২৮ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪২

তিন যুগেই গায়েব ঢাকার জলাশয়

গত তিন যুগে রাজধানী ঢাকার জলাভূমির অর্ধেকেরও বেশি গায়েব হয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় নদী ও খালের আয়তন ছিল ২৯ বর্গকিলোমিটার। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে। খাল ও নদীর মোট আয়তনের দুই-তৃতীয়াংশই ভরাট হয়ে গেছে। ১৯৭৮ সালে নিম্ন ও জলাভূমির আয়তন ছিল ১৩০ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার। ২০১৪ সালে তা কমে হয়েছে ৮১ দশমিক ৩৩ বর্গকিলোমিটার।

১৯৭৮ সালে ঢাকার মোট আয়তনের ৫২ ভাগই ছিল নদী, খাল ও নিম্নভূমি। ২০০৯ সালের তথ্যানুযায়ী, ৩৫৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানীর মাত্র ২১ ভাগ ছিল জলাভূমি। ৬৫ শতাংশ জলাভূমি কমেছে তিন দশকে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে বাস্তব চিত্র আরও খারাপ বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

২০০৯ সালে

'প্রি অ্যান্ড পোস্ট আরবান ওয়েটল্যান্ড এরিয়া ইন ঢাকা সিটি :বাংলাদেশ, এ রিমোট সেনসিং অ্যান্ড জিআইএস অ্যানালাইসিস' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. জিএম তরিকুল ইসলাম। তিনি গবেষণায় দেখান, ১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে ঢাকা মহানগর এলাকায় ১৮ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার নদী ও খালের আয়তন কমেছে। জলাভূমি কমেছে ৭৬ দশমিক ৬৭ বর্গকিলোমিটার। তিন দশকে ঢাকার নদী, খাল ও জলাভূমির ৬৫ শতাংশই ভরাট হয়ে গেছে।

অধ্যাপক তরিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তিনি ও তার সহকর্মীরা 'জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম' (জিআইএস) বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণা করেন। এতে ঢাকার যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে স্পষ্ট_ তিন দশকে রাজধানীর জল ধারণের ক্ষমতা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। ঢাকার মানচিত্র থেকে 'নীল' রঙ হারিয়ে যাচ্ছে।

এ গবেষণায় ২০০৯ সাল নাগাদ তথ্য রয়েছে। গত আট বছরে পরিস্থিতি কতটা বদলেছে_ এ প্রশ্নে অধ্যাপক তরিকুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। যদি উন্নতি হতো, তাহলে ঢাকায় জলজট হতো না। জলজট প্রমাণ করে_ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কতটা খারাপ হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের পর ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নতুন আবাসিক এলাকার জন্য নিচু জমি ও জলাভূমি ভরাট হয়েছে। মিরপুর, কালশী এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকা ভরাট করেছে আবাসন কোম্পানিগুলো।

সাতারকুল, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের বছিলার নিম্নাঞ্চলও ভরাট করা হয়েছে অপরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য। অপরিকল্পিত উন্নয়নের উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক তরিকুল ইসলাম বলেন, পূর্বাঞ্চলে বন্যা ঠেকাতে 'ইস্টার্ন বাইপাস' নামে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রামপুরা, বাড্ডা এলাকার পানি নামার কোনো পথ থাকবে না। তিনি গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ২০০৯ সালে ঢাকার আয়তনের ২১ ভাগ জলাভূমি টিকে ছিল। এখন তা অনেক কম।

২০০৯ সালের পরও যে নদী, খাল, জলাভূমি কমেছে_ তা সরকারি গবেষণাতেই স্পষ্ট। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালে ঢাকায় জলাভূমির আয়তন ছিল ২৯ দশমিক ৫২ বর্গকিলোমিটার। নিম্নভূমি ছিল ১৩৫ দশমিক ২৮ বর্গ কিলোমিটার। খাল ও নদী ছিল ২৯ বর্গকিলোমিটার। ২০১৪ সালে জলাভূমি কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৩৫ বর্গকিলোমিটারে। নিম্নভূমি দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক বর্গকিলোমিটারে। ওই বছর নদী ও খালের আয়তন ছিল ১০ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এ হিসাবে ২০০৯ সালের পর পরবর্তী পাঁচ বছরে খালবিল ও জলাভূমি কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। এ হার অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাভূমি ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে সতর্ক করা হয়েছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের প্রতিবদনে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যপক ড. এম মনোয়ার হোসাইন সমকালকে বলেন, ঢাকায় যে প্রতিদিন জলাভূমি কমছে; খালবিল, নদী ভরাট হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, কোনো গবেষণারও দরকার নেই। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে, প্রতিদিন সব খাল দখল হচ্ছে, নদী ভরাট হচ্ছে। নিচু ও জলাভূমি ভরাট করে ভবন তোলা হচ্ছে।

খাল ও নদী উদ্ধারে ২০১০ সালে ছয়টি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। এরও আগে খাল ও নদী দখলকারীদের চিহ্নিত করা হয়। ১০ হাজারের বেশি দখলদারের তালিকা করা হয়। কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হয়। অভিযানের কয়েক দিনের মধ্যেই দখল আগের রূপ নেয়। প্রতি বর্ষায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতায় ভুগতে হয় নগরবাসীকে। জলজট সৃষ্টি হলে সরকারের তরফ থেকে তাৎক্ষণিক আশ্বাস দেওয়া হয়_ খাল, নদী দখলমুক্ত করা হবে। বর্ষার পর তা সবাই ভুলে যান। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, এ দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে জলাভূমি উদ্ধার কার্যক্রম।

ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, ঘণ্টায় ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই শহরের প্রধান সড়ক তলিয়ে যাচ্ছে। গত বুধবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টায় মাত্র ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিতে শহরের প্রায় সব প্রধান সড়ক কয়েক ঘণ্টার জন্য ডুবে যায়। যদিও ওয়াসার দাবি, ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা রয়েছে তাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হকের অভিমত, ওয়াসার সক্ষমতার দাবি কাগুজে। সংস্থাটির পানি নিষ্কাশনের ততটা ক্ষমতা নেই, যতটা তারা দাবি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব জানান, বৃষ্টির পানি তিনটি উপায়ে নিষ্কাশিত হয়। পানির একটি অংশ মাটি শুষে নেয়; আরেকটি অংশ জলাধারে জমা হয়। বাকি অংশ খালের মাধ্যমে নদীতে চলে যায়। কিন্তু রাজধানীতে খোলা মাটির পরিমাণ খুবই নগণ্য। টপ সয়েল (খোলা জমি) কংক্রিটে ঢাকা পড়ায় মাটি পানি শোষণ করতে পারছে না। বিল ও নিম্নাঞ্চল ভরাট হওয়ায় পানি ধারণের জায়গা নেই। খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি নদীতেও নামতে পারছে না।

http://bangla.samakal.net/2017/07/28/311956