২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৫৭

আবারো হতাশায় ডুবল শিক্ষার্থীরা

ফল বিপর্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন

একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় গণহারে পাস ও জিপিএ ৫ পাওয়ার পর এখন শুরু হয়েছে গণফেল ও জিপিএ ৫ ধস নামার পালা। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল প্রায় ৮০ ভাগ। এবার পাসের হার নেমে এল ৬৮ দশমিক ৯১ ভাগে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও নেমে এসেছে অর্ধেকে। ২০১৪ সালে যেখানে জিপিএ ৫ পায় ৭০ হাজার শিক্ষার্থী, এবার সেখানে নেমে এসেছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জনে। অপর দিকে এবার কুমিল্লা বোর্ডে ঘটেছে গণফেলের ঘটনা। পরীক্ষায় অংশ নেয়া অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে এ বোর্ডে। জিপিএ ৫ পেয়েছে মাত্র ৬৭৮ জন।
পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়া মানেই পাস। আর পরীক্ষার হলে বসে মনে যা আসে ধরনের কিছু একটা লিখলেই খাতা ভর্তি নম্বর, ঝুরি ঝুরি জিপিএ ৫ এটাই ছিল গত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত সত্য। কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় এমন সব শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে যা নিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে তার পরিচিত পরিমণ্ডলেও। বেরিয়ে এসেছে জিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনে নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। অবশেষে গোটা জিপিএ ৫ বিষয়টিই একটা তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়। তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়ে পড়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোও। যেখানে পরীক্ষা মানেই গণহারে পাস আর অনায়াসে জিপিএ ৫ পাওয়া সেখানে এবার এভাবে পাসের হার কমা এবং জিপিএ ৫ ধস নামায় হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের মধ্যে। একজন অভিভাবক গভীর দুঃখ বুকে চেপে বললেন, সবার আশা ছিল ছেলেটা জিপিএ ৫ পাবে। কিন্তু হলো না। আগের পরীক্ষাগুলোয় তার তুলনায় কত অগা মগারা জিপিএ ৫ পেল। কিন্তু আমার ছেলেটা তাদের তুলনায় অনেক ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পেল না। ফলের কথা কাউকে বলতে পারছি না।
এমনিতর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী আর অভিভাবক। কাক্সিক্ষত ফল না হওয়ায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ আর হতাশা।
তাদের অভিযোগ আগের পরীক্ষাগুলোতে ওভাবে হাতখুলে নম্বর দিয়ে গণহারে পাস আর জিপিএ ৫ দেয়ার কী দরকার ছিল আর হঠাৎ করে এখনই বা তাদের বেলায় এসে এভাবে এত কড়াকড়ি করা হলো কেন। অনেকে বলেছেন, আমাদের সন্তানদের এ ফলাফল হয়তো সঠিক। কিন্তু আগের পরীক্ষাগুলোতে এভাবে গণপাস আর গণজিপিএ ৫ পাওয়ার ব্যবস্থা না করা হলে আমাদের সন্তানদের এখনকার ফল নিয়ে কোনো দুুুঃখ থাকতো না।
মূলত খাতা মূল্যায়নের নতুনপদ্ধতি প্রয়োগের কারণেই ঘটেছে এবারের ফলাফলের এ চিত্র। তবে সচেতন মহলের মতে একে ফল বিপর্যয় আখ্যায়িত করা ঠিক নয়। কারণ আসলে এটাই সঠিক ফল। এখন সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত মেধাবীরা স্বীকৃতি পাচ্ছে। তাই একে সাধুবাদ জানিয়েছেন তারা। পরীক্ষায় অংশ নিলেই পাস আর যেনতেনভাবে কিছু একটা লিখে খাতা ভরলেই ওজন দরে জিপিএ ৫ পাওয়ার নৈরাজ্যকর চিত্র আমরা আর দেখতে চাই না।
এর মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, অতীতে গণহারে পাস ও গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়ার সময় সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন হয়নি। গত এসএসসি পরীক্ষা এবং সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষামন্ত্রী নিজেই এটা স্বীকার করলেন।
গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় গণপাস আর গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনের যেসব কাহিনী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা শিউরে ওঠার মতো। পরিকল্পিতভাবেই এ নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পরীক্ষকদের হাত খুলে নম্বর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সরাসরি নির্দেশনা, পরীক্ষার হলে শিক্ষক কর্তৃক উত্তর বলে দেয়া, পাসের হার ও জিপিএ ৫ বৃদ্ধির জন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা, শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম লেখানোর জন্য রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের নোংরা প্রতিযোগিতা, প্রশ্ন ফাঁসের নৈরাজ্যসহ নানা ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা বের হয়ে আসতে থাকে গণপাস ও গণজিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনের কাহিনী হিসেবে। পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছিল এর অনেক কিছুই। আর অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এর পরিণতি। ফল হিসেবে শিক্ষার মান এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া নৈরাজ্য নিয়ে সব মহলে তীব্র সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। বের হয়ে পড়ে শিক্ষার মানের ধসের ভয়াবহ চিত্র। অবশেষে এর হ্রাস টানতে বাধ্য হয় সরকার। তবে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ক্ষোভ আর দুঃখ হলো তাদের নিয়েই বছরের পর বছর ধরে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কখনো প্রশ্ন ফাঁসের নৈরাজ্য, কখনো পাঠ্যবই পরিবর্তন, কখনো সিলেবাস পরিবর্তন, কখনো নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি, নতুন ফলাফল পদ্ধতি, নতুন খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি, নতুন শিক্ষা পদ্ধতিÑ এসব প্রয়োগে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরা। ২০০৯ সালের পর থেকে গত সাত বছর ধরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক দিকে হয়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপর দিকে ছড়িয়ে পড়েছে প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য। প্রতিবার প্রতিটি ক্ষেত্রে এসবের খেসারত দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অতীতে গণহারে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির কারণে বারবার ইমেজ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে প্রকৃত মেধাবীরা।
গণপাসের পর গণফেল : ২০১১ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১০টি বোর্ডে পাসের গড় হার ছিল ৭৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। জিপিএ ৫ পায় ৩৯ হাজার ৭৬৯ জন।
২০১২ সালে একই পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৭৮ দশমিক ৬৭। মোট জিপিএ ৫ পায় ৬১ হাজার ১৬২ জন।
২০১৩ সালে গড় পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। জিপিএ ৫ পায় ৫৮ হাজার ১৯৭ জন।
২০১৪ সালে গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। জিপিএ ৫ পায় ৭০ হাজার ৬০২ জন।
২০১৫ সালে গড় পাসের হার ৬৯ দশমিক ৬০ ভাগ। জিপিএ ৪২ হাজার ৮৯৪ জন।
২০১৬ সালে গড় পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ ভাগ। জিপিএ ৫ ৫৮ হাজার ২৭৬ জন।
আর এবার গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৯১ ভাগ। জিপিএ ৫ পায় মাত্র ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন।
হাতখুলে নম্বর দেয়ার পর হাত গুটানোর পালা : আগের বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় হাতখুলে নম্বর দেয়ার যে গুরুতর অভিযোগ ছিল, তা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কথায়ও এবার ফুটে উঠেছে। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পাস ও জিপিএ ৫ কমার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এবারের ফলে তারা বিস্মিত নন। বরং নতুন পদ্ধতিতে সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়েছে, এটাই বিবেচ্য বিষয়। তিনি বলেন, তারা অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, আগে সব পরীক্ষক সঠিকভাবে খাতা দেখতেন না। কেউ কম বা বেশি নম্বর দিতেন। এ জন্য এটাকে অনেকে হাস্যকর করে বলতেন, ওজন করে নম্বর দেয়া হয়। এ জন্যই বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের মাধ্যমে সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী এবার প্রত্যেক পরীক্ষককে একটা নমুনা উত্তরপত্র দেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী খাতায় নম্বর দেন তারা। এ ছাড়া প্রত্যেক পরীক্ষকের ১২ ভাগ খাতা দৈবচয়ন পদ্ধতিতে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখায় পরীক্ষকরা খুবই সতর্কতার সাথে খাতা মূল্যায়ন করতে বাধ্য হন।
খাতা মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী একটি খাতা ২০ জন পরীক্ষক দিয়ে দেখানো হয়। পরে সবাই মিলে একটি আদর্শ উত্তরপত্র চূড়ান্ত করেন। সেটি সব পরীক্ষককে সরবরাহ করা হয় আদর্শ হিসেবে।
হাতখুলে নম্বর দিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় গণহারে পাস আর জিপিএ ৫ পাওয়াসহ ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টির পর এখন হাত গুটানোর পর্ব শুরু হয়েছে। গত মে মাসে প্রকাশিত এসএসসিতে নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নের সর্বাধিক মূল্য দিতে হয়েছে কুমিল্লা বোর্ড ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের। আগের বছর এসএসসিতে কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৪ ভাগ। আর এবার এসে দাঁড়ায় শতকরা ৫৯ ভাগে। অপর দিকে গত রোববার প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায়ও নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নের সর্বাধিক খেসারত দিয়েছে কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এবার এ বোর্ডে পাস করেছে ৪৯ দশমিক ৫৩ ভাগ।
এবার ফল বিপর্যয়ের জন্য যেসব কারণ চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো হলো খাতা মূল্যায়নে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ, ইংরেজিতে খারাপ ফল, কুমিল্লা বোর্ডে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়, সব বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু প্রভৃতি।
অতীতে গণপাসের পেছনের চিত্র : প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় অতীতে গণপাস ও গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়া বিষয়ে পেছনের কারণ হিসেবে নানাবিধ চাঞ্চল্যকর আর ন্যক্কারজনক ঘটনার খবর কয়েক বছর ধরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত এ রকম কয়েকটি তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো।
একজন প্রধান পরীক্ষক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় ১৯ জন শিক্ষার্থীকে ৭৪ করে নম্বর দিয়েছেন। এরপরে তাকে তার উপরস্থ কর্মকর্তা তলব করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি ১৯ জন ছাত্রছাত্রীকে ৮০ করে দিলেন না। পরীক্ষক বিনয়ের সাথে জানান, ৭৪ দেয়া হয়েছে খুব কষ্ট করে। আসলে তারা ৭৪ পাওয়ারই উপযুক্ত ছিল না। তাই আর নম্বর বাড়ানো গেল না। কিন্তু তারপরও তাকে ৮০ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করায় এরপর থেকে ওই পরীক্ষক খাতা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন।
অতীতের নৈরাজ্য বিষয়ে আরেক প্রধান পরীক্ষক জানান, উচ্চ মাধ্যমিকে খাতা বিতরণের আগে তাদেরকে ডেকে বৈঠক করা হয় বোর্ড অফিসে। বৈঠকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের কর্মকর্তারা তাদের সবাইকে একটি করে খাতা দিয়ে তাতে নম্বর দিতে বলেন। পরীক্ষকেরা খাতা মূল্যায়ন করে যার যার মতো করে নম্বর দিয়েছেন। যারা খাতায় কম নম্বর দিয়েছেন তাদের তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে কর্মকর্তারা বলেন, নম্বর কি আপনার বাপের? নম্বর দিতে এত কষ্ট হয় কেন? হাতখুলে নম্বর দিতে হবে। নম্বর বেশি দিতে না পারলে খাতা দেখবে না।
এ সময় একজন পরীক্ষক বলেন, স্যার শিক্ষার্থীরা না লিখলে আমরা কিভাবে নম্বর দেবো খাতায়। আমগাছ লিখতে বলায় যদি বটগাছ লেখে তাহলে নম্বর দেই কী করে। তখন কর্মকর্তারা তাদের ধমকে বলেন, গাছই তো লিখেছে। দেখতে হবে গাছ সম্পর্কে তার ধারণা আছে কি না। গাছ বিষয়টি সে বোঝাতে পেরেছে কি না। আমগাছ না বটগাছ সেটা কোনো বিষয় নয়। গাছ হলেই হলো।
কয়েকজন প্রধান পরীক্ষক জানান, অতীতে খাতা বিতরণের আগে বৈঠকে একটি বোর্ড কর্মকর্তারা বলেন, বোর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের ভালো করতে হবে। বেশি করে নম্বর দিতে হবে। মৌখিক এ নির্দেশের কথা বাইরে কারো কাছে না বলার জন্যও সতর্ক করে দেয়া হয় তাদের। ১৮ বা ২০ পেলে ৩৩ দিয়ে দিতে হবে বলে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়।
আরেকজন পরীক্ষক জানান, মাধ্যমিকপর্যায়ে একটি পাবলিক পরীক্ষার আগে বোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রধান পরীক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, রচনায় ২০-এর মধ্যে ১৯ আর ভাব সম্প্রসারণে ১০-এর মধ্যে ৯ কেন দেয়া যাবে না। ভালো লিখলেও কেন পূর্ণ নম্বর দেয়া হবে না। হাতখুলে নম্বর দিতে হবে বলে তিনি সবাইকে নির্দেশ দেন।
শিক্ষকেরা জানান, কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় খাতা বিতরণের আগে বিভিন্ন বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং অন্যান্য কর্মকর্তা প্রধান পরীক্ষকদের ডেকে যেসব নির্দেশনা দেন তাতে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান।
শিক্ষকেরা জানান, আগে বোর্ড থেকে প্রধান পরীক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হতো হাতখুলে নম্বর দেয়ার জন্য। এরপর প্রধান পরীক্ষকেরা অন্য পরীক্ষকদের এ নির্দেশনার কথা জানিয়ে দেন। পরীক্ষকেরা প্রধান পরীক্ষকদের কাছে এ বিষয়ে আপত্তি জানালে প্রধান পরীক্ষকেরা নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, কিছুই করার নেই। তারাও তাদের মতো বোর্ড কর্মকর্তাদের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন এসব বিষয়ে। কিন্তু তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে এটাই সিদ্ধান্ত। এ কাজে তাদের সহায়তা করতে হবে।
একজন প্রধান পরীক্ষক জানান, একটি পাবলিক পরীক্ষার সময় জেলা প্রশাসক কেন্দ্র সচিবদের সাথে বৈঠকে বলেছেন, নকল হবে না কিন্তু পাস করাতে হবে। কিভাবে করাবেন সেটা আপনাদের বিষয়। এক্সপেলও করা যাবে না। তাহলে কেন্দ্রের দুর্নাম হবে।
শিক্ষক জানান, নকল হবে না, কিন্তু পাস করতে হবে মানে হলো শিক্ষকদের হলের মধ্যে কড়াকড়ি করা যাবে না। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের বলেও দিতে হবে। এবং খাতাও দেখতে হবে উদারভাবে।
অতীতের খাতা মূল্যায়ন বিষয়ে শিক্ষকেরা তখন জানিয়েছিলেন, নম্বর বেশি দিলে কোনো সমস্যা নেই। কম দিলেই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। নম্বর কম দিলে এবং ফেল করলেই ডাক পড়ে পরীক্ষকদের। বকুনি খেতে হয়। তাই ঝামেলা এড়াতে ইচ্ছেমতো নম্বর দিয়ে দেন তারা। সৃজনশীলের নামে ইনিয়েবিনিয়ে যা লিখে তাতেই নম্বর দিতে হয়। শিক্ষকেরা জানান, সত্যিকারভাবে খাতা মূল্যায়ন করলে জিপিএ ৫ তো দূরের কথা, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পাসই করত না।
খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার হলে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষকেরা জানান, নকল সেভাবে হয়নি, কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে উত্তর লিখেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাও তাদের সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন পরীক্ষার হলে শিক্ষকের প্রশ্ন বলে দেয়া, শিক্ষার্থীদের জড়ো হয়ে প্রশ্ন সমাধানের ভিডিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে। তদুপরি ছিল মহামারী আকারে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা।
এভাবে অতীতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় গণপাস আর গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়া বিষয়ে চমকপ্রদ আর ন্যক্কারজনক বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হতে থাকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নেমে আসে ভয়াবহ নৈরাজ্য। গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে ফেলের পর থমকে দাঁড়ায় গোটা জাতি। প্রশ্ন দেখা দেয়Ñ ‘এই শিক্ষা লইয়া আমরা কী করিব।’ অবশেষে সরকার হ্রাস টানতে পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হলো বলেই অনেকে মনে করছেন সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর। সবারই দাবি, সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন হোক তাতে যে ক’জন পাস করে করুক। তবু বন্ধ হোক নৈরাজ্য। বন্ধ হোক ধ্বংসের সর্বনাশা খেলা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238910