তারিক সালমন
২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:০১

ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি ছিল না!

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়াই বরগুনার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমনের বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার মানহানি মামলা করেছিলেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ। অবশ্য দেশজুড়ে সমালোচনা এবং দল থেকে বহিষ্কারের পর গতকাল রোববার তিনি মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন।

এদিকে মানহানির মামলায় বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাবেক ইউএনও গাজী তারিক সালমনের জামিনের আবেদন একটিবারের জন্যও নামঞ্জুর হয়নি উল্লেখ করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) মোহাম্মদ আলী হোসাইন। ওই মামলার নথিসহ ব্যাখ্যা গতকাল সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে পৌঁছেছে।
বরিশালের আদালত সূত্র বলেছে, বঙ্গবন্ধুর ‘বিকৃত’ ছবি দিয়ে নিমন্ত্রণপত্র ছাপানোর অভিযোগ এনে গত ৭ জুন ওবায়েদ উল্লাহ মানহানির মামলাটি করেন। গতকাল মামলাটির দিন ধার্য ছিল। বাদী আদালতে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন করেন। এ নিয়ে শুনানির সময় বরিশালের মহানগর অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম অমিত কুমার দে বাদীর উদ্দেশে বলেন, ‘মামলা করার সময় আপনি আদালতে বলেছিলেন মামলাটি করার জন্য আপনার কাছে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের অনুমোদন আছে এবং তা আপনি পরবর্তী সময়ে আদালতে দাখিল করবেন। আপনি যেহেতু জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, এ জন্য আপনার ওপর আস্থা রেখে ওই দিন মামলাটি গ্রহণ করে আসামির বিরুদ্ধে সমন জারি করা হয়েছিল। কিন্তু অঙ্গীকার করেও আপনি পরবর্তী সময়ে তা আদালতে দাখিল করেননি। এ জন্য আপনাকে শোকজ করা হচ্ছে, কেন তা দাখিল করেননি, বলুন।’ এ সময় ওবায়েদ উল্লাহ বলেন, ‘পরে সেই সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই ব্যক্তিগতভাবে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছি।’
পরে বিচারক ২৪৮ ধারায় অভিযোগ থেকে ইউএনও তারিক সালমনকে অব্যাহতি দিয়ে মামলাটি খারিজ করেন। ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে তারিক সালমনকে অব্যাহতি দেওয়ায় তিনি গতকাল আদালতে যাননি।
অনেকে ইউএনওর পাশে
১৯ জুলাই তারিক সালমন একা রিকশায় চড়ে এই মামলায় হাজিরা দিতে বরিশালের আদালতে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াতে চাননি। তাঁর জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন অন্তত ৫০ জন আইনজীবী। ওই আইনজীবীদের মধ্যে স্থানীয় এক সাংসদও ছিলেন। কিন্তু গতকাল পরিস্থিতি যেন বদলে যায়। অনেকেই তাঁর প্রতি সহানুভূতি নিয়ে আদালতে আসেন।
বেলা ১১টার দিকে আদালত ভবনে আসেন বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. নূরুল আমিনসহ বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
যা বললেন বাদী
মামলা প্রত্যাহারের পর ওবায়েদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছিলাম। নিজে থেকেই তা প্রত্যাহার করেছি।’ তাহলে মামলা প্রত্যাহার করলেন কেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি এটা কোনো শিশুর আঁকা ছবি। পরে যখন বুঝতে পারি, তখন ভুল ভাঙে এবং মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিই।’
ছয় পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার
বরিশাল আদালত পুলিশের ছয় সদস্যকে গত শনিবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁদের পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, ইউএনও তারিক সালমনকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় তাঁদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে বরিশাল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মুখপাত্র সহকারী কমিশনার মো. নাছির উদ্দিন বলেন, প্রশাসনিক কারণে তাঁদের প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যাহার হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন আদালতে মেট্রোপলিটন গার্ডদের ইনচার্জ উপপরিদর্শক নৃপেন দাস, এএসআই শচীন মণ্ডল ও মাহাবুল, কনস্টেবল জাহাঙ্গীর হোসেন, হানিফ ও সুখেন।
বিচারকের ব্যাখ্যা রেজিস্ট্রারের দপ্তরে
সূত্র বলেছে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তরে গতকাল ওই মামলার নথিসহ বরিশালের সিএমএম মোহাম্মদ আলী হোসাইনের ব্যাখ্যা পৌঁছেছে। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘আদালতের কার্যপ্রণালি শেষে এজলাস ত্যাগ করে খাসকামরায় এলে শুনি ইউএনওর জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে মর্মে অনলাইন মিডিয়ায় সংবাদ করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর জামিনের আবেদন একটিবারের জন্যও নামঞ্জুর করা হয়নি। ফলে জেলহাজতে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না।’
সংশ্লিষ্ট মামলার নথিপত্র ও ব্যাখ্যা পৌঁছার বিষয়টি নিশ্চিত করে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. সাব্বির ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, ওই বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মামলার নথি ও পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। স্ক্যান করে ওই মামলার নথি পাঠিয়েছেন বরিশালের মুখ্য মহানগর হাকিম, সঙ্গে ব্যাখ্যা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। সোমবার বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে মূল নথি পাঠাবেন। ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, ইউএনওর জামিন নামঞ্জুর করা হয়নি। জামিন নামঞ্জুরের ঘটনা ঘটেনি বলে নথি পর্যালোচনায়ও দেখা যায়।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর দুই পৃষ্ঠার ওই চিঠি পাঠানো হয়। এতে মোহাম্মদ আলী হোসাইন বলেছেন, শুনানি চলাকালে ইউএনওর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তিনি শুনানি মুলতবি করেন এবং ইউএনওর কৌঁসুলিকে আবেদন অনুসারে কাগজপত্র দাখিল করতে বলেন। মৌখিক আদেশ দেন, কাগজ দাখিলের পরে পুনরায় শুনানি হবে। তিনি ইউএনওকে আদালতকক্ষে বসতে বলেন। ইউএনওকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে আদালতের কক্ষে বসানোর জন্য এক দরজা দিয়ে বের করে বারান্দা দিয়ে অন্য দরজা দিয়ে আদালতকক্ষে আনতে হয়েছে। এই সময়ে মিডিয়ার কর্মীরা বা অন্য কেউ কোনো ছবি তুলেছেন কি না, তা দেখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
জামিন মঞ্জুর বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, পরে ইউএনওর পক্ষে কাগজ দেওয়া হলে জামিন প্রদান করা হয়।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1263361/