২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৫২

ইয়াবার ছোবলে বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ইয়াবা নামে মাদকের ছোবল মারাত্মক আকার নিয়েছে। এখন সরকারি হিসাবেই দেশটিতে দিনে সেবন হয় ২০ লাখ ইয়াবা বড়ি। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে স্রোতের মতো ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। যেখানে ২০১০ সালে ৮১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে আটকের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন কোটি। মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিসহ কিছু অপরাধী গোষ্ঠী ইয়াবা বিস্তারের প্রধান রুট করেছে বাংলাদেশকে। 

২০১২ সালে চীন-থাইল্যান্ডের ‘মেকং সেফ’ চুক্তির পর থাইল্যান্ডে ইয়াবা পাচার কঠিন হয়ে গেলে এই অপরাধীরা বাংলাদেশকে টার্গেট করে এবং এখনো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে এ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ ইয়াবায় আসক্ত হয়ে নিজেদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কম্বোডিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক নাথান এ থম্পসন মিয়ানমার ও বাংলাদেশে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন। গতকাল রবিবার প্রতিবেদনটি ছাপা হয়। জাপানের নিকেই এশিয়ান রিভিউ সাময়িকীতে ‘বাংলাদেশে ইয়াবা সমস্যা’ শীর্ষক ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কোথা থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে, কারা এর মরণ ছোবলের সবচেয়ে বড় শিকার ইত্যাদি বিষয় সবিস্তারে তুলে ধরা হয়।
সাংবাদিক নাথান এ থম্পসন বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ৮১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করে। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিন কোটিতে দাঁড়ায়। গত জুনে এক দিনেই বিশেষ বাহিনী চট্টগ্রাম উপকূলে মাছ ধরার একটি ট্রলার থেকে ১৫ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ২৮ লাখ ইয়াবার একটি চালানের কথা বাদ দিলে এর আগে এত বড় চালান আর ধরা পড়েনি। এসব তথ্য থেকেই অনুমান করা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এই মারণ নেশা করছে।
প্রতিবেদনে সরকারি সূত্র ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ২০ লাখ ইয়াবা সেবন করা হয়ে থাকে। মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের সমন্বয়ে তৈরি ইয়াবা ট্যাবলেটটির সেবন বাংলাদেশে শুরু হয় ২০০৬ সালের দিকে। এর আগে একশ্রেণির তরুণ গাঁজা বা হেরোইনের নেশায়ই বুঁদ থাকত। তাদের কাছে এখন ইয়াবাই বেশি প্রিয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদনটিও ২০১৩ সালের। এতে বলা হয়, ‘প্রথমদিকে অভিজাত শ্রেণির কিশোর ও তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যেই ইয়াবার নেশা চালু ছিল। বিশেষ করে ঢাকা শহরের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কিন্তু দ্রুত ইয়াবা স্মার্টনেস, ফ্যাশন ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। তরুণী মডেল, চলচ্চিত্রের নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ড্যান্সার এবং তারকা জগতের অনেকেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। ’
ফারহান নামের এক যুবক একসময় ইয়াবায় আসক্ত ছিলেন। গত দশকের গোড়ার দিকে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম এক অভিজাত স্কুলে পড়ার সময় ইয়াবার ফাঁদে পড়েন। ফারহান বলেন, ‘আমি ও আমার বন্ধু গাঁজা খেতাম। যখন আমরা জানতে পারলাম ইয়াবা উচ্চমার্গের নেশা দেবে—নতুন স্বাদটা গ্রহণ না করে পারিনি। ’
ফারহানের ব্যবহূত সেই ইয়াবা ছিল প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা। ২০১২ সাল নাগাদ বাংলাদেশে মিয়ানমারে প্রস্তুত ইয়াবার বন্যা বওয়া শুরু হয়। ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে ‘মেকং সেইফ’ চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য পাচার কঠিন হয়ে যায়। তখন তারা বাংলাদেশকেই মাদক পাচারের প্রধান রুট করে; এখনো তা বিদ্যমান। বাংলাদেশকে মিয়ানমারের চোরাচালানিরা সফট তথা সহজ টার্গেট বানিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের রয়েছে ২৫০ কিলোমিটার সীমান্ত। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্য মতে, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে ইয়াবা সরবরাহকারী দেশ এই মিয়ানমার।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মিসহ আরো অনেকে ইয়াবা উৎপাদক। আন্তর্জাতিক গবেষণা ও পরামর্শক সংগঠন ট্রান্সন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ টম ক্র্যামার নিকেই এশিয়ান রিভিউকে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠী আফিম ও হেরোইনের ব্যবসা ছেড়ে মোহাবেশ সৃষ্টিকারী মাদক (ইয়াবাজাতীয় নেশাদ্রব্য) তৈরি করছে। ’ মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াংগেল বলে পরিচিত এলাকার দেশ মিয়ানমার ও লাওসে এখন পপি উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক কমেছে। হেরোইন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে তাদের জায়গাটি নিয়ে নিয়েছে এখন অশান্ত ও আইনের শাসনহীন আফগানিস্তান। এ কারণেই মিয়ানমারের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো ইয়াবা উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছে। ইয়াবা তৈরিতে ঝুঁকিও কম। ক্র্যামার বলেন, ‘চাহিদা ও জোগান বৃদ্ধি ইয়াবার মতো মাদকের বিস্তারে প্রভাব ফেলছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনও এর জন্য দায়ী। একসময়ের গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ এখন নগর, শিল্প ও বাজারভিত্তিক সমাজে রূপ নিয়েছে। ’
নিকেই এশিয়ান রিভিউর হয়ে সাংবাদিক নাথান এ থম্পসন কক্সবাজারের বেশ কিছু কর্মকর্তা ও মাদকবিরোধী স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গেও কথা বলেন। তিনি দেখেন, স্থানীয় অনেকে ইয়াবা মাদক সমস্যার জন্য কিছু অশুভ শক্তিকে দায়ী করেছে। কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনিন সারওয়ার কাবেরি বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার একটি ষড়যন্ত্রের অস্ত্র হচ্ছে ইয়াবা। ’ তাঁর এ বক্তব্যের মর্ম হচ্ছে, বাংলাদেশের পুরনো শত্রু হচ্ছে পাকিস্তান। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে ঈর্ষাকাতর। এ কারণে তারা তাদের মিত্র আমেরিকাকে দিয়ে মিয়ানমারের মাধ্যমে এ কাজ করাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে ইয়াবা উৎপাদন বন্ধে চাপ দিচ্ছে না। এ কারণেই আমাদের সন্দেহ যে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। ’ এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০১৬ সালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন রেকর্ড ৭.০৫ শতাংশ বাড়ে।
নোঙর নামে কক্সবাজারভিত্তিক একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলমও মনে করেন বাংলাদেশে ইয়াবা সমস্যার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। তিনি বলেন, ‘এর পেছনে পাকিস্তান রয়েছে। তারা আমাদের দেশের ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার পাঁচ কোটি তরুণ-তরুণী। এদের স্বাস্থ্য ও কর্মশক্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। ’ এই তত্ত্বের পেছনে অবশ্য ইতিহাস আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত বাংলাদেশিদের প্রতি মুহূর্তে কুরে কুরে খায়। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব মতে, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ৩০ লাখ লোক নিহত হয়। হাজার হাজার নারী সম্ভ্রম হারায়।
তবে ইয়াবার মরণ ছোবল বাংলাদেশি তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে ধ্বংস করছে তার একটা চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন হিসাব থেকে। ইনডেক্সমানডির তথ্য মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী। তাদের রয়েছে প্রচুর অবসর সময় এবং ওড়ানোর মতো নগদ টাকা, যা এর আগের কোনো প্রজন্মের ছিল না। ঢাকার সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষক হোসেইন মুহাম্মদ জাকি বলেন, এই জেনারেশনের মাদক হিসেবে প্রধান পছন্দ ইয়াবা।
বাংলাদেশ পুলিশ স্টাফ জার্নাল ২০১৫-তে লেখা এক নিবন্ধে হোসেইন মুহাম্মদ জাকি লেখেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে লোকজন ঠিক কিভাবে মাদকের কবলে পড়ছে তার কোনো তথ্য মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। ’ ‘ডেইলি স্টার পত্রিকার (২০১৩) মতে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬০ লাখ। এরা দিনে সাত কোটি টাকার বেশি মাদকের পেছনে খরচ করে। ২০১৪ সালে দেওয়া আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৫৩.২৭ শতাংশ তরুণ মাদকাসক্ত। ’
সিলেট শহরে সম্প্রতি চালানো এক জরিপ থেকে জানা যায়, মাদকাসক্তদের ৬৪ শতাংশ নেশার জন্য টাকা পায় তাদের পরিবার থেকে। একই ধরনের আরেকটি জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয় ঢাকার পুলিশ স্টাফ কলেজ জার্নালে। তাতে বলা হয়, ১৭ শতাংশ মাদকাসক্ত টাকা পায় পরিবার থেকে।
গত দশকের পর ইয়াবার দামও বেড়েছে। বর্তমানে একেকটি ইয়াবা ট্যাবলেট গুণগত মান ভেদে ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা দামে বিক্রি হয়। নোঙরের কর্ণধার দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের বহু লোক হতাশায় ভোগে। অনেকে সমাজের অন্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে পারে না। তাদের অনেকেই ইয়াবার মতো নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে উদ্যমী অনুভব করে। অনেকে যৌন লালসা থেকেও ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ’ রাশেদ জানান, তাঁর নিরাময়কেন্দ্র নোঙরে চিকিৎসাধীন মাদকাসক্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই ইয়াবাসেবী ছিল।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/07/24/523026