২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৫৯

ঢাকার সাত কলেজের পরীক্ষা

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধেই সংকট

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে আটকে আছে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ। মূলত এই দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী তাঁদের সঙ্গে থাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছেন।
কয়েক দিন ধরে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকায় দুই কর্তৃপক্ষের বিরোধের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় দুটির কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল রোববার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সাত কলেজের চলমান এই সংকট নিরসনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকালও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করেছেন।
দুই উপাচার্যের দ্বন্দ্ব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য থাকাকালে অধ্যাপক হারুনের ছেলেকে জিন প্রকৌশল বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেওয়া, সিন্ডিকেট নির্বাচনে নীল দলের হেরে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের জের ধরে ২০১২ সালের ৫ জুন তিনি পদত্যাগ করেন। অবশ্য হারুন-অর-রশিদ তখন বলেছিলেন, শিক্ষা ও গবেষণায় আরও বেশি মনোযোগ দিতে চান বলে পদত্যাগ করেছেন। পরের বছরের মার্চে তাঁকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়। এখন সেখানে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। আরেফিন সিদ্দিকেরও দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিভিন্ন ইস্যুতে দুই উপাচার্যের বিভিন্ন মন্তব্য-বিবৃতিতে তাঁদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি একাধিকবার উঠে আসে। সাতটি কলেজকে অধিভুক্ত করার পর এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিযোগ করেন, ‘খাতা না দেখেই চূড়ান্ত ফল দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।’ পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই বক্তব্যের সমর্থনে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে বলে। অন্যথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
গতকাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কার্যক্রম অসম্পূর্ণ থাকা অবস্থায় সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রসঙ্গ কখনো তোলেনি। অসহযোগিতার কথা উঠবে—এটা ভেবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
তবে এই সিদ্ধান্ত যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মনঃপূত ছিল না, তা প্রকাশিত হয় জনসংযোগ, তথ্য ও পরামর্শ দপ্তরের পাঠানো ওই বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তাগিদ ও সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় এ বছর সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষদের সভায় কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও তখন পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২ বহাল ছিল এবং এখনো এর সংশোধন করা হয়নি।
এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পরই কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধিভুক্ত কলেজগুলোর মতোই নতুন কলেজগুলো পরিচালিত হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার কথা বলছে, তা কোনো সমস্যাই নয়। এটি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যেকোনো আন্দোলনের একটি প্রক্রিয়া থাকে। কোনো সমস্যা হলে তারা নিজ কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে কথা বলবে। সেখানে সমাধান না পেলে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলবে। তা না করে রাস্তা অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পেছনে কারও ইন্ধন থাকতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে মিথ্যাচার করছে, এরপর আর চুপ থাকা যায় না। তারা নিজের দোষ অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে।’
ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘এটি ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্বের বিষয় নয়। দুই লাখ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব তারা নিয়েছে। কিন্তু তাদের কী প্রস্তুতি ছিল? ১৯৯২ সালের আইন বলবৎ থাকতে তারা এক বৈঠকে কলেজগুলোকে কীভাবে অধিভুক্ত করে নেয়? শিক্ষার্থীদের তথ্য দিইনি—এমনটা বলে থাকলে সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে কোন তথ্য আমরা তাদের দিইনি, কোথায় সহযোগিতা করিনি।’
অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘আমি নাকি ষড়যন্ত্র করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়েছি। এমন কথাও এসেছে। এটা মোটেও সত্য নয়।’
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠি চালাচালি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, সাতটি কলেজের চারটি বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য চারটি সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সব তথ্য না পাওয়ায় তাঁদের রেজিস্ট্রেশন, ফরম পূরণ, ভর্তিসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন তথ্য চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চারবার ও কলেজগুলোকে দুবার চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, চিঠির উত্তর না পাওয়ায় তারা ফল প্রকাশ ও পরীক্ষার সময়সূচি চূড়ান্ত করতে পারছে না। গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসহযোগিতার কারণে পরীক্ষার তারিখ ও ফল ঘোষণা করতে দেরি হচ্ছে।
গত ১৩ এপ্রিল, ২৫ মে এবং সর্বশেষ ২ জুলাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু গতকাল পাল্টা বিবৃতিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক কথা বলছে না। যদি তথ্য না পাওয়া গিয়ে থাকে, তাহলে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার রুটিন কীভাবে দিচ্ছে?
কর্মসূচি অব্যাহত
রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে গতকালও নিজ নিজ কলেজে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছে। তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রতিনিধিদলের ওই সদস্যরা আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের পছন্দমতো শিক্ষার্থীদের সেখানে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ চলমান এই সংকট সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কলেজগুলো নেওয়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আগ্রহ ছিল। এ জন্য আমরা প্রথম সাতটি কলেজ তাদের দিয়েছি। উপাচার্য বলেছেন, তিনি সব ব্যবস্থা করতে পারবেন।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন আছি। আশা করছি, দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1263406/