১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৭:৪০

সমাজ যে পথে হাঁটছে

হারুন-আর-রশিদ

সমাজ এখন যে পথে হাঁটছেÑ সে পথটি সরল নয়, অসরল বা বক্র। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি যতটুকু ছিল তা এখন ‘ঋণে আক্রান্ত’ বা গচ্ছিত বস্তু। বিবেক-বুদ্ধিহীন সমাজে আমরা বিচরণ করছি। শত বছর আগে সমাজে আজকের মতো চাকচিক্য ছিল না। তবে ছিল স্বস্তি ও শান্তিÑ মিল ও মহব্বত। একান্নবর্তী বা যৌথ পরিবারভুক্ত সমাজে সে সময়ে যে শান্তি বিরাজ করত, তার এক দশমাংশও স্বামী-স্ত্রী শুধু এ দু’জনের সংসারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘বুদ্ধি বেচে’ যারা জীবন ধারণ করেন, তারা নিজেরাও শান্তিতে নেই। এত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রাস্তার অলিতে গলিতে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও যে হারে বাড়ছে, শত বছর আগে এত চাকচিক্যময় স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাসনালয় ছিল না। ডিগ্রিধারী মহাপণ্ডিত ব্যক্তিদের এত আধিক্য সে সময় ছিল না। বইপুস্তকে ছোটবেলায় পড়েছি, পাঠশালা বাড়লে সেই সমাজ দ্রুত উন্নতি লাভ করে। বিদ্যাশিক্ষা প্রসার লাভ করলে সমাজে শান্তি বিরাজ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখছি সবই উল্টো দিকে ধাবমান। মানুষের খাওয়া, পরার কোনো অভাব নেইÑ কিন্তু পরাস্ত হয়েছে শান্তি। আমরা যদি সমাজের হালহকিকত নিয়ে জরিপ চালাই, তাহলেই এর সত্যতা খুঁজে পাবো।
২.
রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পরের দিন ছিল ঈদ। এই ঈদের দিন আমার এলাকায় মসজিদসংলগ্ন একটি রাজনৈতিক দলের অফিস চত্বরে ড্রাম পিটিয়ে হিন্দি সিরিয়ালের অর্ধনগ্ন ছায়াছবির যে উৎসব চলছিল ঈদের সাথে এর কোনো মিল তো ছিলই না, বরং এলাকাবাসীর রাতের ঘুমটাও নষ্ট করে দিয়েছে শিক্ষিত হিসেবে অভিহিত কিছু লোক। উন্মুক্ত রাস্তায় এসব কুৎসিত দেখেও আমরা যাদের বিবেকবান মানুষ বলি তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিল কেউ বা কারা। ওই দিন একজন মানুষও এর প্রতিবাদ করেনি। এটা সাহসের অভাব, নাকি ঈমানের ঘাটতি বা বিশ্বাসের খরা? ধর্মীয় কিতাবে আছে অসৎ কাজের নিষেধ এবং সৎ কাজের আদেশ এটাই খাঁটি বিশ্বাসীদের চরিত্রের মূল বিষয়।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সৎ কাজের আদেশের নানা ফিরিস্তি বয়ান করবÑ অন্য দিকে যেসব অসৎকাজ সমাজে ক্যান্সারের মতো, ঘাতক ব্যাধির মতো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে নীতিকথা প্রচারকদের মেঠো বক্তৃতা ছাড়া ভূমিকা নেই। হজরত মুহাম্মাদ সা: কোনো কাজ নিজে করে তারপর অনুসারীদের ‘হাতে কলমে’ শিখিয়ে দিয়েছিলেন। শান্তি তো আলাদিনের চেরাগ নয় যে, জ্বালিয়ে দিলেই সমাজে শান্তি এসে যাবে। সমাজে শান্তি আনতে প্রয়োজন একটি ব্যাপকভিত্তিক প্রোগ্রামের। মিশন ও ভিশন না থাকলে শুধু পুলিশ বাহিনী দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো।
সমাজে কিভাবে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, কারা এর মদদদাতা, প্রশ্রয়দানকারী ও আশ্রয়দাতা তাদের চিনতে-জানতে হবে। কারণ তাদের লক্ষ্য সমাজকে কলুষিত ও দূষণযুক্ত করা। একশ্রেণীর গণমাধ্যম এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের গুরু হলোÑ ভোগবাদী, ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। সমাজকে ভোগের মাধ্যমে আচ্ছন্ন করে ফেলতে না পারলে, বিবেককে পচনশীল বস্তুতে পরিণত করতে না পারলে, তাদের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, তা বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। এ জন্য তারা গণমাধ্যম ও প্রযুক্তিকে পুঁজি করে পরিস্থিতি আজকের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। অশালীনতা নির্লজ্জতা এখন সর্বত্র দৃশ্যমান। কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য ভিডিও করে স্মার্টফোনে ডাউনলোড করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস কারা করছে, কলকাঠি কারা নাড়ছে? তারা নিশ্চয়ই সমাজের খেটেখাওয়া গণমানুষ নয়। তারা হলেনÑ সমাজের একশ্রেণীর বিত্তশালী ব্যক্তি। কত টাকা যে তাদের আছে, হয়তো তারা নিজেরাও তা জানেন না। অর্থ যে অনর্থের মূল, সেটা শান্তি লুন্ঠনকারীদের আচরণ থেকে বোঝা যায়। সীমাহীন অর্থবিত্তের মালিক হলে সে দিশেহারা হয়ে যায়, তখন প্রকৃত শান্তি তার জীবন থেকে উধাও হয়ে যায়। মানুষ যখন টাকার গোলাম হয়, তখন সে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। একজন ধনাঢ্য মানুষের কথা মনে পড়ল। ৩০-৩২ বছর বয়সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও একজন। ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। এত অল্প বয়সে এমন এক ম্যাজিক বক্স যার নাম ফেসবুক, আবিষ্কার করে অঢেল অর্থের মালিক হলেন বটে, কিন্তু একদিক দিয়ে সমাজে লাভের চেয়ে ক্ষতির অঙ্কটা বাড়িয়ে দিলেন। আজকাল বাস, ট্রেন, লঞ্চ-স্টিমার ও বিমানসহ সব জায়গায় উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে স্মার্টফোন। তারা বেশির ভাগ সময়ই ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে ফেসবুক চালাচালি করছে। কী দেখছে? অনেকেই দেখছে, নারী-পুরুষের বিকৃত রুচির সব ভিডিও-অডিও। আনেকের ছেলেমেয়ে আজকাল দরজা বন্ধ করে রাত জেগে এসব নষ্টামির দীক্ষা নিচ্ছেÑ যার প্রতিফলন ঘটছে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমাজের আনাচেকানাচে। ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীদের ৯০ শতাংশ বাংলাদেশে বাস করে। এমন একটি দেশে প্রতিদিন ঘটছে ধর্ষিত শিশু ও নারীর বুকফাটা আহাজারি, খুন, ব্যভিচার, জবরদখল ও লুণ্ঠন, নকল-ভেজাল, মজুতদারি প্রভৃতি।
অনেক অভিজ্ঞজন আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশে অনাচার-অবিচার, দুষ্টকর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণÑ কোনো কিছুতেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণটি শক্তভাবে আছে শুধু নিজের ক্ষমতার ক্ষেত্রে যাতে গদিটা নড়বড় হয়ে না যায়। অন্তত তৃতীয় মেয়াদ পর্যন্ত যাতে ক্ষমতায় নিরাপদে থাকা যায় শুধু এ জন্য ক্ষমতাসীনরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সমাজ ধ্বংস হয়ে যাক, বিকৃত মিডিয়া ও ইন্টারনেটে যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাক, শত শত মা-বোন ধর্ষিত হোক, পর্নো ছবিতে দেশ ভরে যাকÑ তাতে যেন কিছু যায় আসে না। কিছু লোক ভাবছে, বর্তমান প্রজন্ম যদি এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে রাজনীতি থেকে তারা দূরে থাকবে। অতীতে এসব প্রযুক্তি না থাকার কারণে তাদের বিবেক স্বচ্ছ ছিল বলে তারা সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর ছিল।
একজন বয়স্ক মানুষ তাকে চিনি না, হঠাৎ আমাকে বললেন, ভাই বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোনো অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে কি, যার শরীরে ভিন্ন পুরুষের হাত লাগেনি? আমার ছেলের জন্য এরকম একজন মেয়ে খুঁজছি। বয়স্ক মানুষটি সমাজচিত্র অবলোকন করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অসুস্থ সমাজব্যবস্থা আমাদের নিরপরাধ সন্তানদের সুস্থ থাকতে বাধা দিচ্ছে বলেই ষাটোর্ধ্ব মানুষটি সরলভাবে কথাটি বলেছেন। মানুষ যে আজ কতটা কষ্টে সময় পার করছেÑ তা ভেতরে গুমরে উঠছে, চেহারায়ও তা ভেসে উঠছে; কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। ভালো মানুষদের বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে দুষ্টচক্র রাজনীতিবিদ, ক্ষমতার পালাবদলকারী শক্তি ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা শক্তি।
অশান্তির আভিধানিক অর্থ অনেকÑ যেমন, শান্তির অভাব। সব আছে মনে শান্তি নেই তবুও। সন্ত্রাস, অত্যাচার, মানসিক পীড়া ও অস্থিরতা, কলহ, বিবাদ, দুর্নীতি, অশ্লীলতা, উদ্বেগÑ এসব উপসর্গ বাংলাদেশে প্রবল থেকে প্রবলতর রূপ নিয়েছে। উত্তাপহীন রাজনীতি তারপরও হুঙ্কার দিচ্ছে একে অপরকে। সবার মধ্যে অবিশ্বাস কাজ করছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। আমরা এখন অজানা পথের যাত্রী। বাহ্যিকভাবে সব কিছুই ঠিকঠাক মনে হলেও মানুষের অন্তরে শান্তি নেই। মিথ্যা বলা মহাপাপ, এটা আমরা সবাই জানি, তারপরও মিথ্যার ফুলঝুরি। মসজিদ-মন্দিরে মানুষের অভাব নেই, তারপরও বলতে হয়Ñ সত্য পলাতক। আগে ছিল না এত বাহারি সাজসজ্জা। কিন্তু মানুষ আজকের মতো এত জটিল ছিল না। মানুষের মধ্যে একটি সরলতা আগে ছিল, এখন তা সোনার হরিণে রূপ নিয়েছে। নিঃস্বার্থ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ছেলে বাবাকে খুন করছে। মাকে খুন করছে শিশুকন্যা। কিছু বললেই অনেকের ছেলেমেয়ে বলেÑ তোমরা আগের যুগের মানুষÑ তোমরা জানো না কিছু; আমরা যা বলি তা শোন। আমার পছন্দ মতো বিয়ে করব। এসব শুনে মা-বাবা নীরব। অনেক বাবা-মা ভুগছে আজ নিজেদের দোষে। সন্তানদের বড় কী পদ্ধতিতে করতে হয় জানতে হবে, সেটা যদি শিশুবয়স থেকে শুরু করা না যায়, তাহলেই সমস্যা।
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সূত্রের জনক আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু, আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ।’ ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো ঝগড়া নেই। এই ঝগড়া মনুষ্যসৃষ্ট। তারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে বিবাদ লাগিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। বাংলাদেশের চারটি জেলায় পাহাড়ধসে ১৫৭ জন মানুষ প্রাণ হারাল, সেটাও মানবসৃষ্ট। প্রকৃতিবিনাশী কর্মকাণ্ড ঘটলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ চার জেলায় ভয়াবহ ভূমিধস। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেছেনÑ পৃথিবীতে খারাপ যা কিছু ঘটে, তা সবই মানুষের কর্মফল।
লেখক : গ্রন্থকার ও কলামিস্ট
Em-harunrashidar@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235982