১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৭:৪১

আননে পদাঘাত চলমান চিত্র

আলমগীর মহিউদ্দিন

সামান্য অন্তরবলোকন ও চিন্তায় একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সব কিছু দুই ভাগে বিভক্ত। ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, পক্ষ-বিপক্ষ ইত্যাদি। আর এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ভাবী চিন্তা। এরপর কী? আসলে এই ভবিষ্য চিন্তাই সব কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি। এখানেও পথ দু’দিকে চলে যায়।
এই ভবিষ্যতের চিন্তা জীবনকে যেমন তাড়িত করছে, তেমনি এক কথায়, সব কর্মকাণ্ডের জনক হিসেবে বিরাজ করছে। এ জন্যই ভবিষ্যৎ নিয়ে এত আলোচনা, এত আয়োজন। এ লেখার শিরোনামের প্রেরণাও সেই অনুভূতি থেকে। চার দিকের বিশ্ব ক্রমান্বয়ে বিস্ময়কর অবয়বে নীত হচ্ছে। অবশ্য অনেকেই এই অগ্রহণীয় অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নানা আলোচনা করছেন এবং পথের দিক সন্ধানের চেষ্টা করছেন।
যেমন জীবনকে নিয়ে প্রশ্ন। সুন্দর জীবন কেমন করে নির্মাণ করা যাবে? ভবিষ্যৎ কী? সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কিশোর বোদ্ধা বক্তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?’ বক্তা আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জীবনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে হত্যা, খুন, সংঘর্ষ, সঙ্ঘাত, ষড়যন্ত্র ইত্যাদির ওপর জোর দিচ্ছিলেন। বুদ্ধিমান কিশোর তার বক্তব্যের ছন্দে আঘাত করে এ প্রশ্ন করলে বক্তাও যেন তার কথার দিক হারিয়ে ফেলে বললেন, ‘কেন জানো না, তা হবে আননে বিরামহীন পদাঘাত।’
এ ঘটনা উল্লেখ করে বিখ্যাত রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ড. জন ডাবলু হোয়াইট হেড তার ‘ব্যাটলফিল্ড আমেরিকা : দ্য ওয়ার অন আমেরিকান পিপল’ বইতে জর্জ ওরওয়েলের সতর্কবাণীটি লিপিবদ্ধ করেছেন। ওরওয়েলের বিখ্যাত বহুল প্রচারিত নাইনটিন এইট্টি ফোর (১৯৮৪) বইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ‘যদি ভবিষ্যতের চিত্রটি দেখতে চাও, তাহলে কল্পনা করো একটি জুতো ক্রমাগত মানবজাতির মুখে আঘাত করছে। সম্ভবত সর্বকালের জন্য।’
প্রশ্ন উঠবে এই জুতোটা কে পরে আছে এবং কেন এমন কর্ম করছে?
প্রশ্নটির জবাব অবশ্যই বহুমাত্রিক এবং বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকেরা এ নিয়ে বহু লেখা লিখেছেন। এদের মধ্যে জর্জ ওরওয়েল, আলডুস হাক্সলি, মার্গারেট কে অ্যাটউড, ফিলিপ কে ডিকের বইগুলো সাড়া জাগায়। আর এদের অনুসরণ করে স্টানলি কুব্রিক, পিয়েরে বুল, কে ব্রাডবারি, আর্থার সি কার্ক প্রমুখেরা যে উপন্যাস লিখেছেন, তা সাড়া জাগানো সিনেমার ছবি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই ছবিগুলো বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়গুলো তুলে ধরে। বিশেষ করে রাষ্ট্র কেমন করে তিলে তিলে মানুষের সব অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে মানুষকে ‘জমবিতে’ পরিণত করছে। ‘জমবি’ হলো বোধবুদ্ধিহীন, নির্জীব নিষ্প্রাণতায় নিমজ্জিত ব্যক্তি। এই ব্যক্তির সৃষ্টি হচ্ছে বর্তমানের পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। এক ুদ্র গোষ্ঠী এই অবস্থার সুযোগে তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করছে এবং সব কিছু দখল বা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি দেশকে পুলিশ রাষ্ট্রে পরিণত করছে। বিশ্বব্যাপী এই বাহ্যমূর্তি বা চেহারা এমনভাবে
বিস্তৃতি লাভ করেছে যে কারো পক্ষে এই বলয়ের বাইরে পা ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। এটা সত্য এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে ুদ্র ক্ষমতালোভী শ্রেণী সর্বকালেই ছিল এবং তারাই ক্ষমতা ও অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে আজকের মতো তারা সর্বগ্রাসী হতে পারেনি। তাদের এই একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের প্রধান হাতিয়ার হয়েছে প্রযুক্তি। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বে কখনো এরা দাস বা কখনো এরা প্রভু হয়ে সব মানুষ জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
ছবির নির্মাতারা বিষয়টিকে খুবই আকর্ষণীয় মনে করেছেন। কারণ সর্বস্তরের মানুষকে এই প্রযুক্তি স্পর্শ করছে। তাই জর্জ ওরওয়েল লিখলেন নাইনটিন এইট্টি ফোর। তিনি যখন ১৯৪৮ সালে এই উপন্যাস লেখেন, প্রযুক্তি তখন প্রচণ্ড বেগে ডানা মেলছিল। তিনি রোমান ক্যাথলিক পাদরি স্যার থোমাস মুরের (১৫১৬) ইউটোপিয়া বইয়ে বর্ণিত অবস্থার বিপরীতের চিত্র আঁকলেন। ইউটোপিয়াতে সবাই সুখী, সবাই সমান, সবার অধিকার সমান। ওরওয়েল এর প্রতিচিত্র আঁকলেন, নাম দিলেন ‘ডিসটোপিয়া’। ইংরেজি ভাষায় নতুন এক শব্দ, যা এমন ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের বর্ণনা দেয় যেখানে জনগণ নানা শৃঙ্খলে বন্দী। এখানে সরকার এবং তার গোয়েন্দারা জনগণের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব নেয়। ওরওয়েল ভেবেছিলেন বিশ্বে এমন অবস্থা ১৯৮৪’র পরে হবে। তাই ওই বইয়ের নামকরণও তেমনভাবে করেন। তিনি দেখে যেতে পারেননি যে প্রযুক্তির কল্যাণে সেই ভয়াবহ বন্দিশিবিরের উত্থান ঘটে তার দেয়া সময়ের অনেক আগেই। উল্লেখ্য এসব লেখকের কল্পকাহিনীকে ধারণ করে অন্তত ১৫টি বিশ্ববিখ্যাত ছবি নির্মিত হয় এবং এগুলো সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করে। এমনকি অনেক আন্দোলনের জন্ম দেয়।
যেমন পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘মাইনরিটি রিপোর্ট’ বা আলডুস হাক্সলির ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ অথবা মার্গারেট অ্যাটউপের ‘দ্য হ্যান্ডমেইড’।
ওরওয়েল তার ১৯৮৪-এ দেখিয়েছেন সরকার কেমন করে নানা নিয়ম-নীতি সৃষ্টি করে তার এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে জনগণের সব অধিকার ছিনিয়ে নেয়। হাক্সলে আরো দেখিয়েছেন সরকারের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও নজরদারি কেমনভাবে জনগণের স্বাধীনভাবে চিন্তার ইচ্ছাটুকুও কেড়ে নেয় এবং তাদের নিজেদের গোষ্ঠীগত এবং ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কেও উদাসীন করে ফেলে। এক কথায় সরকারি প্রচার ও নজরদারিতে জনগণের মগজ ধোলাই হয় সম্পূর্ণ। ওরওয়েল অবশ্যই খুশি হতেন যদি এখন উপস্থিত থাকতেন। তার কল্পনার বর্ণিত আর্থ-সামাজিক অবস্থা তার সময় সীমার অনেক আগেই এসে উপস্থিত।
অ্যাটউড তার ‘হ্যান্ডমেইডে’ দেখিয়েছেন স্বার্থপর ক্ষমতালোভীরা ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই প্রচারের ব্যাপক ব্যবহার করে জনগণকে শিক্ষা দেয় ‘তাদের দায়িত্ব কী এবং জীবনব্যবস্থায় তাদের স্থান কোথায়।’ জনগণের অধিকার রক্ষার কথা বলে, সরকার প্রথমেই জনগণের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে এবং জনগণকে বুঝতে বাধ্য করে যে তারা আনন্দে আছে, সুখে আছে। জনগণ সরকারকে মানলে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা হবে।
‘মাইনরিটি রিপোর্ট’ ছবিটি স্পিলবার্গ নির্মাণ করেন ২০০২ সালে। কিন্তু সেখানে যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা বর্তমানের অবস্থা অপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে; প্রযুক্তি কেমন করে সরকারকে প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে খবর রাখতে সাহায্য করছে, রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’র নামে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে এক ুদ্র গোষ্ঠী কেমন করে সর্বময় ক্ষমতার ঊর্ধ্বে ওঠে। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। কেউ এই অসহনীয় অবস্থার প্রতিবাদ করলেই ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রিত নানা বাহিনী প্রতিবাদকারীর মাথা উড়িয়ে দেয়। আবার প্রতিপক্ষ বা সমালোচনাকারীরা কোনো ‘অশান্তি ঘটাতে পারে’ বলে অভিযোগ দিয়ে সম্ভাব্য প্রতিবাদের সম্ভাবনাকেও সরকার নিশ্চুপ করছে। অ্যাটউড দেখিয়েছেন সরকারি এই দমন ও পীড়ন নীতিই জন্ম দিচ্ছে অশান্তি। সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবাদের। আবার কৌশলে প্রতিবাদের সৃষ্টি করে পীড়নে মাত্রা বাড়িয়ে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করছে।
স্পিলবার্গ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কঠিন নজরদারির মাঝ দিয়ে শুধু চিন্তার স্বাধীনতাই কেড়ে নেয়া হবে না, চিন্তা করার নিয়মটাও বেঁধে দেয়া হবে। তার বাইরে কেউ চিন্তা করলে বা কিছু বললে ‘আইন’ কার্যকর হবে, যে আইন তারা নির্মাণ করেন।
এখানে বাংলাদেশের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পরপরই এক সাংবাদিক তৎকালীন আইনমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখেন, মন্ত্রী কাজে ব্যস্ত। কী কাজ করছেন জানতে চাইলে, মন্ত্রী জানান আইনের ভাষার পরিবর্তন করছেন। আইনে যেখানে পাকিস্তান আছে, তা কেটে বাংলাদেশ করছেন। সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন এতে ডুপ্লিকেশন বা সমস্যা কিছু হচ্ছে কি না। তার জবাবের অনেক কথার মাঝে এক মজার মন্তব্য করলেন। তিনি বললেন, ‘আসলে এসব ব্রিটিশ আইন। ভারত ও পাকিস্তান সেই আইনে তাদের নিজেদের নাম বসিয়েছে। ব্রিটিশ অতি স্বল্পসংখ্যক আইন দিয়ে বিশাল ভারত শাসন করত। এগুলো আগামী ৫০০ বছরেও পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়বে না। তাকে সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে আপনাদের (অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি বলে পরিচিত ব্যক্তিদের) কী কাজ হবে।’ তিনি হেসে জবাব দিলেন, ‘কেন প্রতিপক্ষ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইন দরকার সেগুলো সৃষ্টি করব। আসলে ভারত ও পাকিস্তান তো এ কাজই করেছে।’ উল্লেখ্য আইন নির্মাণ এবং ব্যবহারের ধারা এভাবেই এখনো চলছে।
স্পিলবার্গ তার মাইনরিটি রিপোর্টে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মুখের ছবি, চোখের ছবি নেয়া হবে, তাদের জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য ফাইলবদ্ধ থাকবে, মানুষের আচার-ব্যবহারের ধরন নির্ণয়ের সফটওয়ার হবে, যাতে করে সরকার কোনো জনগোষ্ঠী কী চাইতে পারে বা কোনো প্রতিবাদ করতে পারে কি না, তা আগেই জানতে পারবে।’ রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট জন ডাবলু হোয়াইটহেড এই ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর মন্তব্যে বলেছেন, স্পিলবার্গের ধারণার অনেক আগেই প্রযুক্তিগুলোর জন্ম হওয়ায় সেই ভয়াবহ অবস্থা বিশ্বে সর্বত্রই বিরাজ করছে। ‘ক্ষমতাবানেরা যত স্বৈরতান্ত্রিক হবে এর ব্যবহারও হবে তত নিবিড়’। তার এই মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। ‘ক্ষমতাবানদের সামান্যতম নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত হলে তারা এই রাষ্ট্রীয় শাসন-শোষণ এবং নির্যাতন তীব্র করবে এবং জনগণকে তাদের দাস বানাবে।’ নানা উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কেমনভাবে বিশ্বের প্রতিটি দেশে এর ব্যবহার হচ্ছে এবং তার প্রধান বাহন হলো ‘অনির্বাচিত আমলারা’ যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হয়ে সব ক্ষমতা ভোগ করছে। স্পিলবার্গ প্রশ্ন করেছেন ‘টেলিফোনে আড়ি পেতে যে কথা শোনা হচ্ছে, তার কতটুকু জনগণ নির্বাচিতরা জানেন এবং কতটুকু অনির্বাচিত আমলারা শোনায়। আর তার কতটুকু সত্য?’
ফারেনহাইট ৪৫১ ছবিটি নির্মাণ করেন ফ্র্যাঁসোয়া ট্রুফো (১৯৬৬)। এই নামের বইটি লিখেন রে ব্রাডবারি। এখানে দেখানো হয় ভবিষ্যতে মানুষ বই পড়বে না এবং যা পড়বে তা হবে অনুমোদিত। আর অনুমোদনহীন বই পুড়িয়ে ফেলা হবে। এ জন্য সরকার বিশেষ ডিপার্টমেন্ট খুলবে যারা এর ওপর নজরদারি করবে। উদ্দেশ্য জনগণকে নির্ধারিত পথে ভাবতে হবে। আসলে ৪৫১ ফারেনহাইটে কাগজ সহজেই পোড়ে বলে এই নামকরণ। ট্রুফোর বর্ণনার কর্মকাণ্ড এখন প্রতিদিনের জীবন।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হলো প্লানেট অব অ্যাপস। ১৯৬৮ তে নির্মিত এই ছবিটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন র শারলিং। পিয়েরে বুলে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। প্রধান চরিত্র অ্যাস্ট্রনট টেলরের উড়োজানকে মহাশূন্যের এক গ্রহে ক্রাস ল্যান্ড করতে হয়। তিনি দেখেন সেখানে বানরেরা মানুষকে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করছে। নানা অনুসন্ধান ও ঘটনার মধ্যে টেলর জানতে পারেন যে, উপগ্রহে একসময় মানুষেরাই শাসন করত বানরদের। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নয়নের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিলে বানরেরা প্রাধান্য পায়। তারপর আরো অনুসন্ধান করে দেখেন সেই গ্রহই হলো পৃথিবী। টেলর শেষে ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘বোকারা, পাগলেরা নিজেদের আর কতভাবে ধ্বংস করবি?’ সারলিং জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কেউ কি এই বার্তা নিচ্ছে?’
এই সামাজিক অবস্থার বর্ণনা আছে আর একটি চমৎকার ছবি ১৯৮৮ নির্মিত দ্য লিভে। ছবিটি একটা স্যাটায়ার হলেও বর্তমানকালের সুন্দর চিত্র। নির্মাতা জন কার্পেন্টার যে দু’টি শব্দ প্রতিষ্ঠার আবহাওয়া আজকের বিশ্বে অত্যন্ত প্রকট তাই চিত্রায়িত করেছেন। শব্দ দু’টি হলো ‘ওবে’ (আজ্ঞাপালন) ও কনফর্ম (অনুসরণ বা খাপ খাওয়া)। এই আবহাওয়াতে বিশ্বের সব মানুষ দু’টি শ্রেণীতে আবদ্ধÑ আন্ডার কাস (নি¤œ শ্রেণী) ও ক্ষমতাবান। অর্থাৎ ‘বিশ্বের সবাই নি¤œ শ্রেণীর ক্ষমতাবান ছাড়া।’
কম্পিউটার কেমনভাবে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে তার চমৎকার চিত্রায়ণ হয়েছে দ্য ম্যাট্রিকস (১৯৯৯) ছবিতে। শুধু ব্যতিক্রম হলো মাট্রিকসে কল্পনা করা হয়েছে ঘটনাটি ঘটবে ২১৯৯ সালে। অথচ এখনি কম্পিউটার মানবজীবন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন উন্নত দেশে এর অনেক ব্যবহার এখনো গোপন। ২০০২ সালেই স্পিলবার্গ তার মাইনরিটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয় হবে। অর্থাৎ কম্পিউটার এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি নিজে ভাববে, কর্মসম্পাদন করবে। অন্য কথায় পুলিশি রাষ্ট্র বিরাজ করবে সর্বত্র। হোয়াইটহেড প্রশ্ন করেছেন, ‘আমরা কি এখন সে অবস্থার মধ্যে নেই?’
রাষ্ট্রের দুর্নীতির চমৎকার ছবি পাওয়া যায় ভি ফর ভেনডেটা (২০০৬) ছবিতে। এখানে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচার শাসক গণতন্ত্রের লেবাসে শাসন করে গোপন পুলিশ দিয়ে। এখানে প্রধান বার্তা হলো, ‘স্বৈরাচার শাসক তার দমননীতি দিয়ে শুধু প্রতিবাদীই তৈরি করে যাদেরকে নিজের শত্রু মনে করে।’ আর এই প্রতিবাদী শত্রুর নাম দেয়া হয় সন্ত্রাসী। এবং এদের সব কর্মকাণ্ডকে সহিংসতা বলে অভিহিত করে সরকার নিজেই সহিংস নির্মূল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হয়। এর ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের নিজেদের অধিকারের অনুভূতি সৃষ্টির প্রয়াসে নির্মিত এসব ছবি, আন্দোলন এবং বক্তব্য কোনো ফল দিচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন হোয়াইটহেড। প্রধান কারণ প্রযুক্তি ক্ষমতাবানদের দখলে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। অনুসন্ধান এবং আলোচনায় এ কথা বারবার উঠে এসেছে, সরকারি বা ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর অধিকাংশ কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য নিজেদের সেবা করা, ক্ষমতা পোক্ত করা। জনকল্যাণ নয়। জনকল্যাণ বলে যে ছবি আঁকা হয়, সেখানে জনগণের কোনো উপস্থিতি নেই। তাদের উপস্থিত করা হয় শুধু হাততালি দেয়ার জন্য। এ চিত্র চলমান এবং এর অবসান হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই জর্জ ওরওয়েল ুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘যদি ভবিষ্যতের চিত্রটি দেখতে চাও, তাহলে কল্পনা করো এমন অবস্থা যেখানে একটি জুতা বারবার মুখে আঘাত করছে।’ আশার কথা হলো স্বৈরাচার এবং দুর্নীতিবাজরা সব শেষে নিজেরাই আক্রান্ত হয়, অবশ্য জনগণের বিশাল ক্ষতি হওয়ার পরে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235983