২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৪৯

হাওর এলাকায় বেশি বিপদে মধ্যবিত্ত

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধনপুর গ্রামের মধ্যবিত্ত কৃষক আবু বকরের চোখে এখন কেবলই অন্ধকার। এবার বোরো ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে হাওর এলাকার অন্য সবার মতো তাঁরও কাঁচা ও আধাপাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। গোলায় ধান নেই এক ছটাকও। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে আবু বকর এখন অসহায়। লজ্জায় বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। দুর্গতদের মধ্যে সরকারিভাবে যে ৩০ কেজি চাল এবং ৫০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে, সেই সহায়তা পেতে লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না; আবার কারো কাছে হাতও পাততে পারছেন না আবু বকর। অথচ ঘরে চাল নেই। বিষয়টি নজরে আসে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরীর। নিজ উদ্যোগে তিনি আবু বকরকে সরকারি সহায়তা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এহসান চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হাওরাঞ্চলের ওপর দিয়ে যে দুর্যোগ বয়ে গেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ। এরা কারো কাছে সহযোগিতা চাইতে পারছে না। সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিতেও আসছে না। তিনি বলেন, শ্রমিকরা কোথাও না কোথাও কাজ খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি তো তা-ও পারছে না।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সদর, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার বেশ কিছু এলাকা ঘুরে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ও ইসলামিক রিলিফ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করেছে। ব্র্যাক হাওরাঞ্চলে গো-খাদ্যের ব্যবস্থাও করেছে। এনজিও ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকেও নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমানোর। সব উদ্যোগ মিলিয়েও হাওরবাসীর সংকটের আশু সুরাহাই হচ্ছে না। স্থায়ী সমাধানের কোনো উদ্যোগই এখনো লক্ষ করছে না এলাকার মানুষ।
স্থানীয় লোকজন জানায়, এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়মের কারণে হাওরে ফসলহানি একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। হাওরের এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান পেতে হলে জরুরি ভিত্তিতে সুরমা, ধনু, কুশিয়ারা ও কালনী নদী খনন করতে হবে। সেটি করতে না পারলে আগামীবারও বোরো ধান ঘরে তোলার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না কেউ।
গত মার্চ মাসের শেষ দিকে কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে হাওরাঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্ষা শুরু হওয়ার পর পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে অনেকে। বিশেষ করে জ্বর ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। কাজের সন্ধানে হাওরাঞ্চলের অনেকে ঢাকা ও বন্দরনগর চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানদের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে।
হাওর এলাকার কৃষকদের দাবি, ধান আবাদ করতে গিয়ে তারা আগাম যে কৃষি ঋণ নিয়েছিল, সেই ঋণ মওকুফ করতে হবে। নতুন করে কৃষি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে কৃষি উপকরণ বিশেষ করে ধান, সার, বীজ—এসব দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী বলেন, কৃষি ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় অনেক কৃষক এরই মধ্যে এলাকা ছেড়েছে। এই ঋণ মওকুফ করা জরুরি।
স্থানীয় কৃষক বাকি বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাওরে জলমহাল ইজারা এ বছরের জন্য বাতিলের দাবি জানানো হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসন ইজারা বাতিল করেনি। তাহলে কৃষক কিভাবে চলবে?’ তিনি বলেন, হাওরে এখন কোনো কাজ নেই। অলস সময় পার করছে সবাই। বিকল্প কোনো কাজের ব্যবস্থা করতে তিনি সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
দিরাই উপজেলার কামাল হোসেন বরাম হাওরে ৬২ কিয়ার (৩০ শতাংশে এক কিয়ার) জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। কিন্তু জমি থেকে কোনো ধান তুলতে পারেননি তিনি। গো-খাদ্যের অভাবে এরই মধ্যে দুটি গরু বিক্রি করে দিয়েছেন মাত্র ২৭ হাজার টাকায়। অথচ স্বাভাবিক সময় থাকলে ওই দুটি গরু ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত বলে জানান তিনি। মোহাম্মদ সেলিম মিয়ারও একই অবস্থা। আত্মসম্মান বোধের কারণে কারো সহযোগিতা নিতে পারছেন না তিনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী।
তাড়ল ইউনিয়নে সবচেয়ে বড় বাজারের নাম ধল বাজার। ওই বাজারে বড় দুই দোকানের নাম মা ফ্যাশন ও ইব্রাহীম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। দুই দোকানের স্বত্বাধিকারী গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম। কোনো দোকানেই এবার বেচাকেনা নেই বললেই চলে। ঈদুল ফিতরের আগেও পুরো বাজার নীরব দেখা যায়। নিজেদের পরিবার চালানো নিয়ে এখন মহাদুশ্চিন্তায় গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম।
স্কুলে যাওয়া ছেড়ে কাজের সন্ধানে : হাওরাঞ্চলে দুর্যোগের কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। এলাকার সাধারণ মানুষ বলছে, যেখানে তিনবেলা মুখে অন্ন জুটানো এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ সেখানে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো অনেক দূরের হিসাব। তাই বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজতে অনেকে স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে কাজ খুঁজছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত আলোর দিশারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩২১। গত মার্চের আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পর থেকে ৪৮ জন শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে জানা যায়, ওই শিক্ষার্থীরা কাজের সন্ধান করছে। অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত ৩৩ জনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও বাকি ১৫ জন শিক্ষার্থী কাজের খোঁজে বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির শামীম আহমেদ, সপ্তম শ্রেণির ইব্রাহিম মিয়া, মার্জিয়া আক্তার, আয়েশা আক্তার, শ্যামল দেবনাথ ও লুবনা আক্তার।
মিজানুর রহমান নামের একজন অভিভাবক কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘরে চাল নেই। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এলাকায় কোনো কাজও নেই। তাই সন্তানকে বিকল্প আয়ের খোঁজে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তাড়ল ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহাবুদ্দিনের তিন সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করত। কোচিং খরচ ও মাসিক বেতন দিতে না পেরে তিন সন্তানকে এখন আর স্কুলে পাঠাচ্ছেন না তিনি।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২১ হাজার ৩৮১। হাওরের একমাত্র ফসল ডুবে যাওয়ার পর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। সুনামগঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় এ বছর প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এরই মধ্যে ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এ ছাড়া জেলায় চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ২০ হাজার ১২২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ১৬ হাজার ৩৬২ জন। দাখিল ও কারিগরি শিক্ষা মিলিয়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এখন তাদের কলেজে ভর্তি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে পরিবার।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/07/24/523046