২৮ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩২

আস্থা পুনরুদ্ধার কৌশল

আস্থা পুনরুদ্ধার কৌশল

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ (Confidence Building Measure) বলে একটি টার্ম আছে। এর অর্থ, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দল বা সরকার যদি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে সেই আস্থা পুনরুদ্ধারে তারা নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়। এই পদক্ষেপ ইতিবাচক বা নেতিবাচকÑ উভয় ধরনের হতে পারে। এ পদক্ষেপ বা কৌশল থেকে সুকথা, সুকাজ এবং সুশাসনের মতো বিষয়াদি দৃশ্যমান করা হয়। অপর দিকে, জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য যদি অন্যায়, অত্যাচার, অপকৌশল, মিথ্যা, প্রতারণা অর্থাৎ ছল-বল-কল সব কিছুকে একটি কৌশল হিসেবে নেয়া হয়। এখানে নীতিবোধের কোনো স্থান নেই। এই উপমহাদেশে প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ কৌটিল্যকে (খ্রি: পূ: ৩২৭) অনৈতিক রাজনীতির অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তাকে প্রাচীন ভারতের কূটরাজনীতিজ্ঞ এবং অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা বলে মনে করা হয়। ইতিহাসে তিনি চাণক্য বা বিষ্ণগুপ্ত বলেও পরিচিত। কৌটিল্য মনে করেন, ‘রাষ্ট্র ও নিজের শাসনকে রক্ষা করার জন্য শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য শাসককে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। এ লক্ষ্যে কোনো কৌশল গ্রহণে শাসকের দ্বিধা করলে চলবে না। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ ধরনের দর্শনের জন্য ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি:) অগ্রগণ্য। তার বিবেচনাও কৌটিল্যের মতো। তিনি মনে করেন, ‘রাষ্ট্রের স্বার্থ সাধনের জন্য বিশেষ কোনো নৈতিকতায় আবদ্ধ না থেকে যা কিছু প্রয়োজন তাই সম্পন্ন করা বোঝায়। তিনি কূটকৌশল ও শক্তি প্রয়োগের ওপর জোর দেন। ম্যাকিয়াভেলির মতে, ‘রাষ্ট্রে উত্তম শাসক সে, যে শাসিত অর্থাৎ জনসাধরণের মধ্যে ভয় ও সমীহের ভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম। একজন শাসক হবে সিংহের মতো সাহসী এবং শিয়ালের মতো ধূর্ত’। তিনি পরামর্শ দেন যে বিদ্রোহ দমনে রাজা নির্মম হবেন। আবার নির্মমতা প্রদর্শন করলেন যে সেনাপ্রতি, তাকে নির্মমতার জন্য ফাঁসি দিয়ে রাজা নিজেকে ‘প্রজারঞ্জক’ প্রমাণ করবেন। এ ধরনের নীতি রাজনীতির ভাষায় দ্বৈত অবস্থান বা ‘ডাবলস্ট্যান্ড’ বলে পরিচিত। প্রাচীন থেকে এ সময় পর্যন্ত রাষ্ট্র, রাজধানী ও রাজনীতিতে অনেক কৌশলগত অথবা কূটকৌশলগত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন হয়েছে। মূল কৌশলের পরিবর্তন না হয়ে শুধু নামেধামে অথবা টার্মিনোলজিতে নতুন নতুন শব্দমালা সংযোজিত হয়েছে। যেমন এখন ‘জনরঞ্জনবাদ’ (Populism) বলতে যা বোঝায় তা অনেকটা কৌটিল্য বা ম্যাকিয়াভেলি দর্শনের কাছাকাছি। রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষকে তুষ্ট করার জন্য যেকোনো কথা, কাজ বা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। ‘আস্থা পুনরুদ্ধার কৌশলও’ সাম্প্রতিককালের রাজনীতিতে অনুরূপ একটি ধারণা।
সরকারের বর্তমান কার্যাব্যবস্থা দেখে মনে হয় যে, তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, এজেন্সি রিপোর্টগুলো ভালো নয়। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যে গবেষণাগুলো পরিচালিত হয়েছে তার রিপোর্টগুলো সরকারের অনুকূল নয়। যদিও মার্কিন-ভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা সরকারের জনপ্রিয়তার অতিউচ্চ পরিসংখ্যান দিয়েছেÑ আসলে তা বাস্তবসম্মত নয়। সে জন্য সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে সতর্কতা অব্যাহত রয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রধান থেকে অন্যান্য নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদের কর্মীমহলে যে বার্তা দিয়েছেন তার সারমর্ম হলো ‘এবার আগের মতো ভোট হবে না’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের আস্থা অর্জন করে নির্বাচনে জিততে হবে। অনেক আওয়ামী লীগার আশা করে আছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যেভাবে নির্বাচন কারসাজি (Election Engneering) করে গোটা জাতিকে নির্বোধ বানিয়েছেন, সে রকমই তারা জিতে যাবেন। এবারে নির্বাচন কমিশনের হাবভাব বোঝা মুশকিল। তারা গেলবারের মতো তাদের ‘ব্লাঙ্ক চেক’ দেবে সে ভরসা মিছে। সুতরাং, শাসক আওয়ামী লীগকে স্বরূপ অন্বেষণে অথবা আত্মসমালোচনায় ব্রতী হতে হচ্ছে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মতো প্রবীণ সাংবাদিকও আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হাতাশা ব্যক্ত করেছেন।
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র তথা সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ-আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের অঙ্গহানি ঘটিয়েছে। আইনসভা যে যথার্থভাবে প্রতিনিধিত্বশীল নয়, তা একটি বালকও বোঝে। সুতরাং, আইনসভা সম্পর্কে যতটা কম বলা যায়, ততই ভালো। এর পর যদি বিচার বিভাগ সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হয় তাহলে দেশের বিচারালয়ের প্রধান ব্যক্তির বারবার উচ্চারিত শব্দাবলিই কি যথেষ্ট নয়? তা ছাড়া ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ যেভাবে উচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব নিতে যাচ্ছিল এবং ওই সংশোধনী বাতিলের পরে যেসব বাক্যাবলি সংসদের আলোচিত হয়েছে তা দেখে কি বোঝা যায় না যে, বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন আছে? ওই রায়ের দু’দিন পরে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন ‘কোনো দেশের বিচার বিভাগের অসহায়ত্ব সে দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না’। এর যথার্থ উত্তর কী? আইনসভা ও বিচার বিভাগের এই দুরবস্থার পর বাকি থাকে রাষ্ট্রের আর একটি কার্যকরি অঙ্গÑ আর তা হলো নির্বাহী বিভাগ। মূলত নির্বাহী বিভাগই রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি। তারাই দেশের শাসনব্যবস্থা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নির্বাহী অংশকে দুই ভাগে বিবেচনা করা যায়। প্রথমত রাজনৈতিক নির্বাহী যারা জনপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে আসন নেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাবিনেট বা মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন। এদের মেয়াদ একটি নির্দিষ্ট সময়ের। কিন্তু দ্বিতীয় নির্বাহী অংশ যারা রাষ্ট্রের প্রশাসনকে পরিচালনা করেন তারা দীর্ঘকালের জন্য মনোনীত। সুতরাং তাদের সততা, সাহস, যোগ্যতা, মেধা, অভিজ্ঞতা ও আনুগত্যের ওপর নির্ভর করে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফ থেকে স্থায়ী নির্বাহী বা আমলাতন্ত্রকে শতভাগ দলীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। আমলাতন্ত্র ও এর পেশাগত মর্যাদা হারিয়েছে। সেখানে এখন আস্থা অর্জনের প্রতিযোগিতা চলছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও গুরুতর। সে পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ সরকার আর দুটো অঙ্গের দুরবস্থার পর আমলাতন্ত্রের ওপর অধিকতর ভর করার পরিকল্পনা আঁটছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। সে পরিপ্রেক্ষিতেই তারা বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক ইউএনও গাজী তারিক সালমনের ঘটনাটিকে অবলম্বন করতে চাইছে।
তারিক সালমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুরুতর! জাতির পিতার ছবির বিকৃতকরণের মতো স্পর্শকাতর বিষয় যখন তার বিরুদ্ধে উত্থিত হয়েছে তখন রাজনীতিক, আমলা বা আইনজীবী কারোরই সাধ্য ছিল না তার পক্ষ অবলম্বন করে। কিন্তু, অবশেষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব যখন বিষয়টি তারিকের অনুকূলে নিয়ে গেলেন, তখন আগের চেহারা পালটে গেল। কোর্টে সে দিন একজন আইনজীবীও তার পক্ষে কথা বলেননি। অপরদিকে, গণেশ উল্টে গেলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বাদি আইনজীবী, সংশ্লিষ্ট বিচারক ও রাজনীতিক নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি পাল্টে যায়। মূলত ওই আওয়ামী আইনজীবী অতি উৎসাহী হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিষয় নিয়ে ‘হিরো’ হতে চেয়েছিলেন। এখন শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে তিনি ‘জিরো’ হয়ে গেলেন। আর জিরো হতে যাওয়া ইউএনও তারিক হিরো হয়ে গেলেন। তাহলে বোঝা যায়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা সব কিছুর অনুঘটক। আইন, বিচার এবং প্রশাসন ‘কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করে’। একবার এর বিপরীত চিত্র ভেবে দেখুন। বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করার অপরাধ যদি আমলে না নেয়া হতো অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যদি জেলে পাঠানো না হতো, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিচারক কি নিজ আসনে বহাল থাকতেন? জেলা প্রশাসকদ্বয় কি রেহাই পেতেন? আসলে প্রশাসনের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি বিপদে আছেন’। যাই হোক বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের আস্থা পুনরুদ্ধার একটি কৌশল বলে প্রতিভাত হচ্ছে। তারা এ কার্যব্যবস্থা দিয়ে আমলাতন্ত্রের আস্থা অর্জন করতে চাচ্ছে। নাগরিক সাধারণকে এই বার্তা দিচ্ছে যে, তারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছে। দলের লোককেও রেহাই দিচ্ছে না। পত্রপত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনই যথেষ্ট যে ক্ষমতাসীন সরকার আমলাতন্ত্রের সাথে কী ব্যবহার করেছে। গডফাদারদের পিটুনি, লাঞ্ছনা এবং গঞ্জনা ভোগ করেনি এমন স্থানীয় আমলাদের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া ভার। পাবনার জেলা প্রশাসককে কী অবস্থায় প্রত্যাহার করা হয়েছিল তা মনে রাখার মতো। রামু, নাসিরনগর এবং অন্যত্র শাসকদলের সাম্প্রদায়িকতা ও অন্যায়-অপর্মের বোঝা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে বিদায় করা হয়েছে। এভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে শাসকদল ‘কাক কৌশল’ অবলম্বন করতে চেয়েছে। কিন্তু সবাই জানে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না’।
ক্ষমতাসীন সরকারের আস্থা পুনরুদ্ধারের আর একটি উদাহরণ হচ্ছে পুলিশি আঘাতে চক্ষুহীনতার পথে সিদ্দিকুর রহমান। তুঘলকী কাণ্ডের অন্যতম কাণ্ড জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা শহরের সাতটি কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তিকরণ। সে বিষয়টি বেশি বলার সুযোগ এখানে নেই। ঘটনাটি যা ঘটেছে তা হলো, ছাত্ররা ওই অপব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা নেয়। আক্রমণে সিদ্দিকুর রহমানের দুটো চক্ষুই নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। আগের ইউএনওর মতোই কর্তাব্যক্তিদের বক্তৃতা-বিবৃতি সংবাদ ভাষ্য উল্টে যেতে থাকে। শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম এবং আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরÑ কথার সহানুভূতি বর্ষণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এখন সিদ্ধান্ত হচ্ছে সরকার তাকে চেন্নাই নিয়ে যাবে। তাকে চাকরি-বাকরিও দেবে। আমরা সবাই বুঝি যে, ছাত্রদের এভাবে ঠ্যাঙ্গানোর বিষয়টি অবশ্যই পুলিশ কনস্টেবলের সিদ্ধান্ত নয়। হুকুমের আসামিদের চিহ্নিত না করে এখন ‘স্কেপ গোট’ করা হচ্ছে বেচারা পুলিশ সেপাহিদের। কর্তাব্যক্তিরা দক্ষতার সাথে তাদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু যে বা যাদের আদেশে ছাত্রদের সাধারণ দাবির এ মিছিলটিতে লাঠিপেটা করা হলো, তাদের পরিচয় কী? উল্লেখ্য যে আজকাল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতই তৎপর যে লোকদের জানা যায় অংশগ্রহণ করাটাও যেন একটি অপরাধ! মানববন্ধনও তারা পিটিয়ে দেয়। সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি বা জাতীয় তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ রক্ষা কমিটির মতো অরাজনৈতিক জাতীয় স্বার্থমূলক মিছিলকেও তারা নির্মমভাবে পর্যুদস্ত করে। এমন ধারার সরকারের এখন এমন কী সুমতি হলো যে তারা সিদ্দিকুর রহমানের জন্য ‘মায়াকান্না’ করছেন? আসল কথা হলো সামনে নির্বাচন। নিপীড়ন, নির্যাতন ও নির্মমতার মাধ্যমে সরকারের যে ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে তারা তার পরিবর্তন চান। লেখার প্রথমেই এর তত্ত্বগত দিকটি আমরা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি।
ক্ষমতাসীন সরকারের আস্থা পুনরুদ্ধারের এই প্রয়াস যে আকস্মিকভাবেই শুরু হয়েছে এমনটি নয়। যখন থেকে রাজকর্তৃত্বের মাথায় নির্বাচন চিন্তা ঢুকেছে তখন থেকেই ভয়ভীতি এবং লোভ-লালসা ইত্যাদি দেখিয়ে লোক বস করার ফন্দি তারা এঁটে আসছে। একদা রক্তপাতের মুখোমুখি ‘হেফাজতে ইসলামকে’ অধিকতর হেফাজতে গণভবনে নিয়ে আসাÑ আস্থা পুনরুদ্ধার কৌশলের একটি বড় সাফল্য। যে হেফাজতে ইসলাম সরকারের ভাষ্যমোতাবেক তাদের পতন নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলনে নেমেছিল, তারা এখন প্রায় নিশ্চুপ। গণভবনে হেফাজত নেতা আল্লামা শফীর গমন এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে আপ্যায়ন দৃশ্যত কোনো অভাবিত বিষয় নয়। কিন্তু তা অসংলগ্ন তার অতীতের ইতিহাসের কারণ দায়ী। রাজনীতিতে চিরশত্রু ও চিরমিত্র বলে কেউ নেইÑ এ কথা আবারো প্রমাণ হলো। ক্ষমতাসীন দলের বাম বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টি নিয়ে গোসসা করলেও, প্রকৃত শুভানুধ্যায়ীরা সর্বত্র কর্তৃত্বের কুশলতার প্রশংসা করেছে। অবশ্যই এ কথার অর্থ এই নয় যে, কোনো একটি বাহারি চমকে হৃদয় রক্তক্ষরণ দূরীভূত হতে পারে। সম্ভবত সময় আসবে সে পরীক্ষা দেয়ার ও নেয়ার। যা হোক আস্থা পুনরুদ্ধার কৌশলের কিছু বিষয় আমরা উল্লেখ করলাম। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই আমরা আরো ভালোভালো কথা এবং দৃশ্যমান ভালো কাজ দেখতে পাবো। মন্ত্রিসভায় রদবদলের কথা শোনা যাচ্ছে। অবাক হবেন না যদি প্রবল প্রতাপান্বিত ‘গডফাদারদের’ ছিটকে যেতে দেখেন। কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলির রাজনীতির কৌশল হিসেবে যারা ইতোমধ্যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা ও দুর্নীতি দিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তারা বাদ পড়বেন। এমন কি তাদের জেল-জুলুমও হতে পারে। মানুষ বলবে ‘বাহবা! বাহবা! বেশ!’। তবে তা ‘সকলই গরল ভেল’।
রাজনৈতিক ক্ষমতার ইতিহাস বড়ই করুণ, নির্মম ও নিষ্ঠুর। কৌটিল্য এবং ম্যাকিয়াভেলি যে অপদর্শন দিয়েছেন তা পরবর্তীকালে নৈতিকতাকে অতিক্রম করে প্রায়োগিক দর্শনে পরিণত হয়েছে। এখন গোটা বিশ্বেই নীতি-নৈতিকতা ও সুশাসনের আকাল চলছে। তবুও বাংলাদেশের আবহমান লালিত সংস্কৃতির, সভ্যতার ও সৌজন্যের কিছু অংশ অবশিষ্ট ছিল। গত আট বছরে তা-ও জলাঞ্জলি গেছে। এখন আর বিশ্বাস রাজনীতির ভিত্তি নয়। একজন অসহায় এরশাদ কিভাবে রাজনীতির বলি হলেন ২০১৪ সালের নির্বাচন তার প্রমাণ। সত্য কিভাবে মিথ্যায় পরিণত হয় তার প্রমাণ সেখানে রয়েছে। আমলাতন্ত্রকে, বিচারব্যবস্থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে কিভাবে নিকৃষ্ট ধরনের দলীয়করণ করা হয়েছে তা যেকোনো নাগরিকের কাছে স্পষ্ট। র্যাব যে সাত খুন করে, পুলিশ যে ঘরে আগুন দেয় এবং বিচারক যে হুকুমের কাছে নতজানু হয়ে পড়ে তা আমরা দেখেছি। এক সিদ্দিকুর রহমানের চোখ যায়নি। অতীতে অনেক সিদ্দিকুর রহমানের চোখ গেছে। এখনো পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয় ‘শাহজালালের চোখ গেল কোথায়’। সুতরাং আমরা ভালো হওয়ার ভান দেখতে চাই না। জনসাধারণ কোনো নির্দিষ্ট দল বা পক্ষকে ক্ষমতায় বসাতে চায় না। তারা চায় ‘সুশাসন’। এই সুশাসন কেবল জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল, স্বচ্ছ ও জাবাবদিহিমূলক সরকারের পক্ষেই নিশ্চিতকরা সম্ভব।
লেখক : সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/239339