ত্রাণের আশায় বুকপানি ভেঙে শিশুসন্তান নিয়ে ছুটছেন উলিপুরের বালাডোবা চরের অসহায় এক নারী : স্টার মেইল
১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:০৮

ত্রাণের জন্য হাহাকার

লালমনিরহাট ও মানিকগঞ্জে ভয়াবহ নদীভাঙন

কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত চরাঞ্চলগুলোতে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে, নৌকা দেখলেই ছুটে আসছেন বন্যাদুর্গতরা। মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গার ভাঙনে সর্বস্বান্ত অর্ধশত পরিবার, হুমকির মুখে স্কুল, বাজার ও রাস্তা। লালমনিরহাট জেলায় তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে ভাঙন। মৌলভীবাজারের বড়লেখায় বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জে যমুনায় পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি, গো-খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় বন্যায় চারজনের মৃত্যু হলেও অনুদান পেয়েছে দু’জনের পরিবার।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি সামান্য হ্রাস পেলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি এখনো চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ধরলার পানি হ্রাস পেয়ে সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে চরাঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি দীর্ঘ দিন তলিয়ে থাকায় দুর্ভোগ বেড়েছে। জেলার দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরে চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। নৌকা বা নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ শুনলেই ত্রাণের জন্য ছুটে আসছেন বানভাসিরা।
জেলার সাত উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনেক বানভাসি পরিবার ঘরের ভেতর উঁচু মাচা বেঁধে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছে। পাঠদান বন্ধ রয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসাসহ ১৯৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বালাডোবা চরের আরমান আলীর স্ত্রী সাহেদা বেগম জানান, ঘরে চাল নেই। তিনি জানান, তার স্বামী বাকিতে চাল কিনতে বাজারে গেছে। না পেলে না খেয়ে থাকতে হবে। একই চরের আরেক বাসিন্দা মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম জানান, ‘১০ দিন ধরে পানিবন্দী আছি। স্বামী কাজে যেতে পারে না। আপনাদের নৌকা দেখে এসে দেখি আপনারা ত্রাণ নিয়া আসেন নাই। ছোট ছেলেমেয়ে নিয়া ভেলার ওপর দিন পার করছি।’ বালাডোবা চরের বন্যাদুর্গতরা অভিযোগ করেন, এই চরে এ পর্যন্ত কোনো সাহায্য আসেনি।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মো: বেলাল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে চার হাজারের বেশি পরিবার প্রায় ১০ দিন ধরে পানিবন্দী। এ পর্যন্ত যে বরাদ্দ পেয়েছি তা সাড়ে ৮০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও দেড় শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার দেড় শ’ পরিবারকে দিতেই শেষ হয়ে গেছে। ইউনিয়নের ১২টি চরের সবগুলোতে দেয়া সম্ভব হয়নি।
এ অবস্থা শুধু বালাডোবা চরের নয়, ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার সব চর ও দ্বীপচরের। কোথাও কোথাও ত্রাণের ১০ কেজি চাল ও শুকনো খাবারের একটি প্যাকেট জুটলেও পরিবারে ৫ থেকে ১০ জন সদস্যের জন্য তা খুবই অপ্রতুল।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, বন্যার্তদের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ৪০০ মেট্রিক টন চাল, ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও চার হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ১০ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর পানি কমে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, রৌমারীতে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে মানবতর জীবন যাপন করছে। নৌকা দেখলেই অথৈ পানি অতিক্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশু, নারী-পুরুষ ছুটে আসছে নৌকার দিকে। রৌমারী ও রাজিবপুরের বাঁধের পশ্চিম পারের বদরপুর, কেচুমারী, ভেরামারী, খারুভাজ, চরনেওয়াজী, নয়ারচর, ঢাকাইয়া পাড়া, বড়বের, রৌমারী, চরবাঘমারা, কান্দাপাড়া, ফলুয়ারচর, বড়চর, কুটিরচর, খেদাইমারী, বাইশপাড়া, খনজনমারা, ঘুঘুমারী, সাহেবের আলগা, চরইটালুকান্দা, গাছবাড়ী, কাজাইকাটাসহ অর্ধশত গ্রামের হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে মানবতর জীবন যাপন করছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় রান্না করে খেতে পারছে না। টিউবওয়েলগুলো তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে পড়েছে।
রাজিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শফিউল আলম বলেন, রাজিবপুরে বন্যায় তলিয়ে গেছে অনেক গ্রাম। ভেঙে গেছে কাঁচাপাকা সড়ক। বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩৬ মেট্রিক টন চাল ও শুকনা খাবারের জন্য দেয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। তার নিজস্ব তহবিল থেকে বানভাসিদের ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। রৌমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বঙ্গবাসী জানান, উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ৫৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। তবে দুর্গতদের সংখ্যা অনুযায়ী সামান্য বরাদ্দ।
লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। গত সাত দিনে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ জেলায় পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে কয়েকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ।
বন্যায় জেলার আদিতমারী উপেজলার গোবর্ধন স্প্যার বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়ার পাশাপাশি হাতীবান্ধা উপজেলার সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ধবুনী গ্রামে শহর রক্ষা বাঁধের আটটি স্থানে ভেঙে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে ধরলা নদী তীরবর্তী সদর উপজেলার কুলাঘাট শহর রক্ষা বাঁধ ও হাতীবান্ধা উপজেলায় তিস্তা নদীর তীরবর্তী গড্ডিমারী ইউনিয়নের তালেব মোড় এলাকার বাঁধ। সদর উপজেলার শিবের কুঠি ও চর শিবের কুঠি এলাকায়ও ধরলা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রেজ্জাকুল ইসলাম কায়েদ জানান, তার ইউনিয়নে পূর্ব ডাউয়াবাড়ী ও দক্ষিণ ডাউয়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দু’টি তিস্তায় বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত তিন দিনে ৫৭টি বসতবাড়ি ও অনেক আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে। নদীভাঙনের শিকার পরিবারগুলো বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান শফিউল আলম রোকন জানান, তার ইউনিয়নে বুধবার বিকেলে পশ্চিম হলদিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত চার দিনে তার ইউনিয়নে ২৬টি বসতবাড়ি ও অনেক আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে।
আদিতমারী উপেজলার মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে গোবর্ধন স্প্যার বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু বাড়িঘর নদীতে চলে গেছে। লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী জানান, ধরলা নদীর তীরবর্তী শহর রক্ষা বাঁধটি হুমকির মুখে রয়েছে। শিবের কুঠি ও চর শিবের কুঠি এলাকায় আবাদি জমি ও বসতবাড়ি ধরলা নদীতে বিলীন হচ্ছে। হাতীবান্ধা উপেজলার সির্ন্দুনা ইউপি চেয়ারম্যান নুরল আমিন জানান, বন্যায় তার ইউনিয়নে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তাদের মাঝে শুকনা খাবার ও চাল বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বন্যার পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয়েছে ভাঙন। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা নদীতে বিলীন হচ্ছে।
ওই উপেজলার সিঙ্গিমারী ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দুলু ও গড্ডিমারী ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা ডা: আতিয়ার রহমান জানান, বন্যার পানিতে সিঙ্গিমারী ইউনিয়নের ধুবনী গ্রামের শহর রক্ষা বাঁধের আট স্থানে ভেঙে গেছে ও গড্ডিমারী ইউনিয়নের তালেব মোড় এলাকায় একটি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে গেছে, যা জরুরিভাবে মেরামত করা প্রয়োজন।
হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম হলদিবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিলুল ইসলাম জানান, বুধবার সকালে তিস্তা নদীর ভাঙনের মুখে পড়ে বিদ্যালয়টি। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের ঘরগুলো খুলে ফেলা হয়েছে। বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। লালমনিরহাটের সহকারী কমিশনার এম এম আরাফাত হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত নদীভাঙনের কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। যে কারণে এ মুহূর্তে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা বলা যাচ্ছে না। তালিকা তৈরি করে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো: আলাউদ্দিন খান জানান, জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। অনেক এলাকায় নদীভাঙন রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে পনর্বাসন করা হবে।
ঘিওর (মানিকগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ঘিওরে কালিগঙ্গা ও পুরাতন ধলেশ্বরী নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অর্ধশত বসতবাড়ি, প্রায় এক কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা রাস্তা। ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে দুই শতাধিক বসতবাড়ি, তিনটি উচ্চবিদ্যালয়, দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদরাসা, বাজার ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি।
গতকাল শনিবার সরেজমিন ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কুস্তা-নারচী গ্রামের কমপক্ষে ১০টি পরিবারের লোকজন চালের টিন, আসবাবপত্র, গবাদিপশু নিয়ে ছুটছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এ গ্রাম দু’টিতে গত এক সপ্তাহে ধলেশ্বরী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে আরো ১৭টি পরিবারের বসতবাড়ি। ভিটেমাটি হারা মানুষ আশ্রয় নিচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে।
এ দিকে উপজেলার জাবরা, তরা, উত্তর তরা, নকীব বাড়ি এলাকার ২০টি বসতবাড়ি, তরা-নকীব বাড়ি যাতায়াতের একমাত্র রাস্তার দুই কিলোমিটার অংশ ও ফসলি জমি কালিগঙ্গা নদীর ভাঙনের কবলে পড়েছে। ধলেশ্বরীর ভাঙনের কবলে পড়েছে ঘিওর-নারচী সড়কের অর্ধ কিলোমিটার অংশ, কুস্তা মাদরাসা, মসজিদ, পাকা ব্রিজসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। প্রশাসনের প থেকে কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় বিপদ বাড়ছে নদীপাড়ের মানুষের।
কুস্তা গ্রামের শফি উদ্দিন (৬০) জানান, গত এক সপ্তাহে আমার ২৪ শতাংশ বসতবাড়ির সবটুকুই গেছে নদীতে। আয়নাপুর গ্রামের তাহেজ মাতবর জানান, ফসলি জমিসহ সব কিছুই বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে অন্যের বাড়িতে। ভাঙনকবলিত পেঁচারকান্দা এলাকার স্কুলছাত্রী রেশমা আক্তার জানায়, আমাদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তার অর্ধেক ভেঙে গেছে। সামনে জেএসসি পরীক্ষা, পড়াশনা করতে পারছি না, সব সময় ভয়ে থাকি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা খন্দকার বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে বন্যার পানি কমলেও বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। পরিবার পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। নিজেদের খাবার জোগাড় করতে পারলেও গবাদিপশুর খাবার জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছেন বানভাসিরা।
গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ছয় সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার করতোয়া, গুমানী, হুরাসাগর, ফুলজোড় নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে আরো ২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় জেলার ৫০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪টি ইউনিয়ন। জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর, কাজিপুর, সদর ও চৌহালী উপজেলার ২৪৭টি গ্রামের ৪৭ হাজার ৬৬০টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এক হাজার ৯৮০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২৭ হাজার ২৭৭টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩২৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ছয় কিলোমিটার বাঁধ ও রাস্তা, ৯ হাজার ১৪০ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ৩৫০ মেট্রিক টন চাল, দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও নগদ ১২ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানিয়েছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিক মো: ইউসুফ রেজা জানান, পাঁচটি উপজেলার ১৩৯টি বিদ্যালয়ের মাঠে ও ২৭টির ভবনে পানি উঠেছে। কাজিপুর উপজেলার ফুলজোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
শাহজাদপুর উপজেলার গো-চারণ ভূমি ডুবে যাওয়ায় বড় বড় খামারিরা চরম বিপাকে পড়েছেন। গো-খাদ্য সঙ্কটের কারণে কোনো কোনো খামারি বাছুর ও বয়স্ক গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে খামারিরা জানিয়েছেন।
বড়লেখা (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, বড়লেখায় বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হয়েছে। কয়েক দিন ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল। তবে গত বৃহস্পতিবার রাতে কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আবারো অবনতি হয়েছে। ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়ছে।
সূত্র জানায়, অকাল বন্যায় হাকালুকি হাওরসংলগ্ন বর্নি, তালিমপুর, সুজানগর ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ আশপাশ এলাকার অন্তত ছয়টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ দুই মাস ধরে পানিবন্দী। বন্যাদুর্গতদের জন্য বিভিন্ন ইউনিয়নে ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে দুর্গত ২৫৩টি পরিবার আশ্রয় নেয়।
সরেজমিনে তালিমপুর ইউপির হাল্লা, ইসলামপুর, খুটাউরা, বাড্ডা, নুুনুয়া, পাবিজুরি, শ্রীরামপুর, মুর্শিবাদকুরা, পশ্চিম গগড়া, পূর্ব গগড়া, বড়ময়দানসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের অনেক গ্রামের রাস্তাঘাট নিমজ্জিত হয়েছে। ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় অনেকেই আবারো উঁচু এলাকায় ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
তালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যুত কান্তি দাস ও সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান নছিব আলী জানান, গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারী বৃষ্টিতে আবারো পানি বাড়ছে। এতে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা লোকজনের বাড়িফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনার পানি সামান্য হ্রাস পেলেও ইসলামপুরের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। যমুনার পানি এখনো বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ৭ জুলাই থেকে বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলায় তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা যায়, গত ১৪ জুলাই দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলার গাইবান্ধা ইউনিয়নের বটচর গ্রামের সাখাওয়াত হোসেনের শিশুপুত্র ইমরান হোসেন (৬), ১৩ জুলাই দুপুরে পার্থশী ইউনিয়নের বেড়ের গ্রামের নাজিমুদ্দিনের শিশুপুত্র আরিফ (৮), ১১ জুলাই বেলগাছা উচ্চবিদ্যালয়-কাম-বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পড়ে পানিতে ডুবে বেলগাছা গ্রামের বজলুর ছেলে রিপন (১০) এবং ৭ জুলাই বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে চিনাডুলী ইউনিয়নের গিলাবাড়ি গ্রামের সোয়াতনের ছেলে মুনু মিয়ার (৩০) মৃত্যু হয়েছে।
বন্যায় উপজেলায় এই চারজনের মৃত্যু হলেও অনুদান পেয়েছে দু’জনের পরিবার। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ইসলামপুরে ত্রাণ বিতরণ করতে এসে মনু মিয়া ও রিপনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে চেক প্রদান করেন।
এ দিকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান টিটু জানান, বন্যার্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন চাল, সাড়ে চার লাখ টাকা, এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প থেকে ৩০০ প্যাকেট হাইজিন কিট বিতরণ করা হয়েছে যা আড়াই লাধিক বানভাসি মানুষের জন্য অতি অল্প বলে মনে করেন এলাকাবাসী।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/236103