১৭ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ৭:৫২

দেখা অদেখা

পানি ঘোলা করে মাছ শিকার

সালাহউদ্দিন বাবর

কারা এরা, যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কৌশল আঁটছে? ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার পাঁয়তারা সম্পর্কে সবাইকে সম্প্রতি সতর্ক করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কবি ও কলাম লেখক ফরহাদ মজহারকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের ধরে নেয়ার বিষয়টি প্রসঙ্গে এ মন্তব্য করেছেন। ইদানীং গুম করে ফেলা ও হত্যা করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এই বিষয়টির সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভীতিকর অবনতির চিত্র ফুটে উঠেছে। দেশের মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা, ছোট-বড় নির্বিশেষে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ-সংঘর্ষ-সঙ্ঘাত এতটা বেড়ে গেছে যে, তা আর তাদের ঘরোয়া ব্যাপার নেই। দেশের অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলার সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। এসব সংগঠনকে কোনোভাবেই ক্ষমতাসীনেরা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। পুলিশ ও গোয়েন্দারা বিষয়টি তদন্ত করছে বটে কিন্তু এখনো তাদের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। সবাই এ নিয়ে গভীর অন্ধকারে। এই ব্যাপারটি নিয়ে মন্ত্রী মহোদয় পানি ঘোলা করা এবং তাতে মাছ শিকার করার কথাটি উল্লেখ করেছেনÑ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ঘটনা এবং এর পেছনের খবর জানার অনেক উৎস তাদের রয়েছে। সরকারের বহু সংস্থা রয়েছে, তাদের মাধ্যমেই সাধারণের চেয়ে তার অনেক বেশি অবহিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় খুব পরিষ্কার করে কিছু না বললেও তার ছোট্ট কথা থেকে অনেক কিছু অনুমান করার সুযোগ আছে। তা ছাড়া গুম করে ফেলা এবং ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। এমন বহু ঘটনাই ঘটেছে। এ নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। হালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
দেশের সম্মুখে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এর প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়ার একটি কৌশল হয়তো থাকতেই পারে। নির্বাচন ভণ্ডুল করে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা বৈরী শক্তি করতেই পারে। রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মতপার্থক্য থাকবেই। এটাই গণতান্ত্রিক আচার। কিন্তু তাই বলে এই মতপার্থক্য এমন নয় যে, তা দেশে এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। তবে নির্বাচন ভণ্ডুল হলে দেশে যে নৈরাজ্য হবে তার আশঙ্কাই বেশি। তাই এমন অবস্থায় রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির যেকোনো অশুভ প্রয়াসকে রুখে দিতে হবে। বলতে গেলে দশ বছর পর একটি অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এখন কোনো পক্ষ এই সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে। যেসব কারণে নির্বাচনের পরিবেশ ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে এগুলো সৃষ্টি হওয়ার কোনো সুযোগ যাতে না হয় সে জন্য প্রধানত সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে। এ দিকে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনেও তেমন কোনো বিষয় নেই, যা থেকে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। এখন অবশ্য একটি বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আর তা হলোÑ নির্বাচন সহায়ক সরকার গঠন নিয়ে। একটি জাতীয় দৈনিক সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে নির্বাচন সহায়ক সরকারের বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। এসব আলোচনা থেকে স্পষ্ট, আমাদের সংবিধানেই এর সুরাহা হওয়ার পথ রয়েছে। নির্বাচন সহায়ক সরকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এসবের পরেও সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সরকারের ছত্রছায়ায় নির্বাচন কমিশন কাজ করেÑ এই ধারাই এখানে চলে আসছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন কখনোই এই বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সংবিধান তাদের যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার চর্চা করতে পারেনি। এই আশা সবার, নির্বাচনকালীন দলোর্ধ্ব সরকার পক্ষপাতহীন আচরণ করবে এবং জাতির জন্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
আর একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজনÑ সংবিধান বলেছে, (অনুচ্ছেদ ১১) ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু এ দেশের অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, নির্দেশনাটি সবক্ষেত্রে মান্য করা হচ্ছে না। আমরা আমাদের সরকারি নেতাদের মুখে কেবল উন্নয়নের কথা শুনি, কিন্তু তাদের কথায় বা আচরণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় না। বর্তমান সময়ে এমন অবস্থা তো বিরাজ করছেই, তদুপরি দূর এবং নিকট অতীতেও এই হালের কোনো বিশেষ ব্যত্যয় ছিলÑ এমন নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, সংবিধানের এ নির্দেশনাটি কেউ প্রয়োগ করেনি। অথচ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। এর সাথে এটা প্রমাণিত হয়ে যায়, জবাবদিহিমূলক ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে আছে। মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। বিরোধী দলের প্রতি যে আচরণ এখন লক্ষ্য করা যায়Ñ তাতে মর্মাহত হওয়া ছাড়া ভিন্ন পথ নেই। মানুষ দেখছে বিরোধী দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নানসহ কয়েকজন বিরোধীদলীয় মেয়রকে বারবার পদচ্যুত করা হয়েছে। এভাবে যদি জনপ্রতিনিধিরা নিগৃহীত হন তবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকে কোথায়? সরকারি নেতারা সংবিধান সংরক্ষণের শপথ নিয়ে শাসনভার গ্রহণ করেন। তাই এসব অসাংবিধানিক কাজ রুখে দেয়ার দায়িত্ব তো তাদের। কিন্তু বাস্তবে তা মোটেও দেখা যায় না।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যদি ব্যত্যয় ঘটে, তা হবে উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে যারা নির্বাচনের সময় ক্ষমতায় থাকবেন, তাদের আচরণ ও ভূমিকা নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই এ ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। দেশে ১০ দফা সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন যখন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিও ত্রুটিমুক্ত হয়নি। ভোট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোট দিতে না দেয়া, ভোটকেন্দ্রে মাস্তানদের দৌরাত্ম্য, ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের নীরব ভূমিকা নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট করে দেয়। এখন সাধারণ অবস্থায় সরকারের ভূমিকা ও কার্যক্রম থেকে যে ধারণা করা যায়, তাতে তাদের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না, বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে। যদি এই বক্তব্য আন্তরিক হয়, তবে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করার শর্তগুলো পূরণ করে এবং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার কায়েম করার যে দাবি এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তা মেনে নেয়াই সরকারের উচিত। চলতি জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে হয়েছে সে সম্পর্কে জাতির অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। দশম জাতীয় সংসদের সে নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট অংশ নেয়নি। ফলে সংসদ একদলীয় সংসদে পরিণত হয়েছে। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলে দেশে এখন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নেই, যা কি না গণতান্ত্রিক চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এভাবে কোনো দেশ চলতে পারে না। দেশের উন্নয়নের যে ধারার ব্যাপারে সরকার দাবি করছে, তা অব্যাহত রাখার স্বার্থে আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতাসীন থাকতে চান। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণ তাদের পছন্দ মতো সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের যদি আবারো ক্ষমতায় বসায়, তাতে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। তবে এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে যেটা অপরিহার্য শর্ত। তা না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। তখন উন্নয়নের যে ধারণা দেয়া হচ্ছে, তা ভেসে যাবে। এটা ভেবে দেখা উচিত।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সাথে নির্বাচনের বিষয় নিয়ে সংলাপ করবে। নিবন্ধিত দলগুলো নিয়েই সংলাপ হবে। তবে সুশীল সমাজের কাদের সাথে সংলাপ হবে, সে সম্পর্কে কমিশন কিছু বলেনি। তাদের সাথেই বৈঠক হওয়া উচিত, যাদের নির্বাচন নিয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং নির্বাচন নিয়ে যারা পড়াশোনা ও গবেষণা করেন, বস্তুত তাদের সাথে সংলাপ হলেই তা ফলপ্রসূ হবে। সবার স্মরণ রাখা উচিত, শুধু লোক দেখানো সংলাপ অর্থাৎ নিছক সংলাপের জন্য সংলাপ করার কোনো প্রয়োজন নেই। অতীতেও এমন সংলাপ নির্বাচন কমিশন করেছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো সুফল দেখা যায়নি। ইসি যে সংলাপ করবে, সেখানে যেসব যৌক্তিক পরামর্শ আসবে, তা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত। যারা সংলাপে আসবে তাদের ভেতর তখন ধারণা জন্মাবে, তাদের পরামর্শ কাজে এসেছে। সংলাপের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তখনই সফল হবে, যখন তারা খোলা মন নিয়ে বসবেন এবং যৌক্তিক বিষয় মেনে নেবেন। সরকার ও ইসিকে এটা বুঝতে হবে, দেশে যে ভোট হয় তার মানেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া নয়। বাংলাদেশ এখন এমন একটি পর্যায়েÑ যখন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো উন্নত গণতন্ত্র বা অবাধ নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন চায়। গণতন্ত্রের প্রাণ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন, তথা জনমতের সঠিক প্রতিফলন। একটি উন্নত গণতন্ত্রের অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে নির্বাচন নিয়ে; জনগণের আস্থা ও সন্তুষ্টি তার একটি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের আরো একটি বিষয় ভেবে নেয়া দরকার, তাদের পূর্বসূরিরা কমিশন যে অবস্থায় তাদের হাতে দিয়ে গেছেন, তাতে বলা যায়Ñ তাদের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তার একটিও মানসম্পন্ন তো নয়ই, জনগণ এ নিয়ে সম্পূর্ণ হতাশ। কমিশনের মর্যাদাকে তাদের উচ্চকিত করতে হবে, তাদের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করতে হবে এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; এর মর্যাদাহানি হোক তা হতে দেয়া যায় না। সুষ্ঠু ও ভালো নির্বাচন করার লক্ষ্যে ইসিকে যথেষ্ট ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আমাদের সংবিধান দিয়েছে, যাতে তারা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে করতে পারেন এবং জনগণ অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এবার নির্বাচনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির সব দায়িত্ব সরকার কিন্তু ইসির কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে। এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে না পারলে নির্বাচন ভালো হবে না মোটেও। আর সেই পরিস্থিতি দেশের জন্য দুর্যোগ ডেকে আনবে। এই লেখার শুরুতে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশঙ্কার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, দেশে পরিস্থিতি নাজুক করে কুচক্রীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। এ কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ; এ থেকে সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
সংবাদপত্রে প্রকাশ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে ইসি। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তিন মাসব্যাপী সংলাপ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের সাথে আলোচনা করা হবে। আর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসি পর্যায়ক্রমে বৈঠক করবে। ইসি নিজেদের মধ্যে যে বৈঠক করেছে তাতে সংলাপ আরো বিস্তৃত হবে। গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সাথেও তারা বৈঠক করবেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যারা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, তাদের সাথে ইসি কথা বলবে। সংলাপে আলোচ্যসূচিতে যে বিষয়গুলো থাকবে তাও সহসা ঠিক করে ফেলা হবে বলে খবরে প্রকাশ। নির্বাচনী আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য ইতোমধ্যেই কমিটি করা হয়েছে। কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিলে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের বিষয়গুলো জানা যাবে। সংলাপে আগামী নির্বাচনে আসনসীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইন সংস্কার, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন দল নিবন্ধন করা, ভোটকেন্দ্রে ইসির ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভোট গ্রহণে প্রশিক্ষণ এবং নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা হবে। ইসির রোডম্যাপে গুরুত্ব পাওয়া সাতটি বিষয় হলোÑ সব রাজনৈতিক দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার কার্যক্রম সহসাই শুরু হবে এবং আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তা শেষ হবে। ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ, ২০১৮ জুন থেকে ভোট গ্রহণের আগ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং আগামী অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও নতুন দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে কার্যক্রম গ্রহণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কাজগুলো অবশ্যই প্রয়োজনীয় কিন্তু তা যেন শুধু কেতাবে সীমিত না থাকে।
এ লেখা এভাবে শেষ করতে চাই, মন্ত্রী মহোদয়ের যে ইঙ্গিতের কথা প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার এই উক্তি করার মধ্য দিয়ে তিনি সবাইকে সতর্ক করেছেন বটে; কিন্তু এতটুকুতে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আর আওয়ামী লীগ দেশের একটি বড় দল। তাই তার পক্ষে অনেক কিছু জানার এবং করার সুযোগ ও ক্ষমতা রয়েছে। তাকে এবং তার দলকে খোঁজ রাখতে হবে, দুষ্টচক্র কোন পথ দিয়ে প্রবেশ করে পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করতে আসে। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তাদের এ ক্ষমতা রয়েছে; তারাই পারেন দুর্বৃত্তদের প্রবেশের ছিদ্র পথগুলো বন্ধ করে দিতে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবেÑ তাদের ভুল ভূমিকা ও কার্যক্রমের দ্বারা কখনো যাতে এমন কোনো সুযোগ তৈরি না হয়, যাকে কাজে লাগিয়ে এসব দুষ্টচক্র তৎপর হতে পারে। দেশবাসী একটি বহু আকাক্সিত স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতীক্ষায়। এই নির্বাচনে কোনো বিঘœ যাতে না ঘটে, এই সময়ে বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার ব্যাপার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। এই নির্বাচনকে সফল করার দায়িত্ব সরকারের অনেক বেশি। দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে আশা নয়, হতাশা ব্যাপক। এ দেশের মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারে না। তাই নির্বাচনে কোনো ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠীর বিজয় না হয়ে জনগণ ও গণতন্ত্রের বিজয় হোক। এই পথযাত্রায় আর যেন কোনো কালো মেঘ পরিচ্ছন্ন রাজনীতির আকাশকে আচ্ছন্ন করতে না পারে, সম্মুখে চলার পথকে অন্ধকারে ঢেকে না দিতে পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/236388