কূটনৈতিক এসাইনমেন্টে ১০ বছর ধরে বিদেশে কাজ করা কর্মকর্তাদের অধীন গৃহকর্মীদের বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্রবিষয়ক সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। বিদেশের সব বাংলাদেশ মিশনে ওই নির্দেশনা জরুরি ফ্যাক্স বার্তায় পাঠানো হয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে নিয়োগকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মীর বিভিন্ন অভিযোগ, এক দেশে এসাইনমেন্ট শেষে কর্মকর্তাকে অন্য দেশে বা ঢাকায় বদলি করা হলেও গৃহকর্মীর ফেরত না আসা, বিশেষত আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে গৃহকর্মীর মামলা দায়েরের বিস্তর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা জারি হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘গৃহকর্মী’ নিয়ে বিদেশে জটিলতা এবং এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহে জারি হওয়া নতুন এ নির্দেশনায় অনেকের মাঝে রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। ১০ বছরের তথ্য পাওয়া গেলে অনেক কর্মকর্তার আসল চেহারা উন্মোচিত হবে, অনেকে ‘পাচারের’ দায়েও অভিযুক্ত হতে পারেন! সেগুনবাগিচা এবং বিদেশস্থ বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, অনারারী কনস্যুলেট ব্যতিত বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, কনসাল জেনারেল এবং মিশন প্রধানদের কাছে ওই জরুরি ফ্যাক্স বার্তা পাঠানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) নাজমুল হক স্বাক্ষরিত বার্তাটি হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন এশিয়া ও ইউরোপে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ জন মিশন প্রধান। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে তারা বলেন, বার্তাটি পাওয়ার পরপরই গৃহকর্মীর তথ্য হালনাগাদে ১০ বছরে ঢাকায় কিংবা অন্য মিশনে বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠিগুলোর জবাব পাওয়ার পরপরই তারা ঢাকায় তথ্য পাঠানো শুরু করবেন। জরুরি বার্তার সূচনায় বলা হয়- “দেখা গেছে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশে দায়িত্ব পালনকালে তাদের গৃহকর্মে সাহায্যের জন্য নিযুক্ত কর্মীদের অনেকে নিয়োগকর্তার পরবর্তী পোস্টিংয়ে তাদের অনুসরণ করেন নি। তারা ঢাকায়ও ফেরত যাননি। অনেকে আগেই পালিয়ে গেছেন এবং পরবর্তীতে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস ফাইল করেছেন। যা ওই কর্মকর্তাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থে বাংলাদেশ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অতীতের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বিদেশে কূটনৈতিক এসাইনমেন্টে যাওয়া ব্যক্তিদের অধীনে কাজ করা সব গৃহকর্মীর বিস্তারিত তথ্য অর্থাৎ তাদের বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান জানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য প্রত্যেক মিশন প্রধানকে তাদের মিশনে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের অধীন গৃহকর্মীদের তথ্য সংগ্রহের অনুরোধ করা হলো।” ফ্যাক্স বার্তার সমাপনীতে ৩টি ক্যাটাগরিতে তথ্য প্রদানের ছক সংযুক্ত করা হয়। প্রথমত গত ১০ বছরে মিশনের কর্মকর্তাদের অধীনে যে সব গৃহকর্মীর কাজ করেছেন তাদের নাম, পরিচয়ের বিস্তারিত। দ্বিতীয়ত তারা কোন মিশনে কার অধীনে কত দিন কাজ করেছেন তার বিস্তারিত। তৃতীয় এবং সর্বশেষ এই মুহূর্তে তারা কোন্ অবস্থায় রয়েছেন। অর্থাৎ কে ঢাকায় ফিরেছেন, কে ফিরেননি। না ফিরলে তারা কোথায় কোন্ অবস্থায় রয়েছেন। ওই দেশে স্থায়ী হওয়ার আশায় বা অন্য কোনো প্রলোভনে নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে মামলা বা ভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন কি-না? যা দেশ বা নিয়োগকর্তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে বা ফেলতে পারে! সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল সূত্র আগেই জানিয়েছিল, কূটনীতিকদের অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্তমানে থাকা গৃহকর্মীদের পর্যায়ক্রমে দেশে ফেরত পাঠাতে চলতি মাসের শুরুতে জরুরি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অতি সমপ্রতি তথ্য হালনাগাদের লিখিত নির্দেশনা জারির পর এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে বিদেশে আর কোনো গৃহকর্মী না পাঠানোর সিদ্ধান্ত আগেই হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে যারা বিদেশে আছে তাদেরও ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে আচমকা তাদের ফেরত পাঠানো সহজ হবে না জানিয়ে ঢাকার এক কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যেক কর্মীর সঙ্গে নিয়োগকর্তার লিখিত চুক্তি রয়েছে। এটি জমা দিয়ে তাদের ভিসা নিতে হয়েছে। এখন হঠাৎ এবং একতরফা চুক্তি বাতিল করলে এ নিয়ে জটিলতা আরো বাড়বে। তাই পর্যায়ক্রমে এবং চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের ফেরত পাঠানোর মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চলতি মাসে গৃহকর্মী জটিলতায় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যানজেলেস থেকে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল কাজী আনারকলিকে জাকার্তায় বদলি করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, গৃহকর্মী নিয়ে পরপর ৩টি ঘটনা ঘটেছে। যার সবক’টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। পেশাদার কূটনীতিক আনারকলির অধীনে থাকা গৃহকর্মী মো. সাব্বির (৩৯) অনেক দিন ধরে নিখোঁজ। সাব্বির পালিয়েছেন না কি তাকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার জন্য পালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তরফে এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে তার আইনি ঝামেলা এড়ানোর আগাম ব্যবস্থা হিসেবে মন্ত্রণালয় তাকে সরিয়ে এনেছে মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, যদিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি জাকার্তা যাওয়ার ভিসা পাননি। তাই তিনি আপাতত ঢাকায় ফিরেছেন। গত মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটের ডেপুটি কনসাল জেনারেল মো. শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে তারই অধীনে থাকা গৃহকর্মী মো. আমিন মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় তাকে আটক করে নিয়ে যায় নিউ ইয়র্ক পুলিশ। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ওই কূটনীতিকের পূর্ণ কূটনৈতিক সুবিধা (ডিপ্লোমেটিক ইমিউনিটি) না থাকায় তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পারেননি। একদিন সংশোধনাগারে থাকার পর নিউ ইয়র্কের কুইন্স সুপ্রিম কোর্টে ৫০ হাজার ডলার বন্ডে তিনি জামিন পান। তবে এখনো আদালতের নির্দেশে তার পাসপোর্ট জব্দ রয়েছে। মামলা চলছে। তার পূর্ণ কূটনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে কনস্যুলেট থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে মিনিস্টার পদে বদলি করা হয়। কিন্তু মামলা থাকায় তাকে পূর্ণ কূটনৈতিক সুবিধা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে জাতিসংঘ। শাহেদুল ইসলামের ঝামেলার মধ্যেই জাতিসংঘে কর্মরত বাংলাদেশি অনেক কূটনীতিক হামিদ রশিদের বিরুদ্ধে গৃহকর্মী নির্যাতন ও বেতন কম দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। তাকেও আটক করা হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে থেকে মামলা লড়েছেন। একই ধরনের অভিযোগে ২০১৪ সালে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের তৎকালীন কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই মামলার নোটিশ দেয়ার মাঝপথেই তিনি নিউ ইয়র্ক ছেড়ে যান। তবে তার অভিযোগ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।