২৮ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১৯

সমন্বয়হীনতা অদূরদর্শিতা ও অপ-উন্নয়নে অচল রাজধানী

দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় সুরক্ষিত হলেও গত বুধবার সেখানে নজীরবিহীন পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। মন্ত্রী, আমলাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এমন পানি দেখেননি বলে মন্তব্য করেন। একই সাথে বিশেষ করে দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সচিবালয়ে ‘বন্যা’ হওয়াকে সরকারের উন্নয়ন প্রচারণাকে অসার প্রমাণের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ বলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন।
শুধু সচিবালয় নয়, ওইদিন বৃষ্টির পানিতে ডোবে গোটা রাজধানী ঢাকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো এ নিয়ে সরস আলোচনা-মন্তব্যের কোনো কমতি ছিল না। অনেকেই বলেছে, ঢাকা একটি নদীর নাম। সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায়ও ওইদিন পানি ঢুকে। পুরান ঢাকা, মিরপুর, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, রামপুরা, মগবাজারসহ ঢাকা নগরীটায়ই এদিন পানি থই থই করে। পানিমগ্ন রাজপথে দিনভর ছিল যানজট। আবার যেসব ডুবন্ত সড়কে গাড়ি চলাচল করেছে মনে হয়েছে যেন নতুন ধরনের কোনো নৌকা ভেসে চলছে।
কিন্তু কেন এই পানিবদ্ধতা? এমন প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ নাগরিক সবার। এর কারন খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, ওয়াসাসহ সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, অদূরদর্শিতা ও অপ-উন্নয়নে ঢাকা শহরের এই অচল দশা। বিভিন্ন সংস্থার অব্যাহত খোঁড়াখুঁড়িতে সৃষ্ট ছোট-বড় গর্তগুলো টানা বর্ষণের পানিতে জলাধারে রূপ নিয়েছে। রাজপথ থেকে অলিগলি সর্বত্র এসব ‘পুকুর’ ও ‘ঝিল’ নাগরিক দুর্ভোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। রামপুরা ব্রিজ থেকে মালিবাগ রেলগেট, মৌচাক হয়ে শান্তিনগর সড়কে গতকালও স্থানে স্থানে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। এসব পানিবদ্ধ গর্তে বিশেষ করে ছোট যানবাহন পড়ে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। যেখানেই কথিত উন্নয়ন প্রকল্প সেখানেই দুর্ভোগ বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে ভুক্তভোগী নাগরিক ও বিশেষজ্ঞ সবাই বলছেন। নির্মাণাধীন মগবাজার-শান্তিনগর ফ্লাইওভারের কারণে এই এলাকাটি এক রকম পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। মৌচাক মার্কেট ও ফরচুন শপিং মলসহ বিপণী বিতানগুলোর দোকানীরা বেচা-বিক্রি না হওয়ায় লোকসানের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মেটো রেল প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়িতে মিরপুর-আগারগাঁও এলাকার সড়কগুলো খানাখন্দকে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব খানাখন্দক বৃষ্টির পানিতে জলাধারে পরিণত হয়ে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় কর্তৃপক্ষ ‘নাগরিকদের সাময়িক দুর্ভোগের জন্য দুঃখিত’ বললেও কার্যত তা চলতে থাকে বছরের পর বছর। তাছাড়া যখন কোনো প্রকল্প নেয়া হয় তখন এর পরিণতি ভাবা হয় না। শান্তিনগরের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নতিকল্পে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ফলাফল চিন্তা না করায় পানিবদ্ধতার সমস্যাটি রয়েই গেছে, মাঝে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হলো। একইভাবে মতিঝিল, ফার্মগেট কিংবা অন্যান্য এলাকার কথিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতেও ঠিকাদারগোষ্ঠীর স্বার্থকেই যেন বড় করে দেখা হয়, জনস্বার্থ তুচ্ছ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে কখনোই রাজধানীর পানিবদ্ধতা দূরীকরণে সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হয়নি।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ১ থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৯ শতাংশ। অথচ গত বছর একই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল মাত্র ৩ শতাংশ। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আবহাওয়া ভিভাগের এ তথ্যকে লুফে নিয়ে জনগণের সামনে একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা এও বলছেন, আগামীতে এ ধরনের পানিবদ্ধতা নগরবাসী দেখবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় নামমাত্র বৃষ্টিপাত হলেও অনেক জায়গার পানিই সরেনি। ছোট ছোট পানির আধারগুলো সপ্তাহের শেষ দিনও নাগরিকদের ভুগিয়েছে। পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডসহ কয়েকটি এলাকার পানি গতকালও নামেনি। এর জন্য পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ডুবন্ত ঢাকাকে বাঁচাবে কে সেই প্রশ্নও উঠেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও মন্ত্রণালয়ও নাগরিকদের জন্য স্বস্তির কোনো কথা জানাতে পারেনি। অবশ্য পরিত্রাণের উপায় এবং সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এমন (পানিবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। গত সাড়ে আট বছরে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ও পানিবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর কিছু করেনি। সরকারও এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি কোনো কর্মসূচি নেয়নি। এখন পরিস্থিতি যখন সঙিন হয়ে উঠেছে, তখন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেছেন এক বছরের মধ্যে সমস্যার সমাধান করবেন।
তবে সরকারের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে সরকারের কার্যত কোনো কর্মসূচি নেই। সরকার জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়। তারও সব বাস্তবায়িত হয় না। কিন্তু ঢাকার পানিবদ্ধতা নিরসন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, কর্মসূচি আর সিদ্ধান্ত এক নয়। পানিনিষ্কাশনের জন্য ঢাকা ওয়াসা নগরীর হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করবে-এটি একটি সিদ্ধান্ত। কিন্তু খালগুলো কীভাবে উদ্ধার করবে, কত দিনের মধ্যে করবে, সরকারের কোন কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে কর্মসূচি। সরকারের এ রকম কোনো কর্মসূচি নেই।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, সপ্তাহ দুয়েক আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের উদ্যোগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। মেয়রের বিশেষ আমন্ত্রণে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীও সেই সভায় অংশ নেন। সেখানে আলাপ-আলোচনায় ঢাকার পানিনিষ্কাশন ও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একটি ‘কার্যকর, সময়নির্ভর ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা’ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে। সভায় এ রকম একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজ শুরুরও সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকার খাল পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সেই মহাপরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। তা ছাড়া এই কাজের সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন এবং আরও কোনো কোনো সংস্থাকেও যুক্ত করা দরকার। সেসব প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করতে সময় লাগবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের ডাকা ওই সভায় একটি মত এসেছিল যে নগরীর পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার। সেই কাজ যদি সিটি করপোরেশনকে করতে হয়, তাহলে ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের অধীনে দিতে হবে। অথবা নিদেনপক্ষে ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কথা হয়েছিল ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগকে সিটি করপোরেশনের আওতায় দেয়া হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, ঢাকা নিয়ে শুধু পরিকল্পনাই হয়েছে এবং হচ্ছে। সেগুলো বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ থোরাই। তিনি বলেন, ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। দশকের পর দশক এ দুটো বাস্তবতাকে ধরেই এই নগরের বিশদ পরিকল্পনাগুলো হয়েছে। এখন জরুরি হলো বাস্তবায়ন পর্ব শুরু করা।

http://www.dailysangram.com/post/293658-