২৬ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১১:৩৫

হ্যালো মিস্টার, পোড়া মবিলের খবর পেয়েছেন?

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সোশাল মিডিয়ায় ‘ফাটা কেষ্ট’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল। আর তিনিও বারবার বলছিলেন, আমাকে ফাটা কেষ্ট বলবেন না। আমার মনে হয়, এতে তিনি ভারী কষ্ট পেয়েছিলেন। ফাটা কেষ্ট ভারতের এক হিন্দি সিনেমার নায়ক। বস্তুত তিনি একজন গুণ্ডা। তার শখ ছিল তিনি একদিনের জন্য দেশের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে পুরো খোল-নলচে বদলে দেবেন। দূর করে দেবেন সকল অনিয়ম আর দুর্নীতি। শাস্তি দেবেন সকল অসৎ লোককে। তারপর তিনি সত্যি সত্যি ‘এক দিনের মন্ত্রী’ হয়ে গেলেন। আর যায় কোথায়? ফাটা কেষ্ট এরে মারেন, তারে ধরেন। তারে শাস্তি দেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা বসে থাকে না। তারা চিন্তা করতে থাকেন, কখন ফাটা কেষ্ট’র একদিনের বাদশাহী শেষ হবে আর তার টুঁটি চেপে ধরবেন। ওবায়দুল কাদের যখন ফাটা কেষ্ট নামে বহুল পরিচিতি লাভ করেন, তখনও আমার জানা ছিল না, ফাটা কেষ্ট মানে কী।
কিন্তু রাস্তাঘাটে ওবায়দুল কাদেরকে যা করতে দেখলাম, সে এক ভয়াবহ কান্ড। তিনি বাস ড্রাইভারকে থাপ্পড় মারেন, সিএনজি চালককে কান ধরে উঠ-বস করান। একে মারেন, তাকে ধরেন। যখন তখন যার তার চাকরি খান, সাসপেন্ড করে দেন। সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। টেলিভিশনে সগৌরবে এসব কান্ডকারখানার ভিডিও প্রচার করা হয়। মার তো মার, শেষ পর্যন্ত তিনি এক এমপির গালেও থাপ্পড় মারেন। ঐ এমপির অবশ্য তাতে তার কোনো অসম্মান হয়নি বলে জানিয়েছেন। কারণ এই সংসদ জনপ্রতিনিধিত্বশীল নয়। এই সংসদের কোনো সদস্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন আসলে কোনো নির্বাচনই ছিল না। সে নির্বাচনে ৫ শতাংশ মানুষও ভোট দেননি। ভোটকেন্দ্রে আলস্যে ঘুমিয়েছে কুকুর। মানুষের পদধ্বনি সেখানে ছিল না। এমন ভোটের এমপির গালে থাপ্পড় মারলে তার অসম্মান হবে কেন?
তবে ফাটা কেষ্ট বিষয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। একে ওকে জিজ্ঞেস করি, এই ফাটা কেষ্ট কী? তারা বলেন, এটা একটা হিন্দি সিনেমা। এর নায়ক অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করেন। একে মারেন, তাকে ধরেন। এক দিনের মন্ত্রী ছিলেন তিনি। এই এক দিনে তিনি সব অনিয়ম দুর্নীতি দূর করতে চেয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদের যখন বলতে শুরু করলেন যে, তাকে যেন ফাটা কেষ্ট না বলা হয়। তিনি ফাটা কেষ্ট নন। তখন আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল। আমি অনেক সময় ব্যয় করে ইউটিউবে গিয়ে ফাটা কেষ্ট সিনেমাটা দেখলাম এবং বিষয়টা জানলাম।
ওবায়দুল কাদের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী। সারা দেশের সড়কের দায়-দায়িত্ব নিশ্চয়ই তার ওপর বর্তায়। কিন্তু এই সড়ক নিয়ে তার কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তিনি বেশি বেশি কথা বলেন। আর যতো কথা বলেন, তার প্রায় শতাংশই বিএনপির বিরুদ্ধে। তবে আরও একটা বিষয় তিনি বারবার বলছেন, তা হলো, আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা হারায়, তাহলে আওয়ামী লীগাররা যে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, তা রক্ষা করতে বা ভোগ করতে পারবেন না। টাকা-পয়সা নিয়ে বিদেশে পালাতে হবে। এই টাকা-পয়সা কোনো সৎ পথে উপার্জিত হয়নি। সৎ পথে উপার্জিত হলে এই টাকা পয়সা নিয়ে পালাতে হবে কেন? বুক ফুলিয়ে বলবেন, এই টাকা আমি সৎ পথে উপার্জন করেছি। এর জন্য যথাযথ আয়কর দিয়েছি। তা হলে তো ভয়ের কিছু নেই। পালাবেন কেন? জনাব কাদের জানেন, এর সবই দুর্নীতির পয়সা।
এর অনেক প্রমাণ আছে। সর্বশেষ প্রমাণ লালমণিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার সড়ক নির্মাণ কাজের গুণগত মানে। সেখানে বিটুমিনের পরিবর্তে পোড়া মবিল দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করার পাঁচ দিনের মাথায় কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে। এলাকাবাসী এই জালিয়াতির প্রতিবাদ করায় তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার থানায় একটি চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেছেন। এ রকম অভিযোগ পেয়ে কাজ দেখার জন্য সরেজমিন পরিদর্শনে যান লালমণিরহাট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী। তিনি ঘটনার সত্যতা পান। তখন স্থানীয় লোকজন ঠিকাদারকে তাড়া করলে ঠিকাদার পালিয়ে যান। উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে জানা যায়, সেখানকার কমলাবাড়ি ইউনিয়নের এক কিলোমিটার রাস্তা পাকা করার জন্য ৫৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকেন উপজেলা প্রকৌশল অধিদফতর। যিনি কাজটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন, তিনি আবার তা একজন স্থানীয় ঠিকাদারের কাছে হস্তান্তর করেন। অভিযোগ হলো, স্থানীয় ঠিকাদার উপজেলা প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে বিটুমিনের পরিবর্তে পোড়া মবিল দিয়ে রাস্তার কার্পেটিংয়ের কাজ শেষ করেন। প্রথম থেকেই স্থানীয় লোকজন কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কেউই কর্ণপাত করেননি। এখন ধরা পড়লে আদিতমারি উপজেলা প্রকৌশলী ফজলুল হক বলেন, ‘কাজের মান একটু নিম্ন হয়েছে। কি আর করার। ঠিক করে দেবে ঠিকাদার।’ লালমণিরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জাকিউর রহমান বলেন, রাস্তায় বিটুমিনের পরিমাণ কম দেওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তিনি দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন।
এ রিপোর্ট পড়ে বোঝা যায়, সড়ক কার্পেটিংয়ের দুর্নীতির সঙ্গে প্রায় সব স্তরের কর্মকর্তাই জড়িত আছেন। শেষ পর্যন্ত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন আশা এখন আর কেউ করে না। ওবায়দুল কাদের সাহেব বাস চালকদের রাস্তায় কান ধরে উঠ-বস করান, এমন দৃশ্য আমরা সকলেই দেখেছি। কিন্তু কোনো ঠগবাজ ঠিকাদারকে রাস্তায় তৎক্ষণাৎ সাজা দিতে তাকে দেখিনি। বাস চালক বা অটো চালকরা দরিদ্র নিরীহ মানুষ। তাদের কোনো দল নেই। তারা দিন আনে দিন খায়। ফলে তাদের কান ধরা খুব সহজ। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের যে সাগরেদরা পুকুর থেকে সাগর পর্যন্ত চুরি করছে, লুট করছে, তাদের টিকিটি ছোঁবার সাহস বা ইচ্ছা ওবায়দুল কাদেরের নেই। বরং এই চোরদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। তিনি এই চোরাদের উদ্দেশে বলেছেন, তারা যেন আগামী নির্বাচনে ঐ চুরির টাকা খরচ করে আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় আনেন। তা না হলে ঐ চুরির টাকা নিয়ে তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু তিনি একবারের জন্যও তাদের উদ্দেশে বলেননি যে, তারা যেন চুরিই না করে। বিটুমিনের বদলে যেন না দেয় পোড়া মবিল।
কোন ড্রাইভার রং পার্কিং করেছে, বিআরটিএতে কী হচ্ছে, এসব জনাব কাদেরের প্রধান কাজ নয়। তার প্রধান কাজ তো হওয়ার কথা ঠিকঠাক উপকরণ দিয়ে সড়কগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, সেতু বা কালভার্ট নমুনা অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে কি না, সেটা তদারকি করা। সে কাজ তাকে কখনও করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আর সে জন্যই সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ফাটা কেষ্ট বলে অভিহিত করেছে। ওবায়দুল কাদের তার কর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে, যাদের টাকা দরকার, চাকরি দরকার, তারা যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। চাকরি না হয় দিলেন, কিন্তু টাকা দেবেন কোথা থেকে? এভাবে বিটুমিনের বদলে সড়ক নির্মাণের কন্ট্রাকটরি দেবেন? যাতে জনগণের পয়সা লুট করে তার কর্মীরা টাকা বানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এসবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কী বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি অপচয় করছেন, সেটাও মনে রাখা দরকার।
রড নেই, এমন কি বাঁশও নেই
পরের ঘটনা সিলেট শিক্ষা অধিদফতরের। এর দায় ওবায়দুল কাদেরের নয়। তবে তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের সাধারণ সম্পাদক। তারা ক্ষমতাসীন। ফলে তিনি এ দায়িত্বও এড়াতে পারেন না। কয়েকদিন আগে সিলেট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে অনিয়ম এবং ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ সংবাদ প্রকাশ ও এলাকাবাসীর অভিযোগের পর সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নিজ এলাকায় নির্মাণাধীন কলেজের কাজ পরিদর্শনে যান স্থানীয় এমপি ও জাতীয় পার্টির যুগ্ম-মহাসচিব ইয়াহইয়া চৌধুরী এহিয়া। তিনি সরেজমিন গিয়ে নির্মাণাধীন কলেজের একটি পিলার ভেঙে দেখতে পান পিলারে কোনো রড দেওয়া হয়নি। এমন কি বাঁশও নয়। কার্যত উপযুক্ত রড ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে গোয়ালাবাজার আদর্শ মহিলা কলেজের বহুতল ভবন। তিনি সংশ্লিষ্ট তিন জনকে ধরে ফেলেন। তবে ঠিকাদার পালিয়ে যায়। জনাব এহিয়া বিষয়টি জানতে চেয়েছিলেন তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষা অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের কাছে। তাজুল ইসলাম এমপিকে বলেন, কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। সব ঠিকঠাক মতো চলছে। এমপি সেখানে গেলে বরং লজ্জা পাবেন। তবু জনাব এহিয়া গত শনিবার তাজুল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক রাখাল দে’কে ঘটনাস্থলে থাকতে বলেন। এমপি যাবেনই, এটা নিশ্চিত হলে রাখাল দে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে তার সকল শ্রমিককে সরিয়ে নেন। শুধু পিলার নয়, লিন্টারের কিছু অংশ ভেঙে তিনি দেখতে পান যে, সেখানেও উপযুক্ত রড দেওয়া হয়নি।
এটি কোনো খেলনা দালান নয়। চারতলা ভবন। ছাত্রীরা এখানে লেখাপড়া করবে। শিক্ষকরা পড়াবেন। তাদের মাথার ওপর এই ভবন ভেঙে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঠিকাদারকে সম্ভবত বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই টাকা কি উদ্ধার হবে? ভবনটি কি পুনঃনির্মাণ করতে হবে? রাখাল দে’র কি শাস্তি হবে? নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। তবে এর আগে ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ দিয়েছিলেন ঠিকাদার ও আওয়ামী নেতা মনি সিংহ। কয়েকদিন জেলে ছিলেন। এখন জামিনে মুক্ত আছেন। কলেজের ক্ষেত্রেও কি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে?

 

http://www.dailysangram.com/post/293339-