২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৪২

উন্নয়নের টুঁটি টিপছে যানজটের দানব

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

মহানগরী ঢাকার যানজট সমস্যা ক্রমাগত দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। মিরপুরের বাসা থেকে সকাল ৮ টায় বেরিয়ে মতিঝিল অথবা মগবাজার অফিস পৌঁছুতে প্রায়শ দুপুর হয়ে যায়। পত্রিকাঅফিসের নিজস্ব টাইমসিডিউল থাকায় আমাকে বেরুতে হয় দুপুরের পর মধ্যাহ্নের খাবার খেয়ে। এ হিসেবে দু’টো-আড়াইটায় অফিস পৌঁছুলেও আমার চলে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দুপুরের খাবার নাকেমুখে গুঁজে সাড়ে ১২ টার দিক বেরিয়ে মগবাজার অফিস পৌঁছুতে কোনও কোনওদিন বিকেল ৪ টা বেজে যায়। কাজ সামলাতে যেদিন রাত ৮-৯টা বেজে যায়, সে রাতে মিরপুর বাসায় ফিরতে কখনও কখনও ১২টা বাজে আমার। আর হ্যাঁ, ১২ টা কি কেবল আমারই বাজে? বাসায় যিনি রেঁধেসেধে পথ চেয়ে বসে থাকেন তারওতো একই অবস্থা। আমার পেশার যারা নিউজ ও প্রিন্টিং সেকশনে কাজ করেন তাদের রাত ১ টা ২ টা কোনও ব্যাপারই না। এমনও একসময় ছিল যে পত্রিকার অনেককে ভোর পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কম্পিউটার-ইন্টারনেটের যুগে কাজ সহজ হওয়ায় আগের মতো আর সেরকম থাকতে হয় না। শুধু সার্কুলেশনের কয়েকজন কর্মচারী থাকলেই চলে। মাঝেমধ্যে লেটনাইট এডিশনের জন্য দু’-একজন থাকতে হয়।

আমার সৌভাগ্য যে, পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই এডিটরিয়াল সেকশনে কাজ করবার সুবাদে আমি রিল্যাক্স মুডেই কাজ করে এসেছি সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে। নির্ধারিত কাজ সেরে চলে যেতে পারি। আজকালতো বাসায় বা সফরে থেকেও অফিস তথা পত্রিকার অনেক কাজ সেরে ফেলা সম্ভব হয় অনায়াসেই। কম্পিউটার, ইন্টারনেট অথবা এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট থাকলে যেকোনও স্থান থেকে পত্রিকার জন্য নিউজ, এডিটরিয়াল, পোস্ট এডিটরিয়াল পাঠিয়ে দিতে পারেন। এমনকি এডিটিংও সারতে পারেন অনলাইনে।
ও হ্যাঁ, যানজট নিয়ে কথা বলতে চাইছিলাম। এটা এখন ঢাকার অন্যতম সমস্যা। শুধু ঢাকারই না। চট্টগ্রামসহ অন্য মহানগরী তথা বিভাগীয় শহরগুলোর যানজটও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নাগরিকজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বিশেষত ঢাকার যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘন্টা বিনষ্ট হচ্ছে। আর্থিক দিক দিয়ে এতে বার্ষিক ক্ষতি হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৮৪ কোটি টাকা বলে বিশ্বব্যাংকের গবেষকরা জানিয়েছেন।
গত ১০ বছরে যানচলাচলের গড় গতি প্রতিঘন্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। উল্লেখ্য, পায়ে হেঁটে চলবার গতি ঘণ্টায় প্রায় ৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের শহুরে মানুষের ৩৬ শতাংশই ঢাকার বাসিন্দা। ঢাকা এখন বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। গত ১৯ জুলাই বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ২০৩৫ সালে ঢাকার উন্নয়ন বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের ‘টুয়ার্ডস গ্রেট ঢাকা: এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডিজম ইস্টওয়ার্ড’- শীর্ষক খসড়া রিপোর্টে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগর উন্নয়ন কর্মকা-ের সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে বিশৃঙ্খল ও অসম নগরায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে উঠছে ঢাকা। যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অত্যধিক ঘনবসতি আর নিম্নমানের বসবাসযোগ্যতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং বন্যা ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় ৩৫ লাখ বস্তিবাসীসহ অনেক নাগরিকই মৌলিক সেবা, অবকাঠামো এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিভিন্ন পর্বে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়র, উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, নীতি-নির্ধারক, নগর পরিকল্পনাবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বেসরকারি খাতের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করেন।
প্রধান অতিথি খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সেবার মান বাড়াতে সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিতে হবে। শহরের যানচলাচল ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ফ্লাইওভার নির্মাণসহ বেশকিছু উন্নয়নকাজ চলছে।
সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ঢাকার রাস্তা বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এ সময়ে মানুষ বেড়েছে ৫০ শতাংশ। যানবাহন বেড়েছে ১৩৫ শতাংশ। সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে পূর্ব ঢাকার দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন, যানজট প্রভৃতি সমস্যা আরও প্রকট হবে। ঢাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এর বাসিন্দারা বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে পড়বেন।
অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা, হরিয়ানার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শিলা দীক্ষিত, সাংহাইয়ের সাবেক ভাইস মেয়র কিংঝেং ঝাও বক্তৃতা করেন। উপস্থিত ছিলেন ডিসিসি উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন। মেয়র আনিস বলেন, বিশ্বের শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার জন্য যে বাজেট দরকার তা দেয়া হয় না। বিশ্বব্যাংক আমাদের ভালো উন্নয়ন সহযোগী। বাট ‘লেট ডিসিশন মেকার’। রাজধানীর সমস্যা হলো জনসংখ্যা এবং ট্রাফিক। আমাদের অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে বিশ্বব্যাংককে এগিয়ে আসবার আহ্বান জানান তিনি। মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকার পরিকল্পিত ড্রেনেজব্যবস্থা নেই। আমাদের দরকার সেবাখাতের সমন্বয়। নগর সরকারের অভাবে বিভিন্ন সংস্থা যে যার মতো কাজ করছে। এই সমন্বয়হীনতার জন্যই নগরের যাবতীয় সমস্যাসমাধান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
যাই হোক, মহানগরী ঢাকা নিয়ে উন্নয়নসহযোগী সংস্থাসহ দেশের ক্ষমতাসীনরা ভাবছেন। সুশীলসমাজ চিন্তা করছে। ভাবছেন মেয়র সাহেবদ্বয়ও। উন্নয়ন কতটা হবে জানি না। তবে উন্নয়ন নিয়ে যে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে, সভা-সম্মেলন হচ্ছে, এসবই বা কম কিসে?
উন্নয়নের যেসব বাধা প্রধানত দায়ী সেসবের মধ্যে দুর্নীতি, অযোগ্যতা, দূষিত রাজনীতি উল্লেখযোগ্য। তবে রাজধানী ঢাকাকে প্রায় স্থবিরতার দিকে যে সমস্যাটি দ্রুত ঠেলে দিচ্ছে তা হলো অসহনীয় যানজট। প্রতিদিন যদি শুধু ঢাকা মহানগরীর যানজটের কারণে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে দেশের অন্য মহানগরীর যানজট হিসেব করলে আরও কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে হিসাব করা দরকার। এ হিসাব যদি সারা বছরের ধরা হয় তাহুলে সেটা ভয়াবহ বলা চলে। অতএব যানজট সমস্যাকে যদি উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।
যানজট শুধু আমার ও আপনার অফিস বা কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতেই বিঘœ ঘটায় না, কর্মঘণ্টা বিনষ্ট করে না, শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি যেতেও সমস্যায় ফেলে। পড়ালেখার বিঘœ ঘটায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের বারোটা বাজায়। সর্বোপরি সব উন্নয়নের মাথা কেটে দেয়। দেশকে পেছনে টেনে নিয়ে যায় এই যানজট। তাই যানজট কেন হচ্ছে, এর কারণগুলো কী কী তা খতিয়ে দেখে সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি। রাস্তাঘাট থাকবে খানাখন্দে ভরা। ইটবালু, খোয়া ফেলে দখল করে রাখবেন গাড়ি চলাচলের পথ। আর ভাববেন যানজট কেন হচ্ছে? সড়ক-মহাসড়ক প্রতিদিন কাটাকুটি করবেন, কিন্তু মেরামত না করে ফেলে রাখবেন দিনের পর দিন। আর ভাববেন আপনার গাড়ি চলবে ঠিকঠাক। এটা কি সম্ভব? নিশ্চয়ই না। শুধু কি ঢাকার রাস্তাই খানাখন্দ ও ভাঙাচুরো? ঢাকার বাইরের শহর-মহাশহর কিংবা রাস্তাঘাট কি একেবারেই ওকে? ফিটফাট? মোটেও না। আমি যখন এ নিবন্ধ প্রস্তুত করছিলাম, তখন সেলফোনে খবর নিলাম, যমুনা ব্রিজের ওপারেও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। আমার বড়ছেলে বাসে যাচ্ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ি। সে বৃহস্পতিবার রাত ১১ টায় গাবতলী থেকে রওয়ানা দিয়ে যমুনা ব্রিজ পার হতেই পরদিন শুক্রবার সকাল ৭/৮ টা বাজিয়েছে। অথচ সে সময় তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবার কথা। এমন পরিস্থিতি আসলে সমগ্রদেশেরই।
ঢাকার যানজট এখন আর যানজট নয়। যেন দুঃসহ যন্ত্রণার দানব। এ দানব বিনষ্ট করছে শুধু ঢাকাতে প্রতিদিন আমাদের ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা, যার অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৮৪ কোটি টাকার সমান। এ হিসেব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যানজটের দানব উন্নয়নের টুঁটি টিপে ধরে থাকছে প্রতিদিন। ঠেলে ছুঁড়ে ফেলছে পেছনে। তাই দেশ ও জাতির উন্নয়ন চাইলে আগে যানজট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। আর তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। হাওয়াই বা কল্পনাপ্রসূত কোনওকিছু দিয়ে আর যাই হোক, উন্নয়ন সম্ভব নয়। যানজট নিরসন না করতে পারলে সব উদ্যোগ-আয়োজন মাঠে মারা যাবে। অতএব যে করেই হোক, আগে যানজটের জগদ্দল দানব অপসারণ জরুরি। তারপর উন্নয়নের কর্মসূচি প্রণয়ন করুন। কাজ চালিয়ে যান আন্তরিকতার সঙ্গে। তাহলে দেশ এগোবে। জাতি দেখবে উন্নয়ন।

http://www.dailysangram.com/post/293064-