১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:০৫

গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খোলা : বন্যা বিস্তৃতির আশঙ্কা

ভারতের বন্যাকবলিত বিভিন্ন অঞ্চলের পানি কমাতে দেশটি তিস্তায় গজলডোবা ব্যারাজের গেট খুলে দেয়ায় ভাটির দেশ বাংলাদেশের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাসহ দেশের নি¤œক্ষাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে উজান থেকে নদীতে নেমে আসা পানি আর অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের ৬৪ জেলাতেই বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব নি¤œক্ষাঞ্চলে বন্যায় পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। খাবার সঙ্কটসহ নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বানভাসী মানুষের জন্য সরকারের অপ্রতুল ত্রাণতৎপরতায় দুর্গতদের মধ্যে ক্ষােভ বিরাজ করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৮ জুলাই থেকে ভারতের বিভিন্ন অংশে বন্যার পানি কমাতে তিস্তায় গজলডোবা ব্যারাজের গেট খোলা শুরু করে ভারতীয় কর্তৃপ। এর পরের তিন দিন ক্রমান্বয়ে ৫৪টি গেটের সব কটিই খুলে দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশের তিস্তার অববাহিকার বিভিন্ন অঞ্চলের পানির প্রবল স্রোতে ভেঙে যায় বিভিন্ন স্থানের বন্যানিয়ন্ত্রণ ও নদীর তীর রা বাঁধ। প্লাবিত হচ্ছে ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই সাথে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এতে ফসল হারানোর পাশাপাশি বসতভিটা হারিয়ে এসব অঞ্চলের মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। কিন্তু ভানবাসীদের জন্য সরকারের ত্রাণতৎপরতা স্থানীয়দের আশান্বিত করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের মতোই এবার বাংলাদেশেও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে এবং সারা দেশেই এখনো প্রায় প্রতিদিনই ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে প্রায় সব বড় নদীর পানিই বইছে বিপদসীমার উপর দিয়ে। গত ছয় দিন থেকে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। গত শুক্রবার থেকে পদ্মা নদীর পানিও বইছে বিপদসীমার উপর দিয়ে। পানি বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র নদেও। এসব কারণে সারা দেশেই বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ১০টি নদনদীর পানি ১৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছ। নদনদীগুলো হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, ঘাঘট, আত্রাই, ধলেশ্বরী, কপোতা, সুরমা, কুশিয়ারা ও কংস। দেশের প্রধান নদনদীর পানি বৃদ্ধির কারণে দেশের ১৩টি জেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। শুরু হয়েছে নদীভাঙন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় সাড়ে ছয় লাখ লোক তিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি তিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিলেট, মৌলভীবাজার, জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও নীলফামারী।
তবে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে এ জন্য দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চলমান বন্যাপরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে। অপর দিকে দেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকলে নতুন নতুন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। যদিও এ মুহূর্তে স্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করছেন না পাউবোর প্রকৌশলীরা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সূত্র জানিয়েছে, এ মুহূর্তে আমরা স্থায়ী বন্যার আশঙ্কা করছি না। স্থায়ী বন্যার েেত্র এক সাথে দেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার পানি বাড়তে হবে। এখন মেঘনায় পানি বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা আমরা দেখছি না।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরো জানিয়েছে, ৯০টি পানি সমতল স্টেশন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৫৭টি পয়েন্টে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, পানি কমেছে ২৭টি পয়েন্টে, দু’টি নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত দেশের অন্তত ১৬টি নদনদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে গাইবান্ধায় ঘাগট নদী, চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে যমুনা, বাঘাবাড়ীতে আত্রাই, টাঙ্গাইলের এলাসিনে ধলেশ্বরী, গোয়ালন্দে পদ্মা, ঝিকরগাছায় কপোতা, কানাইঘাটে সুরমা, অমলসিদ, শেওলা ও শেরপুর-সিলেটে কুশিয়ারা, দিরাইয়ে পুরনো সুরমা এবং জারিয়াঝঞ্জাইলে কংস নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যাপরবর্তী পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেণাধীন স্টেশনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদে চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার, যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ৫৩ সেন্টিমিটার, কাজীপুর পয়েন্টে ৬৫ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৭৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মার পানি সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তবে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-সুরমা নদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে।
এ দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঈদের আগেই আমাদের কাছে ভয়ানক বন্যার বার্তা দেয়া হয়েছিল। যদিও সে খবর বাইরে প্রকাশ করা হয়নি তবে আমরা ভেতরে ভেতরে ঠিকই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ৬৪ জেলাই প্লাবিত হতে পারে ধরে নিয়েই আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সব জেলায় চিকিৎসকদের বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে যা কোনো কোনো জেলায় ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছে। তিনি জানান, দেশের সব জেলাতে বন্যাকালীন চিকিৎসা প্রদানের জন্য চিকিৎসক টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে যাতে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ দ্রুত সামাল দেয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অন্যান্য কাজের সঙ্গে প্রতিদিন বন্যাকালীন কাজের প্রস্তুতির খোঁজ রাখছেন।
বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১২ জুলাই গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন জেলার ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। বন্ধ ঘোষিত প্রতিষ্ঠানগুলো বানভাসী মানুষের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই দিন জামালপুর জেলার ১৩৩টি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে প্রায় সারা দেশেই অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, কোথাও ঘোষণা দেয়া হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। এতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত ঘরবাড়ি। হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনা নদীর তীরে বাহুকা এলাকার বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের রিভার কোরের মেজর সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা সদস্যদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার নিয়োগ করে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে।
অপর দিকে বন্যার কারণে হাওরাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট। গত ১০ দিনের বেশি সময় ধরে পানিবন্দী থাকায় বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলোতে খাদ্যসঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প থেকে ত্রাণের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় এখন পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তার আওতায় এসেছে মাত্র এক হাজার পরিবার। কিন্তু মারাত্মকভাবে তিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২০ হাজারের ওপর। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা এখন পর্যন্ত সেখানে ৩০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল এবং ২০০ করে টাকা দেয়া হয়েছে। অথচ কাজীপুরে পানিবন্দী রয়েছে অন্তত দুই হাজার পরিবার।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, মওসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। তবে আগামী কয়েক দিন অতি ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/236099