২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৪৩

ভারি বর্ষণ আর ভাঙনে বিপর্যস্ত জনজীবন

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে গত ক’দিনের অবিরাম ভারি বর্ষণে বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফসলাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ ও সামুদ্রিক জোয়ারে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্তৃক নির্মিত বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন গ্রাম পানির নিচে রয়েছে। অনেক বাঁধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছে গ্রামবাসী। বিভিন্ন এসব ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে কবরস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধানি জমি, বসতবাড়ি, মসজিদ ও মন্দির। পানি জমে থাকার কারণে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত রোগ। বন্যা ও ভাঙন কবলিত মানুষ খাদ্য ও আশ্রয় সঙ্কটে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দেশে চলমান বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যের আলোকে রিপোর্ট-

জাকের উল্লাহ চকোরী, কক্সবাজার থেকে জানান, গত ৪ দিনের অবিরাম বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢ়ল ও আমাবস্যার জোয়ারে কক্সবাজার জেলার ৮উপজেলার ৭১টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার নদী, ছড়াখাল ও সমুদ্র তীরবর্তি এলাকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবান্দি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মাতামুহুরী নদীতে বিপদসীমার ৪৫ সে. মিটার উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। জেলার মাতামুহুরী, হারবাং ছড়া, বাইশ্যারছড়া, পাগলিরবিল, খুটাখালী ছড়া, ঈদগাও খাল, বাকঁখালী নদী, রেজু খাল ও নাফ নদীর দু-তীরে পানি সয়লাব হয়ে যাওয়ায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বসবাসরত ১০লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর দিনাতিপাত করছে। অপর দিকে আমাবস্যার জোয়ারের পানিতে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার নিচু এলাকায় ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের অথৈ পানিতে এলাকাকার হয়ে গেছে। নদীর ভাঙ্গনে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, দোকান পাট ও গ্রামীণ অবকাঠামো গুলো নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কক্সবাজারের নদী ও সমুদ্র উপকুলে বসবাসরত মানুষের জানমাল রক্ষায় গত অর্থ বছরে এডিপি, এনডিআর ও ইমাজেন্সী খাতে বাধঁ মেরামত প্রটেক্টটিভ ওয়ার্ক ও বিধস্ত বেড়িবাধঁ সংস্কার ও পুন:নির্মাণসহ এবং রেগুলেটর নির্মাণের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ২৭৬ কোটি টাকার বরাদ্ধ দেয়। এ অর্থ শুধুমাত্র পেকুয়া উপজেলার পোল্ডার নং ৬৪/২বি অধীনে পাউবোর বান্দরবান বিভাগের পেকুয়া সেকশনের অধীনে ১০টি প্যাকেজের আওতায় ৭৫ কোটি টাকার বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই ১০ প্যাকেজের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারদেরকে ৩০ কোটি টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ওইসব বাধঁ ভেঙ্গে জোয়ারের পানিতে মগনামা ও উজানটিয়া এলাকা সমুহে অথৈ পানিতে ডুবে গেছে হাজার হাজার বাড়িঘর। অপরদিকে চকরিয়া উপজেলার ৬৫নং পোল্ডারের অধীনে কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম ও কুরুল্ল্যাকুম এলাকায় বাধঁ সংস্কার ও মেরামতের জন্য এডিপি প্রকল্পের আওতায় ৩ টি প্যাকেজের অধীনে ও এনডিআর ও ইমার্জেন্সীসহ ৪ টি প্যাকেজের অধীনে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারদের কাজ সম্পাদনের বিলম্ব, অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় বিধ্বস বেড়িবাধঁ দিয়ে জোয়ার ও বন্যার পানি ঢুকে চকরিয়ার উপকুলীয় ইউনিয়ন ও সাহারবিল ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম বর্তমানে বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে পড়েছে।
এদিকে চকরিয়া পৌরশহরের ১নং গাইড বাধঁ ও শহর রক্ষা বাধঁ মাতামুহুরী নদীর ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য ১টি প্যাকেজের অধীনে সিসি বøক বসানোর জন্যে ৩ কোটি ৫০লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ওই স্থানে ভাঙন সম্ভব হলেও এর পশ্চিম পাশের ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করায় যে কোন মুহুর্তে ওই বাধঁ ভেঙে ফাসিঁয়াখালী ইউনিয়নের আংশিক এলাকাসহ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড বিলিন হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। অন্যদিকে মাতামুহুরী নদীর ডানতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরাজপুর-মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্ধ দিলেও এ বাধঁ দিয়ে বন্যার পানি ঠেকানো যাচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীতে তীব্র বেগে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে কাকারা ইউনিয়নের চিরিঙ্গা-কাকারা-মাঝেরফাঁড়ি সড়কের প্রপার কাকারা পয়েন্টে সড়কের বিশাল অংশ তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। দিগরপানখালী সড়ক কাম বেড়িবাঁধটি যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গেল বন্যায় ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পাগলির বিলস্থ ছড়াখালের ভেঙে যাওয়া বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিএমচর ইউনিয়নের কুরুইল্যারকুম পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। বরইতলী ইউনিয়নের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে অনেক পরিবার বাড়িভিটে ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। একইভাবে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, ডুলাহাজারা, সাহারবিলসহ ১৭ ইউনিয়ন এবং পৌরসভার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ বানের পানিতে ভাসছে।
কলারোয়ায় ৫ হাজার বিঘা জমি পানির নীচে
কলারোয়া (সাতক্ষীরা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ৭ দিনের বৃষ্টিতে কলারোয়ার নি¤œাঞ্চলে রপ্রায় ৫০ বিলের প্রায় ৫ হাজার বিঘা জমি পানির নীচে তলিয়ে গেছে। পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে রাস্তা, ঘাট, ঘরবাড়ি ও মাছের ঘের নির্মাণ করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ঘন মেঘাচ্ছন্ন আকাশে গতকাল মঙ্গলবার শেষ রাত পর্যন্ত অবিরাম বৃষ্টিপাত চলে। কখনো মুসল ধারে কখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকে। কলারোয়ার জনজীবন একেবারে বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে। তবে বৃষ্টিপাতের সপ্তম দিনে গতকাল মঙ্গলবার শেষ রাতের পর সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা বিরাম দিয়ে পুনরায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে বিকাল ৫টায় এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই ৭ দিনের বৃষ্টিতে কলারোয়ার ১২ ইউনিয়নসহ পৌর এলাকার ৫০ বিলের প্রায় ৫ হাজার বিঘা জমি পানির নীচে তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে প্রায় ১ হাজার বিঘা জমির আমন ধানএবংশতাধিক বিঘার আমন ধানের বীজতলা পানির নীচেতলিয়ে গেছে। চাষীরা জানায়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে মাছের ঘের তৈরি করায় পানি খালে বা নদীতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে জনপদের পানি বিল খাল হয়ে নদীতে প্রবেশ করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতে কলারোয়ার কপোতাক্ষ তীরবর্তী দেয়াড়া, জয়নগর, জালালাবাদ এবং বেত্রাবতী নদী তীরবর্তী কলারোয়া পৌর এলাকা এবং কয়লা ইউনিয়নের শতশত ঘরবাড়ির আঙ্গিনায় পানি প্রবেশ করেছে।
সাতকানিয়ায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি
সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সাতকানিয়ায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক বসতঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। কেরানীহাট-বান্দরবান ও সাতকানিয়া-বাঁশখালী সড়কের কয়েকটি স্থান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সাথে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো পানির নিচে ডুবে গেছে। শঙ্খ ও ডলু নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি শঙ্খ নদীর ভাঙন ও ভয়াবহরূপ নিয়েছে। গত সোমবার শঙ্খের ভাঙনে ১৩টি বসত ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সরেজমিন পরিদর্শন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত, শঙ্খ, ডলু নদী ও হাঙর খাল দিয়ে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্ল¬াবিত হয়েছে। বিশেষ করে বাজালিয়া, কেঁওচিয়া, ধর্মপুর, কালিয়াইশ, ছদাহা, আমিলাইষ, চরতি, নলুয়া, ঢেমশা, খাগরিয়া ও সাতকানিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
শ্যামনগরের কাশিমাড়ীতে বেঁড়ীবাধে ভয়াবহ ভাঙ্গন
সাতক্ষীরা জেলা সংবাদদাতা জানান, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ীতে পাউবোর বেড়ীবাঁধে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। গতকাল সকালে ভাঙ্গনকৃত এলাকা পরিদর্শন করেছেন, এস এম জগলুল হায়দার এমপি। এলাকাবাসী স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে সংস্কারের কাজ করছেন। আতঙ্কে রয়েছেন ১৫ গ্রামের মানুষ। গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের ও খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের ফলে ঝাপালী সংলগ্ন মোমিন নগরের আনুমানিক৪০০ ফুট দীর্ঘ বেড়ীবাঁধে এই ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় বেড়ীবাধ ভেঙ্গে উপজেলার কাশিমাড়ী, আটুলিয়াসহ কালিগঞ্জের কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হতে পারে। এতে ক্ষতি হতে পারে হাজার হাজার কোটি টাকার। ইতোমধ্যে স্থাণীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কিছু কিছু জায়গায়বাঁধের ভাঙ্গন মেরামত করা হলেও রাত পোহালেই নতুন নতুন ভাঙ্গনের সৃষ্টি হচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে বিষয়টি আমলে নিয়ে স্থায়ী বাঁধ সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পাউবো কর্তৃপক্ষের হতক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসি।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/89058/