২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৪২

টুকুর দুর্নীতির ফাইল গায়েব

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে শামসুল হক টুকুর অবৈধভাবে বিপুল অর্থবিত্ত অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) শুরু হয়েও হতে পারেনি। কারণ, ফাইল 'হারিয়ে গেছে'!

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনা-১ আসনের এই সংসদ সদস্যকে দুর্নীতির তদন্ত থেকে রেহাই দিতে তার বিরুদ্ধে পেশ করা অভিযোগের ফাইলটি গায়েব করা হয়েছে। সাড়ে তিন বছর আগে নামে-বেনামে মোট ১৬১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছিল দুদকে। টুকুর নেপথ্য তদবিরে কমিশনের তৎকালীন শীর্ষস্তরের ব্যক্তিদের কেউ কৌশলে ফাইলটি গায়েব করেন।

দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতির কোনো অভিযোগই তামাদি হয় না। টুকুর বিরুদ্ধে অভিযোগটিও তামাদি হয়নি। কোনোভাবে টুকুর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পাওয়া গেলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের শুরুতে দুদকের তৎকালীন কমিশনার (অনুসন্ধান) অভিযোগটি আমলে নিয়েছিলেন। এরপর বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ থেকে এক আদেশ জারি করে উপপরিচালক নাসিরউদ্দিনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছিল। ওই আদেশের কপিটি নাসিরউদ্দিনকে দেওয়ার আগে টুকুর প্রতি সহানুভূতিশীল কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির নজরে আসে। বিস্ময়করভাবে তিনি তৎক্ষণাৎ দুর্নীতির অভিযোগের ফাইলটি হস্তগত করেন এবং পরে অফিস থেকে বাইরে নিয়ে যান। ওই ফাইল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আর আনা হয়নি। এভাবেই সেটি গায়েব হয়ে যায়। দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি অভিযোগ এসেছিল। কী কারণে অভিযোগটি অনুসন্ধান করা হয়নি, এটি বর্তমানে কোথায়, কীভাবে আছে_ বিষয়টি তার জানা নেই বলে জানান।

অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য নিযুক্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক নাসিরউদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাকে অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, এটা জেনেছিলাম। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো আদেশের কপি আমাকে দেওয়া হয়নি।'

শামসুল হক টুকুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'অভিযোগটি বহু আগে তদন্ত হয়েছে, সব হয়েছে। এটা দুদকের বিষয়।'

তার বিরুদ্ধে ১৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন। মিথ্যা অভিযোগ যে কেউ যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে করতে পারে।'

সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বড় ছেলে ভিওআইপি ব্যবসা করে ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে

বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।'

হারিয়ে যাওয়া ফাইলের অভিযোগগুলো সম্পর্কে সমকাল অবহিত হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৪ সালের শুরুতে টুকুর নামে-বেনামে ১৬১ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল দুদকে। অভিযোগের কপিতে অভিযোগকারীর নাম নেই। দুদক আইন অনুযায়ী নামে-বেনামে পাওয়া যে কোনো অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কমিশন।

২০১৪ সালে 'বিজনেস এশিয়া' ম্যাগাজিনে প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের লাইফস্টাইল নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টটি আমলে নিয়ে ওই ধনকুবেরের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করেছিল কমিশন। এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে নয়, অভিযোগের তথ্য-প্রমাণকে মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

টুকুর বিরুদ্ধে দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়েছিল, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর টুকুকে প্রথমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বছরখানেক পর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চার বছরে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।

আওয়ামী লীগ পাবনা জেলা কমিটির সদস্য শামসুল হক টুকু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পাবনা-১ (বেড়া-সাঁথিয়া) আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হলেও এবার তাকে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

অভিযোগে আরও বলা হয়, চার বছর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে নামে-বেনামে তিনি ১৫ কোটি পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় নামে-বেনামে ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদ উল্লেখ করেছিলেন। ২০১৩ সালের হলফনামায় উল্লেখ করা হয় চার কোটি ৮৪ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকার সম্পদ। আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে অথচ হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি, তার নামে এমন সম্পদ ৮২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার। তার হলফনামা ও আয়কর নথিতে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সম্পদ গোপন করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়, ভিশনটেল কোম্পানির চেয়ারম্যান টুকুর বড় ছেলে এস এম আসিফ সামস ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) ব্যবসা করে নবায়ন ফি ও লাইন রেন্ট ফাঁকি দিয়ে ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অর্জন করেছেন। এই হিসাব অনুযায়ী টুকু ও তার বড় ছেলের নামে মোট সম্পদ ১৬১ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৫১১ টাকার, যার কোনো বৈধ উৎস নেই।

দুদকের কাছে দেওয়া অভিযোগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে প্রভাব খাটিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পদে নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের কথা বলা হয়।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, টুকুর ২০১৩ সালের হলফনামায় পাবনা সদরের দিলালপুর মৌজায় ১০ কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়িটি পাঁচতলা পর্যন্ত সম্প্রসারণের কথা বলা আছে। হলফনামায় বাড়িটির মূল্য ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হলেও এর প্রকৃত মূল্য দেড় কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে এক কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা তিনি গোপন করেছেন। বেড়া উপজেলার বৃশালিখায় তার বসতভিটায় প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বিলাসবহুল দোতলা প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেছেন। প্রতি তলার আয়তন তিন হাজার ৯২৫ বর্গফুট। এর নির্মাণে ব্যয় এক কোটি ৯৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে হলফনামায় গোপন করা হয়েছে এক কোটি ৭১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোলার আই লিমিটেডের পরিচালক ও মেসার্স গ্রিন টেকনোলজির মালিক হিসেবে টুকুর ছোট ছেলে এস এম নাসিফ সামসের আয়কর বিবরণীতে মোট ৮২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে। হলফনামায় এই ছেলের নামে কোনো সম্পদ উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া নাফিস সামস পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার পায়না ও তেঘরি মৌজায় ৪০ বিঘা জমি এক কোটি ৮০ হাজার টাকায় ক্রয় করে জমি উন্নয়নে আরও এক কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ করেছেন। মোট তিন কোটি টাকার খরচের হিসাব তার আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। টুকুর হলফনামায়ও এ হিসাব গোপন করা হয়েছে।

টুকুর বড় ছেলের স্ত্রী মুসলিমা খাতুন এএম এন্টারপ্রাইজের মালিক হিসেবে তার আয়কর বিবরণীতে এক কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা দেখিয়েছেন। টুকুর ২০০৮ সালের হলফনামায় মুসলিমা খাতুনের কোনো সম্পদ উল্লেখ ছিল না।

 

http://bangla.samakal.net/2017/07/26/311400