২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৭

বন্যায় ভাসছে এশিয়া

ঝুঁকিতে ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ * এ অঞ্চলে বন্যার জন্য গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও ইয়াংসিকিয়াং নদী দায়ী * ১৯৫০ সাল থেকে বন্যায় চীন, ভারত ও বাংলাদেশে মারা গেছে ২২ লাখ মানুষ

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ যখন আঘাত হানে তখন পাঁচ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। জুনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে দুই মেয়েসহ আশ্রয় নেন ২৮ বছর বয়সী খোরশেদা খাতুন। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের কর্মীদের তিনি জানান, ‘আরও অনেকের মতো ঘূর্ণিঝড়ে তার বাড়িঘর বিনষ্ট হয়েছে। ঘরের পলিথিনের ছাউনি উড়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল তলিয়ে গেছে। কিছু না নিয়েই এখানে চলে এসেছি আমি।’ এর কয়েক সপ্তাহ পর দক্ষিণ চীনের হিমালয় এলাকার এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে বন্যার কারণে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়। এ বছর চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ঝিয়াংঝি প্রদেশে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ কোটি ডলার। এর পাশের প্রদেশ হুনানে ৫৩ হাজার ঘরবাড়ি বিনষ্ট হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার এসব উন্নয়নশীল দেশের লাখ লাখ মানুষকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলেছে।


অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সাইন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিএসআইআরও) আবহাওয়া বিজ্ঞানী দেইয়ি কিরোনো বলেন, আগামী ৩০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ এশিয়া ইতিমধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বিশ্বের অন্যতম বর্ষামুখর অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। বছরে এ অঞ্চলে গড়ে এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ২০১২ সালের এক পরিসংখ্যান বলছে, প্রবল বৃষ্টিপাতজনিত আকস্মিক বন্যায় ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের উপকূল অঞ্চলে ১৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত এলাকার আরও বহু বেশি মানুষ এ ধরনের বিপদের মুখে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বন্যাকবলিত এসব দেশের মানুষ গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আসছে, এতে ব্যাপক অপরিকল্পিত শহরায়নে নিষ্কাশন ব্যবস্থা অনুন্নত হয়ে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভিজির্টি ফেলো এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর ন্যাচারের (ডব্লিউডব্লিউএফ) উপদেষ্টা পল সায়ারস বলেন, ‘একসময়ের সবুজ মাঠ এখন জনবসতিতে পরিণত হয়েছে। নগরে যথাযথ নালা ব্যবস্থা থাকতে হবে। এমনটা না হলে বৃষ্টি বা বন্যার পানি সরে যেতে পারবে না।’

মৃত্যু জনপদে পরিণত : ১৯৫০ সাল থেকে বন্যাজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী যতজন মারা গেছে চীন, ভারত ও বাংলাদেশ- এই তিন দেশেই তার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি ক্যাথলিক ডি লুভেইনের জরিপ বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে ওই তিন দেশেই বিশ্বের সর্বাধিক ২২ লাখ মানুষ বন্যার কারণে মারা গেছে। আহতের সংখ্যা আরও বেশি। ওই জরিপ বলছে, ১৯৫৯ সালের চীনে বন্যায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। বৈশ্বিক জলবায়ুবিষয়ক ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল আইপিসিসি বলছে, বিশ্বে বন্যায় এশিয়ায় সর্বাধিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। অনেক শহর মৃত জনপদে পরিণত হচ্ছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে চীনে ৯০ জন নিখোঁজ বা নিহত হয়েছেন।

বন্যায় প্লাবিত হওয়ার কারণ : দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য হিমালয় থেকে আসা তিনটি নদীই দায়ী। সেগুলো : গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও ইয়াংসিকিয়াং। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৫০ কোটি বা ৫০ শতাংশ এবং চীনের ২৫ শতাংশ বা ৩০ কোটি মানুষ এ তিন নদীর বন্যাকবলিত অববাহিকায় বাস করছে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ। শুধু চীনের ইয়াংসিকিয়াং অববাহিকার সমভূমি, যেখানে সহজেই নদীর পানি গড়িয়ে যায় সে এলাকার উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ দেশটির জিডিপির ৪০ শতাংশের সমান। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক জানায়, এশিয়ার অধিকাংশ বড় শহর যেসব নদীর অববাহিকায় রয়েছে, বন্যা হলে তা সহজেই প্লাবিত হয়। পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক উপায় বিনষ্ট হওয়াই এর প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাংকের নগর বিশেষজ্ঞ আবহাস জাহ বলেন, এসব শহরে চাহিদা অনুসারে পয়ঃনিষ্কাশন খাতে টেকসই বিনিয়োগ হয় না। চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং যখন ১৯৭৬ সালে মারা যান তখন দেশটির ১৭ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করলেও এখন বাস করছে ৫৬ ভাগ। বিশ্বব্যাংকের আরেক হিসাবে, ভারতে ৩৩ ভাগ মানুষ শহরে বাস করছে। বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার খাল, বিল ও খোলা মাঠ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর তা এখন বন্যায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন।

ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন : আবহাস বলেন, পাঁচ বছর আগে মুম্বাই, সাংহাই, হ্যানয়, বেইজিং, নমপেনসহ এশিয়ার প্রধান শহরগুলোয় যে বন্যা হতো, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি বন্যা হচ্ছে, উষ্ণতা বেড়েছে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সিএসআইআরও’র বিজ্ঞানী কিরোনো বলেন, বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এক ঘণ্টা বা এক দিনের বৃষ্টি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বৃষ্টিই বন্যার একমাত্র কারণ না হলেও তা শহরগুলোর অচল ও ভূগর্ভে ভঙ্গুর নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘শহরে নাগরিকদের পানি থেকে দূরে রাখা বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য যথাযথ পরিকাঠামো তৈরির বিকল্প নেই। রোগ সম্পর্কে পূর্বাভাস ও সবুজায়ন প্রকল্পকে অন্যতম সহায়ক বিনিয়োগ মনে করা হচ্ছে। রোগ পূর্বাভাসে এক ডলার ব্যয় করলে তা রোগাক্রান্ত হওয়ার পর আট ডলার খরচকে বাঁচাতে পারে।’ ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, রেল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মেরামত করতে ২৬০ কোটি ডলার প্রয়োজন পড়ে। চীন ‘স্পঞ্জি সিটি’ প্রকল্পে বৃষ্টির পানি ধরে যথাযথ ব্যবহারে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জেসিকা ল্যামন্ড মনে করেন, ‘শহরে পানি মোকাবেলা কোনো আদর্শ উপায় হতে পারে না। শহর সেখানেই গড়ে তোলা উচিত যেখান থেকে পানি সহজে গড়িয়ে অন্যত্র যেতে পারে।’

 

http://www.jugantor.com/ten-horizon/2017/07/26/142981/