১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:০৬

লাগামছাড়া ছাত্রলীগ

‘সংগঠনকে হেয় করতে কিছু গণমাধ্যম ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ করে’

বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকার পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল ও ডোন্ট কেয়ার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার পরিবর্তে ছাত্রলীগের একটা বড় ও প্রভাবশালী অংশ সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। পেশিশক্তির বড়াই করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। যার ফলে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। এ জন্য প্রায়ই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ছাত্রলীগ। কেন্দ্র থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরও কোনোভাবেই তৃণমূলের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমান্ডও অনেকটা বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগকে সতর্ক করে দেয়ার পাশাপাশি এক অনুষ্ঠানে অপকর্ম না করার জন্য শপথ করান ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত ৩০ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে ছাত্রলীগকে সুনামের ধারায় ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যখন পত্রিকায় ছাত্রলীগের অপকর্মের শিরোনাম হয় তখন সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হলের সিট ভাগাভাগি ও রুম ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে। গত ১১ জুন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অপকর্ম থেকে দূরে রাখতে টাকা ও চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ছোট ও বড় মিলে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে গত বুধবার চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ওবায়েদ ও সম্রাট গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় নেতাকর্মীরা দা-কিরিচ ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দিলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার নিয়ে চট্টগ্রাম নগর ভবনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে সাতকানিয়া উপজেলায় এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত নিহত হন। গত বুধবার রাতে সিলেট এমসি কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জিত সরকারের অনুসারী হোসেইন গ্রুপ ও টিটু গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়। রাতে হোস্টেলে উভয় গ্রুপই সশস্ত্র মহড়া দেয়। বৃহস্পতিবার ভোরে সশস্ত্র অবস্থায় টিটুর নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন নেতাকর্মী অতর্কিত হামলা চালিয়ে কলেজ হোস্টেল ভাঙচুর করেন। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালের ৮ জুলাই ঐতিহ্যবাহী ওই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায় ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় করা মামলাটি এখনো চলমান। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সিলেট এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে আসা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। এ ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
গত ৩০ জুন নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলায় ছাত্রলীগ নেতা তোফাজ্জলের দাবি করা ৫ লাখ টাকা দিতে অস্বীকার করায় স্থানীয় কৃষক মুশতাকের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করা হয়। পরে থানায় মামলা করেও হুমকির মুখে রয়েছেন মুশতাক। একই দিনে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে প্রতিপক্ষের হামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সভাপতিসহ তিনজন গুরুতর আহত হন। গত ১ জুলাই সুনামগঞ্জের দিরাই ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে অন্তত ১৫ জন আহত হন। গত ৪ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মানিকগঞ্জের শিবালয় সদরউদ্দিন ডিগ্রি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের উপসম্পাদক নাজমুল হুদাসহ দুইজন প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন। এরপর ৯ জুলাই ঝালকাঠির রাজাপুর কলেজে একাদশ শ্রেণীর নবীনবরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করার আগমুহূর্তেই ছবি তোলা ও বি এইচ হারুন এমপির পাশে হাঁটাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একই দিনে বগুড়ার নন্দী গ্রামে ছাত্রলীগ কর্মী রিপনের গুলিতে এক যুবক নিহত হন। গত ১২ জুলাই ওসি অপসারণের দাবিতে ছাত্রলীগের এক অংশের ডাকা বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানববন্ধন চলাকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগের অপর অংশ হামলা চালায়। এতে গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এ বছরের শুরুতেই নানা দুষ্কর্মের জন্য ছাত্রলীগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। গত ৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ইটের আঘাতে আহত হন এক প্রবীণ শিক্ষক। গত ১২ জানুয়ারি রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে সিট ভাগাভাগি নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। ২১ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পরে মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাসে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় কলেজ শাখা আহ্বায়ক নূর আলম ভূঁইয়াসহ ১৯ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক নূরুল আমিন মুহুরী নিহত হন। গত বছরের ২৭ অক্টোবর গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকার ফুটপাথ থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় হকারদের সাথে সিটি করপোরেশন কর্মচারীদের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের দুই নেতার আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গোলাগুলি করার ঘটনায় ছাত্রলীগ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়। ওই দুই নেতাকে শেষমেশ বহিষ্কার করে পার পাওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের খাবার নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা, ৮ ডিসেম্বর ঠুনকো বিষয় নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজনের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে কয়েকজন জখম হওয়া এবং ২৯ ডিসেম্বর রাতে ঝিনাইদহে সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। গত বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামে রহস্যজনক মৃত্যু হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইফরান চৌধুরীর। এই মৃত্যু সংগঠনের স্থানীয় বিরোধের ফল বলে অভিযোগ উঠেছে। এ রকম অহরহ ঘটনা ঘটছে ছাত্রলীগের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলপর্যায়ে। এসব কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক মো: দেলোয়ার হোসেন শাহাজাদা নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্রলীগকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য চিহ্নিত কিছু গণমাধ্যম ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ করে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন আর কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। আগের মতো সেশনজটও নেই। শিক্ষার্থীরা নির্বিঘেœ পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত বড় একটি সংগঠন, ছোটখাটো কিছু সমস্যা তো থাকবেই। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি সমাধানের। কোনো অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অপরাধ করে কোনো নেতাকর্মীর পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
ছাত্রলীগের এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, যখন দল ক্ষমতায় আসে, সে যে দলই হোক না কেন, কিছু সুবিধাবাদী লোকজন প্রবেশ করে। ওই অনুপ্রবেশকারীরাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দলের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, তার পরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কেউ যেন দলের সুনাম নষ্ট করতে না পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/236101