সড়কজুড়ে ফেলে রাখা নির্মাণসামগ্রী। সংকুচিত হয়ে পড়েছে যানবাহন চলাচলের পথ। প্রবল বৃষ্টি। হেঁটে চলারও উপায় নেই। অগত্যা ঝুঁকি নিয়েই পারাপার। গতকাল রাজধানীর প্রগতি সরণির চিত্র l ছবি: প্রথম আলো
২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৫১

অচল ঢাকায় অসহায় মানুষ

রাজধানী শহর ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ছে। খোঁড়াখুঁড়ি, কাটাকুটি, নতুন নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতা এবং মৌসুমি বৃষ্টিতে অধিকাংশ রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এসব রাস্তায় চলতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই কাটাতে হচ্ছে নিরুপায় কর্মজীবী মানুষকে।
এই দুর্ভোগ এক দিন, সপ্তাহ বা মাসের নয়। এই অবস্থা চলছে মাসের পর মাস। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ অথবা সরকারের কোনো পর্যায় থেকেই এই দুর্ভোগ নিরসন কিংবা নিদেনপক্ষে কমিয়ে আনার মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে নগরবাসী অসহায়, নিরুপায়।দুর্ভোগ থেকে শিগগিরই মুক্তির কোনো পথ তাদের সামনে খোলা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সাময়িক স্বস্তির কোনো পথ দেখাতে পারছে না।
নগর-গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং অর্থহীন ও উল্টাপাল্টা প্রকল্প গ্রহণের ফলে নগরীর এই অচলাবস্থা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি ইতিমধ্যে খুব খারাপ হয়ে গেছে। ঢাকায় নতুন সমস্যা হিসেবে যুক্ত হয়েছে জনস্বাস্থ্য। এখনকার মতো আর কিছুদিন চলতে থাকলে ঢাকা পুরোপুরি ‘ফেইলড সিটি’ হয়ে যাবে।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সর্বত্র রাস্তা খারাপ। কাটা, খোঁড়া ছাড়া বৃষ্টির কারণেও রাস্তায় ভাঙন ও গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। দুই সিটি করপোরেশনেরই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে নতুন রাস্তা তৈরি। একই সঙ্গে চলছে ফুটপাত ভাঙা-গড়ার কাজ। চলছে নর্দমা তৈরির কাজও। আছে বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতা। ফলে স্বাভাবিক চলাচলের কোনো উপায়ই নেই। বাড়ির বাইরে বের হলে বেহাল রাস্তা ও পরিবহনের বিশৃঙ্খলায় সামনে এগোনো যায় না। আধা ঘণ্টার পথ দুই ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ে। সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ নগরবাসীকে এভাবে নিরুপায় অবস্থায় ফেলেছে। এ থেকে মানুষকে উদ্ধারের কেউ নেই।
গুলশানের একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন বাসাবোর বাসিন্দা সাকিব হোসাইন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে তিনি বৃষ্টি মাথায় করে বাসা থেকে বের হয়ে যখন মালিবাগ আসেন, তখন সেখানে হাঁটুপানি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বাস পাইনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও। পরে একটা বাসে উঠলাম ঠেলাঠেলি করে। বাসের ড্রাইভার পর্যন্ত বলেন, “ভাই রাস্তার অবস্থা ভালো না। শক্ত কইরা ধইরা দাঁড়ান।” বৃষ্টি হলেই এই পরিস্থিতি আমাদের নিত্যসঙ্গী।’
গতকাল বেলা ১১টার দিকে আর কে মিশন রোড থেকে বাবার সঙ্গে রিকশায় করে স্কুলে যাচ্ছিল রাকিব। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সে। রামকৃষ্ণ মিশনের কাছাকাছি আসতেই গর্তে চাকা পড়ে উল্টে যাচ্ছিল রিকশাটি। রিকশা না ওল্টালেও বাবা ভয়ে ছেলেকে নিয়ে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যান। ময়লা পানিতে পড়ে ভিজে যায় রাকিব। তার আর স্কুলে যাওয়া হয় না।
ভুক্তভোগী মানুষের এখন বিশেষ দুশ্চিন্তা হচ্ছে বর্ষাকালটা কীভাবে পার করবে তা নিয়ে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস হচ্ছে কয়েক দিন ধরে চলে আসা বৃষ্টি আরও দু-এক দিন চলবে। এর মধ্যে ঢাকায়ও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া এখন শ্রাবণ মাস। বর্ষা থাকবে আশ্বিনেরও অর্ধেক পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর অবস্থা কী হবে, তাদের দুর্ভোগ শেষ হবে কবে, কীভাবে?
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মতে, নগর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কার্যত অজ্ঞ নীতিনির্ধারক এবং অনভিজ্ঞ নগর ব্যবস্থাপকদের সমন্বয়হীন কাজের ফলে ভুগতে হচ্ছে ঢাকার নগরবাসীকে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাতটি মন্ত্রণালয় ও ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এই নগরীর উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার। এদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। অনেকে সমন্বয় করতেও চান না। কারণ, নিজে নিজে কাজ করলেই তাঁদের সুবিধা বেশি।
ঢাকার উন্নয়নকাজে সমন্বয়হীনতার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন ঢাকা ওয়াসার পরামর্শক এ কে এম শহীদউদ্দিন। তিনি বলেন, পুরোনো ২৭ নম্বর সড়কসহ ধানমন্ডির কিছু এলাকার পানি নিষ্কাশন করে কল্যাণপুর খালে নিয়ে ফেলার জন্য ওয়াসার বাস্তবায়িত একটি প্রকল্প বেশ কার্যকর ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন ওই এলাকায় ‘সারফেস ড্রেন’ করে সেই ব্যবস্থাটি অকার্যকর করে ফেলেছে। ফলে এখন বৃষ্টি হলেই ধানমন্ডি ২৭ নম্বর ও তার আশপাশে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার তৈরি করা পানিনিষ্কাশন-ব্যবস্থা বন্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং সিটি করপোরেশনও জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে। ওই এলাকার জলাবদ্ধতা কমাতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের পূর্ব প্রান্তের মুখ থেকে মিরপুর রোডের পূর্ব পাশ পর্যন্ত পানিনিষ্কাশনের একটি লাইন তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
অন্যান্য দিনের মতো গতকালও নগরীর মিরপুর, এয়ারপোর্ট রোড, বনানী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় তীব্র যানজট দেখা গেছে। রোকেয়া সরণিতে গতকাল প্রায় সারা দিনই ছিল তীব্র যানজট। মিরপুরের অন্যান্য অংশও যানজটে ছিল স্থবির। বিকেলে তীব্র যানজট দেখা গেছে এয়ারপোর্ট রোডের হোটেল র্যাডিসন থেকে দক্ষিণে মহাখালী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে উড়ালসড়কসহ মিরপুরের কালশী পর্যন্ত। মিরপুরে মেট্রোরেল প্রকল্প ও সিটি করপোরেশনের ব্যাপক উন্নয়নকাজ চলছে মাসের পর মাস ধরে। একই জায়গায় একাধিকবার এসব কাজ করা হচ্ছে। এই সমন্বয়হীনতার কারণে কাজগুলো শেষ হয়েও শেষ হয় না।
সমন্বয়হীনতার আরেকটি নজির উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নগর ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে গণপরিবহন। ঢাকার গণপরিবহন একেবারে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে চলে গেছে। এ অবস্থায় উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক একটি সমন্বিত বাস সার্ভিস চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু দক্ষিণের মেয়র বিষয়টি জানেন না। ঢাকার সুষ্ঠু গণপরিবহন শুধু উত্তরের বিষয় নয়। এর সঙ্গে দক্ষিণকেও যুক্ত করতে হবে। গণপরিবহন পুরো মহানগরীর। তা ছাড়া সরকার কয়েক বছর আগে গঠন করেছে ‘ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ)’। এই সংস্থার কাজ কী? এদের কোনো কাজ তো দেখা যায় না।
ঢাকা মহানগরীর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা ও প্রকল্পগুলো ছিল, ২০০৯ সালে সরকার তা অনুমোদন করে। কিন্তু বাস্তবায়নে ঢিলেমি দিয়ে বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলেছে। সরকার এই ঢিলেমি না করলে নগরীর বর্তমান অবস্থা হতো না। নগর ব্যবস্থাপনা এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার (ওয়ার ফুটিং) মতো কাজ করতে হবে।
এ সম্পর্কে নগর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার জন্য যখন যোগাযোগ করা হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন তখন হাতিরঝিলে যানজটে আটকা পড়ে ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টির কারণেই সমস্যা বেশি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে চলে যায়। গাড়িগুলোও নিয়মকানুন মানতে চায় না। ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
ঢাকা দক্ষিণে ফ্লাইওভারের কারণে মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় রাস্তার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা, পয়োনিষ্কাশন লাইন ও নর্দমার কাজ চলছে। উমেশ দত্ত রোড, হোসেনি দালান ও নাজিম উদ্দিন রোডে রয়েছে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা। এই সমস্যা নিরসনে কাজ শুরুর প্রক্রিয়া চলমান আছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সড়ক ও ট্রাফিক অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন বাবদ ৭০১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। এর মধ্যে এসেছে বৃষ্টি। সে কারণে নগরবাসীর দুর্ভোগ হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ করে দুর্ভোগ নিরসনের চেষ্টা করছি।’
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটিতে এ বছরই প্রায় ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এ ছাড়া সড়ক, নালা ও ফুটপাতের দৈনন্দিন মেরামতের জন্য বরাদ্দ আছে ১৮০ কোটি টাকা। তারপরও দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাটে মানুষের দুর্ভোগ তো কমছেই না, বরং বাড়ছে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1265866/