২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৪৪

বহমান এই সময়ে

পুরনো পথেই নতুন সিইসির পা

জি. মুনীর

গত ১৬ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগামী সাধারণ নির্বাচন বিষয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, এই রোডম্যাপ খুবই সুন্দর ও বাস্তবসম্মত। সরকারের বাইরে থাকা সবচেয়ে বেশি জনসমর্থিত দল বিএনপির নেতারা বলছেন, তারা নির্বাচনের কোনো রোডই দেখতে পাচ্ছেন না, ম্যাপ তো দূরের কথা। এই রোডম্যাপে চলমান সঙ্কটের সমাধান হবে না। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। অন্য যেসব দল সরকারের বাইরে আছে, সেসব দলের বক্তব্য মোটামুটি একই ধরনের।
অপর দিকে, একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত খবরে বলা হয়েছেÑ দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত এই রোডম্যাপে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তাদের মতে, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসির কী ভূমিকা হবেÑ এ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। দীর্ঘ দিন ধরে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর ও অর্থবহ করার যে জনদাবি বিভিন্ন মহল থেকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই ইসির এই রোডম্যাপে। কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের বিষয়ে রোডম্যাপে নির্বাচনে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েও নেই তেমন কোনো বক্তব্য।
তাহলে ঘোষিত এই রোডম্যাপে কী আছে? আসলে ইসি এই রোডম্যাপের মাধ্যমে এর সাতটি আরাধ্য কাজের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানিয়েছে। এর মধ্যে আছে : আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কারের কাজ চলতি জুলাইয়ে শুরু করে শেষ করা হবে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে; নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার সাথে পরামর্শ চলবে ৩১ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত; সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ চলবে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত; নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি ও বিতরণ জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত; বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের কাজ ২০১৮ সালের জুন থেকে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত; নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা চলতি বছরের অক্টোবর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত; এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বাড়ানোর কার্যক্রম আগামী বছরের জুলাইয়ে শুরু হয়ে শেষ হবে ভোট নেয়ার এক সপ্তাহ আগে।
আসলে এগুলো নির্বাচন কমিশনের রুটিন কর্মকাণ্ড। এসব কর্মকাণ্ডকে রোডম্যাপ আখ্যায়িত করার পেছনে কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। আমরা জানি, নির্বাচন কমিশনের গঠন থেকে শুরু করে, এর দায়দায়িত্ব, জবাবদিহিতা এবং নির্বাচনসংক্রান্ত প্রতিদিনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড চলে আমাদের সংবিধান, ১৯৭২ সালের আরপিও (রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল’র ওর্ডার), ২০০৮ সালের নির্বাচনী আচরণবিধি (কন্ডাক্ট অব ইলেকশন রুলস), ২০০৮ সালের রাজনৈতিক দল নিবন্ধনবিধি (পলিটিক্যাল পার্টি রেজিস্ট্রেশন রুলস) এবং বাংলাদেশে চালু আইনের আওতার ভেতরে থেকে। উল্লিখিত সংবিধান, সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান পাঠ করলে সহজেই বোঝা যাবে, বর্ণিত সাতটি কাজ ইসির রুটিন কর্মেরই অন্তর্ভুক্ত। এ নিয়ে বিতর্কে যাওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তবে, বলা দরকার এসব রুটিন কাজকে যদি রোডম্যাপই বলি, রোডম্যাপের সংজ্ঞা কী হবে, জানি না। আসলে এই সময়ের স্বাভাবিক বিতর্ক আসতে পারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) তথাকথিত এই রোডম্যাপ ঘোষণা করতে গিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, তা নিয়ে।
তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই মুহূর্তে সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ইসির নেই। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি প্রসঙ্গে সিইসি বলেছেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে এই সুযোগ সৃষ্টির এখতিয়ার ইসির নেই। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সম্ভাবনা এখনো বাতিল করা হয়নি, ইভিএমের দরজা এখনো খোলা আছে। তা ছাড়া এখন নির্বাচনসহায়ক পরিবেশ আছে বলে তিনি মনে করেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, এ গুলো নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। এটি সরকারের বিষয়। এই মুহূর্তে নির্বাচনী সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে ইসি কোনো অনুরোধ জানাবে না বলেও তিনি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন। সিইসির এসব বক্তব্য নিয়ে অপরিহার্যভাবে বিতর্ক উঠতে পারে। এসব প্রসঙ্গে বিতর্ক যে যথার্থভাবেই উঠতে পারে, তা বুঝতে হলে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সার্বিক গাঠনিক ও আইনি প্রকৃতি সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার।
আমরা জানি, ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেলে ১৯৫৬ সালে গঠন করা হয় পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। তখন পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হয় এর আঞ্চলিক অফিস। ১৯৭১ সালে এক রক্তনদী পারি দিয়ে প্রত্যাশিত স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হওয়ার পর দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন গঠনের ব্যবস্থা করা হয় সংবিধানে ১১৮-১২৬ ধারা সংযোজনের মাধ্যমে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ মতে : ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কশিনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ মতে : ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ আবার আমাদের সংবিধানের ১২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’
সংবিধানের সুস্পষ্ট ধারার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে এর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে, একইভাবে নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কেবল ‘সংবিধান ও আইনের অধীন’ রাখা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে সাংবিধানিকভাবে বাধ্য করা হয়েছে, যাতে নির্বাচন কমিশন জাতিকে একটি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ উপহার দিতে রাষ্ট্রের কোনো পক্ষ থেকে বাধার মুখে না পড়ে। ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন’ কিংবা ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন’ শব্দগুচ্ছ খুব সহজ-সরল মনে হলেও, এর বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়, বরং খুবই জটিল। তা নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্মোহভাবে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয় পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা নিয়ে। কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে-পরে ভোট কারচুপিসহ নানা ধরনের নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতাসূত্রে। এই অভিযোগ আসে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রার্থী, রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদ, সুশীলসমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি জাতিসঙ্ঘ ও ইইউও আমাদের নির্বাচনের গ্রহণযোগতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের মধ্যে বড় মাপের অভিযোগ হচ্ছে, সংবিধানসূত্রে নিশ্চিত করা ‘স্বাধীন’ ইসি কখনোই ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। বরং দলীয় সরকারের অধীন প্রতিটি নির্বাচন কমিশন সরকারের বশংবদ হিসেবেই কাজ করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের আরেক বড় ব্যর্থতা হলো পেশিশক্তিধর ও কালো টাকার মালিকদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার কোনো কার্যকর উপায় উদ্ভাবন করতে পারেনি। তা ছাড়া নির্বাচনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা থাকলেও, কার্যত তা থাকে ক্ষমতাসীদের নিয়ন্ত্রণে। তা ছাড়া ইসিকে চলতে হয় সরকারের অর্থমন্ত্রীর দেয়া থোক বরাদ্দের ওপর। এর ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা সীমাহীন।
স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন দশটি সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। কয়েকটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও হয়েছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে। অনুষ্ঠিত হয়েছে তিনটি গণভোট ও বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর মধ্যে পাঁচটি স্থানীয় সরকার, তিনটি গণভোট, দু’টি রাষ্ট্রপতি ও তিনটি সংসদ নির্বাচন মিলে মোট ১৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সামরিক সরকারের আমলে। বাকি সব নির্বাচন হয়েছে বেসামরিক সরকারের অধীনে। তিনটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে (১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন তিনটিতেই ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ঘটেছে এবং এসব নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে বলে প্রায় সব মহল থেকেই একটা নির্দোষ সাধারণ স্বীকৃতি আছে। অপর দিকে, সাধারণ জনধারণা হচ্ছেÑ সামরিক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৩টি নির্বাচন যেমন সুষ্ঠু হয়নি, তেমনি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। এসব নির্বাচন কোনোমতেই ক্ষমতাসীন দলের অবৈধ প্রভাবমুক্ত ছিল না। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, জনমনে এই ধারণা আরো জোরদার হয় যে, আর যা-ই হোক দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এর পরে অন্যান্য নির্বাচন এ ধারণাকেই জোরদার করেছে। কারণ, এ দেশে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি চরমভাবে জেঁকে বসেছে। এই অসহিষ্ণুতার কারণেই বাংলাদেশের অনেক সিইসিকে তাদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণের আগেই বিদায় নিতে হয়েছে।
ফিরে আসা যাক, সিইসির দেয়া বিতর্কিত সাম্প্রতিক বক্তব্যে। রোডম্যাপ ঘোষণার সময় সিইসি বলেছেনÑ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনা এখনো বাতিল করা হয়নি, ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনার দরজা এখনো খোলা আছে। অথচ মাত্র কিছু দিন আগে তিনি নিজেই বলেছেন, ইভিএম ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা ইসির নেই। এরও আগে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সিইসির জানা উচিত, বাংলাদেশে ইভিএম ব্যবহারের বিতর্কটি বেশ পুরনো। এই বিতর্কে বরাবর দেখা গেছে, একমাত্র ক্ষমতাসীন দল ছাড়া ক্ষমতার বাইরের কোনো দলই ইভিএমের পক্ষে নয়। এ বিষয়টি আমাদের সিইসির জানা নেই, তা কি ভাবা যায়! এর পরেও কেন তিনি পুরনো এই বিতর্ক অপ্রত্যাশিতভাবে সামনে টেনে আনলেন রোডম্যাপ ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে? তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতেও নাকি ইসি কিছু কিছু ভোটকেন্দ্রে ইভিএম পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করবে। এটি নিয়েও সৃষ্টি হবে আরেক নতুন বিতর্ক। তা হলে কী এই আশঙ্কাই জাগে না যে, এই ইসি আসলে সরকারের প্রভাববলয় থেকে বাইরে আসতে পারছে না। আর সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সিইসি এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই বসেছেন। অতএব যথা পূর্বং, তথা পরং। এই সময়টায় দেশের কোনো মহল, আগামী নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করার আহ্বান কিংবা দাবি জানিয়েছে, তেমনটি আমাদের জানা নেই। এর আগে আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু করা না করা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, চলেছে নানা বিতর্ক। জনমতের চাপে ও ই-ভোটিংয়ে অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে নির্বাচন কমিশনের ই-ভোটিং চালুর উদ্যোগ বাতিল করতে হয়েছে।
আবার বর্তমানে নির্বাচন সহায়ক পরিবেশ আছে বলে সিইসি মনে করেন কি নাÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, এগুলো নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। এটি সরকারের বিষয়। এই মুহূর্তে নির্বাচনী সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারকে ইসি কোনো অনুরোধ জানাবে না। তিনি আরো বলেছেন, এই মুহূর্তে সরকারের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ইসির নেই। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির এখতিয়ার ইসির নেই।
তার এই বক্তব্য শুনে মনে হয় সংবিধানবলে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু তিনি পড়ে দেখেননি। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ মতে : ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ আবার আমাদের সংবিধানের ১২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে : ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ কিন্তু সিইসির বক্তব্য থেকে মনে হয়, নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনের অধীন কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সরকারের নির্বাহী বিভাগেরই অধীন। এবং তফসিল ঘোষণার আগে কমিশনের দায়িত্ব পালনে নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব পালনে সহায়তার কথাও বলতে পারবে না। মনে হচ্ছে, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ করার ক্ষেত্রে কমিশনের যাবতীয় দায়িত্ব-কর্তব্য তফিসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে তিনি মনে করেন।
সিইসির উপলব্ধিতে থাকা উচিত, নির্বাচন কমিশনের পবিত্র দায়িত্ব জাতিকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে একটি দলকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক মতামত ও কর্মসূচি পুরো পাঁচ বছর ধরেই জনগণের মাঝে অবাধে প্রচারের সুযোগ দিতে হয়। তফসিল ঘোষণার আগে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে সে সুযোগ দিচ্ছে কি না, তা নির্বাচন কমিশন দেখবে না, তা হতে পারে না। আমাদের সংবিধানে ৩৭ অনুচ্ছেদে সমাবেশের স্বাধীনতা এবং ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর এই সংবিধানের অধীন করা হয়েছে ইসিকে। অথচ ইসি সংবিধানের এই তাগিদ বাস্তবায়ন থেকে দূরে থাকবে, তা হতে পারে না। তা ছাড়া যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে এসব স্বাধীনতা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব যখন ইসির, তখন এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো সুযোগ নেই ইসির। অথচ সরকারি দল যখন সারা দেশে সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে, সেখানে বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলোর ঘরোয়া বৈঠক পর্যন্ত সরকারি বাধার মুখে পড়ছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে আসছে সীমাহীন বাধা। আমাদের সিইসি বলছেন, এ ব্যাপারে কিছু বলার এখতিয়ার ইসির নেই। কী অবাক করা বৈপরীত্য। মনে হয়, তার এই দুর্বলতাই এবার নির্বাচন কমিশনের ৩৩ কর্মকর্তার বদলি বিতর্কের বিষয়টির সৃষ্টি হতে পেরেছে। আর বর্তমানে দেশে নির্বাচন পরিবেশ আছে কি নেই, তা প্রকাশ করার সাহসটুকু যে সিইসি রাখেন না, সে সিইসি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কী সাহস দেখাতে পারবেন, তা এখনই অনেকের বোধে এসে গেছে। সে জন্য বলতে হচ্ছেÑ পুরনো পথেই নতুন সিইসির পা। বশংবদ সিইসির তকমা তার কপালেও অবধারিত।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238291