১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৮:০৩

এক জমি দু’বার অধিগ্রহণ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ

জড়িত পদস্থ কর্মকর্তারা আড়ালে, চিহ্নিত সার্ভেয়ারের শাস্তি শুধু বদলি

জমি অধিগ্রহণে একই জমির বিপরীতে দু’দফা অর্থ পরিশোধ দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে ঢাকা ডিসি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা। এলএ শাখার সাবেক সার্ভেয়ার মজিবুল হকের নেতৃত্বে অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে। সূত্র বলছে, এর নেপথ্যে ডিসি অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তারাও জড়িত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজগ না থাকলে এভাবে দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। চাঞ্চল্যকর এ দুর্নীতির পুরো নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করতে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের আশঙ্কা ঢাকা ডিসি অফিসে এ রকম আরও অনেক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সেজন্য এলএ কেসের অন্যান্য নথিপত্রও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে চক্রটি দুর্নীতির এমন ভয়াবহ ফাঁদ পাতে, যা অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক লুৎফর রহমান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি এখনও অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। তাই এখনই এ বিষয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তিনি জানান, ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত দলিলপত্র তলব করা হয়েছে। সেগুলোর বিশ্লেষণ চলছে। ঘটনার বিষয়ে অভিযুক্ত সার্ভেয়ার মজিবুল হকের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ঢাকা থেকে বদলি হয়ে গেছি। তাই বিষয়টি পুরোপুরি মনে নেই। তবে বলতে পারি, একই জমি দু’দফা অধিগ্রহণের ওই ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
সূত্র জানায়, ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা শুধু অর্থ আত্মসাৎ করেই থেমে থাকেননি। বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে কিছুদিন পর এ সংক্রান্ত নথিটি অফিস থেকে গায়েব করে। পরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত শুরু হলে ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা পর্দার আড়ালে সক্রিয়া হয়ে ওঠেন। দুদক অনুসন্ধান শুরু করলে সার্ভেয়ার মজিবুল হককে অন্যত্র বদলি করা হয়।
জানা যায়, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। ২০০৮ সালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা মৌজার ১২৪৯নং দাগের অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট এক খণ্ড জমি অধিগ্রহণের জন্য ফাইল উপস্থাপন করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করে জমির মালিক সাইফুল গংকে (২ জন) ২০১২ সালের ১৯ জুলাই চেক বুঝিয়ে দেয়া হয়। টাকার পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। তবে এ সংক্রান্ত নথিতে জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। পরিমাণ লেখার স্থানে বলা হয়েছে অবকাঠামো।
এদিকে দেখা যায়, হাতিরঝিলের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার একই দাগের একই জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিক সাজানো হয় লাইলা ইসলাম গংকে (৫ জন)। তাদের কাছে সমপরিমাণ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয় ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর। এখানে অবশ্য লাইলা গংয়ের পক্ষে চেক গ্রহণ করেন নূর হোসেন জুয়েল, পিতা মরহুম হাজী নুরুল ইসলাম, ১৪নং পূর্ব কুনিপাড়া, তেজগাঁও। ডিসি অফিসের তৎকালীন সার্ভেয়ার মজিবুল হক একই জমির বিপরীতে দ্বিতীয় দফায় ২৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকাও পরিশোধ করেন। তবে এত বড় জালিয়াতির বিষয় বেশিদিন গোপন রাখতে পারেনি মজিবুল হকের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী চক্রটি। হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) দফতরের ২০১৪-১৫ সালের মাঠ পর্যায়ের অডিটে বিষয়টি ধরা পড়ে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সৎ ও সাহসী হওয়ায় দুর্নীতিবাজ চক্রটি তাকে ম্যানেজ করতে পারেনি। অগত্যা ভূমি মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা হলে সবার চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার মতো অবস্থা। তদন্তে বেরিয়ে আসে এই জালিয়াতির পুরো অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এরপর এ ঘটনার তদন্তে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে। ওই কমিটি সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের আদ্যোপান্ত অনুসন্ধান শেষে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে সার্ভেয়ার মুজিবুল হকসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে জড়িতদের বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
এদিকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের পৃথক আরেকটি তদন্তেও ঘটনার সঙ্গে মজিবুল হকের সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মজিবুল হকের বিরুদ্ধে এখনও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সার্ভেয়ার মজিবুল হক ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখায় দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন। জমিটি আগেই অধিগ্রহণ করার বিষয়টি তার অজানা থাকার কথা নয়। অথচ তিনিই ২৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকার চেক প্রস্তুত থেকে শুরু করে অন্যান্য দাফতরিক কাজ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সম্পাদন করেন। আবার তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় এ সংক্রান্ত ফাইলও হারিয়ে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সার্ভেয়ার মজিবুল হক মাদানী এভিনিউয়ের ১০০ ফিট রাস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ প্রকল্পে বরাদ্দ তিনশ’ পঞ্চাশ কোটি টাকার পুরোটাই তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বণ্টন হয়। সেখানেও দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ওই প্রকল্পেরও সব নথিপত্র তলব করা হয়েছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/07/16/139953/