দিকে একটি অস্থায়ী কুয়ার মধ্যে কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য স্তূপ করার কারণে এলাকাজুড়ে বায়ুদূষণ হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে এরই মধ্যে এই কুয়া ময়লা ও পানিতে ভরে গেছে। অতিমাত্রায় বৃষ্টি হলে পুরো এলাকায় যা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাভার চামড়া শিল্পনগরীর কঠিন বর্জ্য আমিন বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ল্যান্ড ফিল্ডে ফেলার বিষয়ে গত ডিসেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সম্মতি দেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি না হওয়ায় আবার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। সেখানে ডিএনসিসি বর্জ্য দূষণমুক্ত করে নিজ খরচে ফেলাসহ নানা কঠিন শর্ত আরোপ করে। এসব শর্ত প্রতিপালন করে কঠিন বর্জ্য অপসারণ সম্ভব নয় বলে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। চিঠিতে তিনি ডিএনসিসির দায়িত্বে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য সাভার থেকে আনার সুবিধা চান। এ ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ বিসিক বহন করবে। কিন্তু এর উত্তরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিছু জানায়নি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ২০৫টি প্লটে ১৫৫ ট্যানারির মধ্যে সাভারে ৬০টি ট্যানারি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণের কাজ শুরু করেছে। বাকি শিল্পগুলোর নির্মাণকাজ চলছে। প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকলেও কঠিন বর্জ্য ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাপনার (এসপিজিএস) কাজ শুরু হয়নি। তবে এ কাজের ঠিকাদার বুয়েটের সঙ্গে আলোচনা করে নকশা চূড়ান্ত করেছে। ট্যানারির কঠিন বর্জ্য অস্থায়ীভবে রাখা হয়েছে, যা মোটেই স্বাস্থ্য ও পরিবেশসম্মত নয়।

বর্তমানে চামড়া শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি ক্রেতারা সাভারের চামড়া শিল্প পরিদর্শন করছেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্পনগরীর পরিবেশ সমুন্নত রাখতে ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে কঠিন বর্জ্য জরুরিভিত্তিতে অপসরণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বাংলাদেশ ফিনিসড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সমকালকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কঠিন সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান চান তারা। সাভারে আর দূষণ করতে চান না ট্যানারি মালিকরা। তারা এ সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, শিল্পনগরী প্রকল্প গ্রহণের সময়ে সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে এখন কঠিন বর্জ্যের দূষণ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিসিক ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে মাটির নিচে ডাম্পিং করলে তেমন সমস্যা হবে না। একই সঙ্গে কঠিন বর্জ্য ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়ার আগে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত, যাতে আগামীতে এই বর্জ্য নিয়ে সমস্যায় পড়তে না হয়। প্রয়োজনে নতুন করে যথাযথ কোম্পানিকে কাজ দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেন, চামড়া শিল্পের পরিবেশ দূষণে বড় সমস্যা কঠিন বর্জ্য। এর ফলে স্থানীয়রা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এভাবে বর্জ্য স্তূপ করলে পরিবেশের ক্ষতি ভয়াবহ রূপ নেবে। আবার আমিন বাজারে ডাম্পিং স্টেশনে ফেলানো সমাধান নয়। সরকারকে এক বছরের মধ্যে স্থায়ী সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্পনগরী নির্মাণ কাজের সময় করা হয়নি। এ জন্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, দূষণ বন্ধ না করা গেলে ট্যানারি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এখন মালিকরাই ড্রেনের মধ্যে কঠিন বর্জ্য ফেলে আটকে দিচ্ছেন। এতে শিল্পনগরীর মধ্যে রাস্তায় ময়লা ভাসছে। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় কেন পরিবেশের দায়িত্ব নিচ্ছে? এ দায়িত্ব পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সংস্থার থাকা উচিত।

চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল হক সমকালকে বলেন, সিইটিপির কাজ আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করবে চীনা প্রতিষ্ঠান। কঠিন বর্জ্য পরিশোধনের জন্য এসপিজিএস নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি স্থাপনের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, তরল বর্জ্য পুরোপুরি পরিশোধন হচ্ছে না। পূর্ণাঙ্গভাবে সিইটিপি চালু হলে এটি পরিশোধন সম্ভব হবে। কঠিন বর্জ্য নিয়েই তারা এখন বেকায়দায় আছেন । এ সমস্যা সমাধানে মাঠ পর্যায়ে কিছুই করা সম্ভব হয়নি।