১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:০৪

সরকার ৮ টাকার বিদ্যুৎ কিনছে ৩০ টাকায়

সামিটে গচ্চা ২৩শ’ কোটি টাকা

নানা কৌশলে ফার্নেস অয়েল থেকে ডিজেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন * গত অর্থবছরের বিল পরিশোধ হলে আরও ১২শ’ কোটি টাকা গচ্চার আশঙ্কা * চুক্তি বহাল থাকলে ২২ বছরে ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা * ক্ষতি হচ্ছে না, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম প্রায় সমান -বিদ্যুৎ সচিব

মাত্র একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই সরকারের গচ্চা প্রায় দুই হাজার তিনশ’ কোটি টাকা। চুক্তি অনুযায়ী ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করায় সরকারের এ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ৩০৫ মেগাওয়াটের সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (এসএমপিসিএল) কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারকে এ অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। আগামী ২২ বছর এ হারে বিদ্যুৎ কিনতে হলে ২৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। গত দুই অর্থবছরে (২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬) এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরকার ১৪৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ কিনেছে। এ জন্য পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েল দিয়ে উৎপাদিত এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে (৮ টাকা ইউনিট হিসাবে) ১ হাজার ১৯২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ডিজেল দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করায় সরকারকে অতিরিক্ত দুই হাজার ২৯৪ কোটি ১২ টাকা দিতে হয়েছে। গত অর্থবছরের জন্য পিডিবিকে অতিরিক্ত ১২শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হতে পারে।


বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নাম সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (এসএমপিসিএল)। ২২ বছরের চুক্তি অনুযায়ী সামিট গ্রুপের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ছিল দ্বৈত জ্বালানির (গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল)। সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল এবং গ্যাসচালিত মেশিন বসানোর কথা। কিন্তু বসানো হয়েছে ডিজেল ও গ্যাসচালিত মেশিন। এতে দ্বিগুণের বেশি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পিডিবির প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, এই কেন্দ্রটি একদিন চালু রাখতেই প্রায় ১০ কোটি টাকার ডিজেল কিনতে হয়। এ কারণে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ কেনার খরচ পড়ে ২০ টাকার বেশি। অথচ ফার্নেস অয়েল দিয়ে করলে এই খরচ নেমে আসত ৭-৮ টাকায়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তেল গ্যাস ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মোহাম্মদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, কম মূল্যের জ্বালানি ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে সামিটসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোকে বেশি টাকার সুবিধা দেয়া যায় না। এ জন্য উচ্চমূল্যের জ্বালানি ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার অনুমতি দিচ্ছে। আর এই ঘাটতি মেটাতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে সরকার। জনগণের পকেট কাটছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সরকারের পরিকল্পনার অংশ। এ জন্য বড় বড় কোম্পানিগুলোকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে জনগণের পকেট কাটছে সরকার।

সম্প্রতি প্রকাশিত পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী (২০১৫-১৬) অর্থবছরে আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য সরকার ৭ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে শুধু সামিটের মেঘনাঘাটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য পিডিবির খরচ হয়েছে ২,০৬৯.৭১ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি এ সময় ১০১ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার ১৩৫ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। প্রতি ইউনিটের মূল্য ২০ টাকা ৪০ পয়সা হিসাবে সরকারকে ২,০৬৯.৭১ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়। অথচ মূল চুক্তি অনুযায়ী ফার্নেস অয়েল দিয়ে উৎপাদিত এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে সরকারের ব্যয় হতো (ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা) ৮১১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় সরকারকে বেশি ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। জানা গেছে, কেন্দ্রটি ২০১৪ সালে উৎপাদনে আসে। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা বিল দিতে হয়েছে। ওই বছর কোম্পানিটি মোট ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ৩৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এতে ইউনিটপ্রতি বিল হয়েছিল ২৯.৭৭ টাকা। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ ফার্নেস অয়েল দিয়ে উৎপাদন হলে ব্যয় হতো ৩৮০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ করায় অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১০০০ কোটি টাকার বেশি। উৎপাদন বেশি হলে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ গচ্চা যেত। সূত্র আরও জানায়, গত অর্থবছরে এখনও বিল প্রস্তুত করা হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরও এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চার আশঙ্কা আছে। পিডিবি প্রকৌশলীদের বক্তব্য কোম্পানিটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে শুধু ডিজেল ব্যবহার করায় দুই অর্থবছরে সরকারকে প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে। এ অতিরিক্ত ব্যয়কেই সংশ্লিষ্টরা গচ্চা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এ টাকা কোনো দিন ফেরত আসবে না। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২২ বছর পর্যন্ত কেন্দ্রটি যদি ডিজেল দিয়ে পরিচালিত হয়, তবে সরকারকে আনুমানিক ২৫ হাজার থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে এখান থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।

জানা গেছে, সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (এসএমপিসিএল) গ্যাস এবং ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তির পর তারা ফার্সেন অয়েল থেকে সরে ডিজেলে যাওয়ার পাঁয়তারা করতে থাকে। এজন্য তারা চুক্তির প্রায় এক বছর পর ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর অনুমতি আদায় করে। এজন্য সামিট নানা কৌশলও অবলম্বন করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস না পাওয়ায় সামিট গ্রুপ প্রথমে কেন্দ্রটি ফার্নেস অয়েলে করার চিন্তাভাবনা করেছিল। কিন্তু ওই মেশিনের দাম বেশি হওয়ায় একপর্যায়ে কোম্পানিটি ডিজেলচালিত মেশিন আমদানি করে। নিয়ম অনুযায়ী ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। কারণ এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী সামিটের ডিজেলচালিত মেশিন বসানোর অনুমতি নেই। এ জন্য সামিট কৌশলে সরকারের অনুমতি আদায় করে নেয় বলে অভিযোগ আছে। এ জন্য প্রথম বিপিসি’র (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন) কাছে ফার্নেস অয়েল কেনার প্রস্তাব দেয় এসএমপিসিএল । বিপিসি’র একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সামিট কৌশলে উন্নতমানের ফার্নেস অয়েল ক্রয়ের প্রস্তাব দেয় যাতে বিপিসি এই তেল দিতে না পারে। কারণ বিপিসি কখনই এ মানের ফার্নেস অয়েল আমদানি করেনি। তিনি বলেন, মূলত এটি ছিল সামিটের একটি কৌশল। এই অজুহাত কাজে লাগিয়ে এসএমপিসিএল তাদের ডিজেল মেশিনটি পরিচালনার অনুমতি আদায় করে। বিপিসি সূত্র জানায়, সামিটের আবেদন অনুযায়ী বিপিসি জানিয়ে দেয় তারা ওই মানের ফার্নেস অয়েল দিতে পারবে না। এরপর সামিট বিপিসির ওই অপারগতার চিঠি নিয়ে পিডিবিকে জানায় বিপিসি তাদের ফার্নেস অয়েল দিতে পারবে না। কাজেই তাদের পক্ষে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা সম্ভব হবে না। এরপর তাদের অনুমতি দেয়া হয়। দেশে ওই সময় ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট চলছিল। প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে বাধ্য হয়েছে পিডিবি। ওই পরিস্থিতিতে সরকার মরিয়া হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ওই পরিস্থিতির সুযোগ নেয় বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি আর সংশ্লিষ্ট কোম্পানি।

সূত্র জানায়, সামিট মেঘনাঘাট কেন্দ্রকে বেশকিছু বাড়তি সুবিধাও দিয়েছে পিডিবি। এর মধ্যে অন্যতম হল বছরে ১০ শতাংশ সময় কোম্পানিটি ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ রাখতে পারবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। কোনো ধরনের মেরামত কাজ না থাকলেও এ সুবিধা পাবে তারা। বন্ধ করার আগের দিন একটি ঘোষণা দিলেই চলবে। আবার এ সময় (এসএমপিসিএলকে মাসে ৩৭ কোটি টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করবে সরকার। এ ছাড়া মেরামতের জন্য তিন বছর পর তিন মাস বন্ধ রাখা যাবে কেন্দ্রটি। এ সময়ও ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে সামিট। পাশাপাশি মেরামত ব্যয়ও পরোক্ষভাবে বহন করবে পিডিবি।

বিদ্যুৎ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখন চাইলেও এ বোঝা থেকে সহজে মুক্তি পাচ্ছে না পিডিবি। ২২ বছর বইতে হবে এ উচ্চদামের বিদ্যুতের বোঝা। কারণ এসএমপিসিএল থেকে ২২ বছর বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে পিডিবি। আর বিদ্যুৎ না কিনলেও বসিয়ে রেখে মাসিক ৩৭ কোটি টাকা হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে সরকারি সংস্থাটিকে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকার দায়মুক্তি বিধান দিয়ে রেখেছে। ফলে এ খাতে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, জবাবদিহিতাও নেই। আর এ সুযোগে বেসরকারি খাত বাড়তি সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আইনটির প্রয়োগ বন্ধ না হলে এ খাতে সুশাসনও ফিরবে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের সবিচ ড. আহমেদ কায়কাউস যুগান্তরকে বলেন, ২০১৮ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের জোগান বাড়বে। তখন সামিট মেঘনা ঘাট পাওয়ার কোম্পানির ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন রিভিউ করা হবে। তাতে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে যাবে। বর্তমানে সরকার গ্যাস দিতে পারছে না বলেই এসএমপিসিএলকে ডিজেল দিয়ে পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। সরকারের এই বিশাল অংকের টাকার লোকসানের দায় ভার কে নেবে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, ফার্নেস অয়েল আর ডিজেলের দামে খুব বেশি তফাত নেই। এতে সরকারের লোকসান নেই। কারণ ফার্নেস অয়েল ক্রয় করার সময় সরকার ট্যাক্স পায় না। কিন্তু ডিজেল কেনার সময় সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়। অর্থাৎ একদিকে সরকার বেশি দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে, অপরদিকে ডিজেল বিক্রির সময় ট্যাক্স হিসেবে সামিটের কাছ থেকে সে পরিমাণ অর্থ কেটে নিচ্ছে। সচিব বলেন, সামিটের এ কেন্দ্রটি পরিবেশবান্ধব ও উন্নতমানের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামিটের এ কেন্দ্রের মতো আরও বেশ কয়েকটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে যেগুলোর কাছ থেকে সরকার উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনছে। উচ্চমূল্যের এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে সরকারকে। এতে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ভাড়াসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। তাদের প্রশ্ন, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়ার জন্য জনগণের পকেট থেকে নেয়া এ অর্থের দায়ভার কে নেবে?

সামিট কর্পোরেশন লিমিটেডের হেড অব পাবলিক লিমিটেড অ্যান্ড মিডিয়া মোহসেনা হাসান যুগান্তরকে বলেন, মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ডুয়েল-ফুয়েল। গ্যাস না থাকায় আমরা ফার্নেস অয়েলে কেন্দ্রটি পরিচালনা করতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমাদের কেন্দ্রটি বিশ্বের একটি উন্নতমানের অত্যাধুনিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে যে মানের ফার্নেস অয়েল লাগবে, বিপিসি সে মানের ফার্নেস অয়েল দেয়ার অপারগতা প্রকাশ করায় সরকারই কেন্দ্রটি ডিজেল দিয়ে পরিচালনার নির্দেশ দেয়। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রটি ডিজেল দিয়ে চালাতে হচ্ছে। যেহেতু ফার্নেস অয়েলের চেয়ে ডিজেলের দাম বেশি, কাজেই বিদ্যুতের দামও বেশি পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা সরকারের নির্দেশনা ফলো করেছি। সরকার যখনই আমাদের উন্নত মানের ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করবে, তখনই আমরা সেখানে ফিরে যাব। একই সঙ্গে সরকার যদি গ্যাস সরবরাহ করে, তাহলে আমরা গ্যাসে চলে যাব। এ নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি আছে। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি থেকে ২২ বছর সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় করলেও ২২ বছর ডিজেল দিয়ে কেন্দ্রটি পরিচালিত হবে, এটা ঠিক না। যে কোনো সময় এটা ডুয়েল-ফুয়েলে ফিরে যেতে পারে। সরকারই এটা ভালো জানে।

জানা গেছে, গত অর্থবছরও পিডিবির বিদ্যুৎ কেনায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় পাঁচটি ডিজেলচালিত কেন্দ্র থেকে। এতে ইউনিটপ্রতি গড়ে ব্যয় পড়ে ২৪.৩১ টাকা। অথচ ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ৮ থেকে ১২ টাকা। অপরদিকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ করা হলে উৎপাদনে ব্যয় পড়ত ৮ টাকা ৯৩ পয়সা। এছাড়া যদি অন্য কোনো দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হতো, তাহলে ব্যয় পড়ত ৫ টাকা ১৫ পয়সা। আর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় গড়ে ২ টাকা ৩২ পয়সা ও জলবিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ১১ পয়সা পড়ত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালের শেষদিকে সরকার এলএনজি আমদানি করে ওই গ্যাস ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত করবে। তখন সরকারের উচিত হবে, ওই কেন্দ্রটি চুক্তি অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক করে ফেলা। অন্যথা ফার্নেস অয়েল। গ্যাসভিত্তিক করা গেলে ইউনিটপ্রতি ব্যয় ৩ টাকার নিচে চলে আসবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে চালু থাকা উচ্চমূল্যের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পাঁচটির মধ্যে চারটি রেন্টাল। এগুলো ২০১৮ সাল পর্যন্ত চুক্তি রয়েছে। এরপর চাইলে সরকার সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। তবে সামিট মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) হিসেবে চুক্তিবদ্ধ। এজন্য ২২ বছর এ বোঝা টানতে হবে।

পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ২০১০-১১ সালের দিকে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক কম ছিল। তাই চাইলেও সে সময় খুব বেশি দরকষাকষির সুযোগ ছিল না। বাধ্য হয়ে সরকারকে দ্রুত বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে এখন অনেক কিছু বিবেচনা করে লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণেও দরকষাকষির সুযোগ অনেক বেশি থাকে। তিনি আরও বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ মূলত দেয়া হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য। এটি দেয়া না হলে বেসরকারি খাত কেন বিনিয়োগে আসবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সামিট ছাড়াও সিদ্ধিরগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াটের দেশ পাওয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যের ও ব্যয়বহুল। কারণ এটি বিদ্যুৎ বিক্রি করে টাকা দেয়। পিডিবি এ কেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট ২৮.১১ দামে বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করছে। এছাড়া ফার্নেস তেলভিত্তিক রাজ লঙ্কা পাওয়ার লিমিটেড পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে প্রতি ইউনিট ১৬.৩০ টাকা, লেকথানবি বিক্রি করছে ১৫.৭৩ টাকা, এনার্জি পাওয়ার ১৫.৭৩ টাকা। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে এগ্রিকো ও ইন্টারন্যাশনাল খুলনা পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে ২৭.৩২ টাকা প্রতি ইউনিট, ডিপিএ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড ২৬.৯৮ টাকা আর আরজেড পাওয়ার লিমিটেড ২১.৬৯ টাকা প্রতি ইউনিট। গড়ে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ দাম ছিল ২৬.৫৭ টাকা। আর গত অর্থবছরে এ হার ছিল প্রতি ইউনিট ২৫.৮০ টাকা।

অথচ গ্যাসভিত্তিক আইপিপিগুলোর মধ্যে এগ্রিকো, ইন্টারন্যাশনাল আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করছে মাত্র ৪.৪১ টাকা, এগ্রিকো ঘোড়াশাল (১৪৫ মেগাওয়াট) ৩.৪১ টাকা, এগ্রিকো ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৩.৬৮ টাকা, ইউনাইটেড আশুগঞ্জ ৪.০৮ টাকা ও ম্যাক্স পাওয়ার প্রতি ইউনিট ৩.৬৯ টাকা।

সরকার বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য এক অর্থবছরে ২৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা খরচ করেছে। এর মধ্যে ভাড়াভিত্তিক এবং আইপিপিগুলো নিয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়েছে ৩ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। পিডিবির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৫ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। আর ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির জন্য খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা।
http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/16/139945/