১৫ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৮

পোশাকনির্ভর রফতানি ॥ বড় ধরনের ঝুঁকিতে

সমাপ্ত অর্থবছরে দেশের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে বড় পতন হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছর রফতানি থেকে আয় বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত ১৫ বছরে রফতানি আয়ে এত কম প্রবৃদ্ধি আর হয়নি। এমনকি ২০০১-০২ অর্থবছরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি-পরবর্তীও এটা সর্বনিম্ন রফতানি প্রবৃদ্ধি। শুধু তৈরি পোশাকনির্ভর রফতানি হওয়াতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে অর্থনীতি। পোশাক খাতের ওপর রফতানি নির্ভরতা কমাতে না পারলে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে অর্থনীতি।

রফতানি খাতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক শিল্পের ওভেন পণ্য রফতানি আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো রফতানি চিত্রে। ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী টাকা, ইউরোপের বাজারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও পোশাকের মূল্য কমে যাওয়াও এতে প্রভাব ফেলেছে। সবমিলে সমাপ্ত অর্থবছরে রফতানি আয়ে বড় ধরনের পতন হয়েছে।
রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) গত কয়েক বছরের রফতানি চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশের রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অংকের ঘরে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। পরের অর্থবছর তা এক অংকে নেমে আসে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ১১ শতাংশ। রফতানি আয়ে দেশের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয় ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর পর ২০১১-১২ সালে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯৯, ২০১২-১৩ অর্থবছর ১১ দশমিক ২২, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ১১ দশমিক ৬৯, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৩ দশমিক ৩৯ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
এর আগে দেশের রফতানি আয়ে সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে ২০০১-০২ অর্থবছর। ওই অর্থবছর রফতানি আয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কমে যায়। তবে পরের বছরই আবার তা ঘুরে দাঁড়ায়। ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত ধারাবাহিক দুই অংকের ঘরে প্রবৃদ্ধি হয় রফতানি আয়ে।
সমাপ্ত অর্থবছর রফতানি আয়ে বড় পতনের বিষয়ে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, গত অর্থবছর বিশ্বের অনেক জায়গায় বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যে এর প্রভাব পড়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এ ব্যাপারে আরো বেশি কৌশলী হব।
গত অর্থবছর পণ্য রফতানি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় কম হয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বরাবরের মতো এবারো রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। পোশাক খাতের ওভেন পণ্য ছাড়াও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া খাতগুলোর মধ্যে আছে হিমায়িত মাছ, কৃষিজাত পণ্য, চামড়া, কাঁচা পাট ও টেরিটাওয়েল।
২০১৬-১৭ অর্থবছর পোশাক রফতানি থেকে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলার। এ আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। গেল অর্থবছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৩ কোটি ডলার আয় হয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি থেকে। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় খাতটি থেকে রফতানি আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। গত অর্থবছর তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯৬ কোটি ডলার আয় হয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি থেকে। এক্ষেত্রেও ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্রেক্সিট, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী টাকা, ইউরোর অবমূল্যায়ন ও পোশাকের মূল্য কমে যাওয়ায় পোশাক রফতানি কমে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে ডলারের বিপরীতে টাকাকে অবমূল্যায়িত করাসহ প্রণোদনার দাবি জানান তিনি।
পোশাক রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে এলেও সম্ভাবনাময় আরো অনেক খাত আছে, যেগুলোর প্রবৃদ্ধিতে আশা দেখতে পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সম্ভাবনাময় এমন খাতগুলোর মধ্যে আছে লেদার ফুটওয়্যার, অন্যান্য লেদার পণ্য, ওষুধ, পাটজাত পণ্য, সিরামিক, আসবাব ও প্লাস্টিক পণ্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছর এ খাতগুলো থেকে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১, ৬ দশমিক ২৯, ৮ দশমিক ৬, ৪ দশমিক ৬৬, ৩ দশমিক ৮৫, ১৩ দশমিক ৫৫ ও ৩১ দশমিক ৪০ শতাংশ।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, নানা অনিশ্চয়তার কারণে গত অর্থবছরের রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। পোশাকনির্ভর রফতানি খাত হওয়ায় প্রবৃদ্ধির এ অবস্থা। পোশাক খাতে আরো হাই ভ্যালু পণ্য তৈরিসহ রফতানি খাতে আরো বৈচিত্র্য আনতে হবে। খুব দ্রুত বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের নীতিসহায়তাও প্রয়োজন।
রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয় জানিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দুই ধরনের প্রভাবেই পোশাকসহ সার্বিক রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানীর মতো বড় বাজারগুলোয় চাহিদার ঘাটতি যেমন এর কারণ, তেমনি ইইউর বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়াও এজন্য দায়ী। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিভাবেই রফতানি চিত্র খারাপ। যেমন ২০১৬ সালে ভারতে রফতানি আয় কমেছে ২ শতাংশ। আর চীনে সাড়ে ৭ ও শ্রীলঙ্কায় ১ শতাংশ কমেছে। এর কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে চাহিদা কমেছে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর আগেও ২০১৪ সালের তুলনায় ১৫ সালে চাহিদা কমেছিল ৮ শতাংশ।
তবে প্রতিযোগী কিছু দেশে রফতানি বেড়েছে। যেমন ভিয়েতনামে রফতানি প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এছাড়া কম্বোডিয়ায়ও বেড়েছে।
গেলো ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি হয়েছে রফতানি আয়ে। সবশেষ অর্থবছরে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪শ ৮৩ কোটি ডলার। বছর ব্যবধানে যা বেড়েছে মাত্র দেড় শতাংশের কিছু বেশি। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় খাত রফতানি। যা গেলো অর্থবছরের শুরু থেকেই ছিল অস্বস্তির মধ্যে। প্রথম ছয় মাসে বড় ব্যবধান ছিল লক্ষ্যমাত্রা আর বাস্তবতায়। যা মেটানো যায়নি পরের ছয় মাসেও। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, একক মাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছিল জানুয়ারিতে। আর শেষ মাস জুনে, ৩শ কোটি ডলার আয় হলেও, লক্ষ্যমাত্রা থেকে তা পিছিয়ে ছিল সাড়ে ষোল শতাংশ।
মোট অংক ধরলে, আয় এসেছে তিন হাজার ৪শ ৮৩ কোটি ডলার। যা এর আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ৫৮ কোটি বা দেড় শতাংশের কিছু বেশি। অথচ, লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৭শ কোটি। অর্থাৎ, আয় কম হয়েছে প্রায় ছয় শতাংশ। কিন্তু কেনো?
যুক্তরাষ্ট্রে ৩% রফতানি কমে তা দাঁড়িয়েছেন, ৫ হাজার ৮৪৬ কোটি ডলার। একইভাবে যুক্তরাজ্যে রফতানি কমেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এসময় রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৫৬৯ কোটি ডলার। ইতিবাচক ছিল জার্মানী বাজারে। এসময় জার্মানীতে রফতানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আয় হয়েছে ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার।
গত অর্থ বছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় বাড়লেও চলতি অর্থবছরে তা অনেক কমবে। কারন হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন , হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থনান্তর করার কারণেই অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে। গ্যাসের সংযোগ না পাওয়াতে অনেকে এখনও উৎপাদনে যেতে পারেনি।
ডলারের দাম না বাড়লে আগামীতেও রফতানি আয়ের এই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছে খাত সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না পারলে যেমন রফতানি আয় কমবে তেমনি মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে। তাই সবার উচিত তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ওষুধ, লাইটেনিং, পাট ও চামড়াজাতীয় পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের রফতানি বাড়ানো।
এক্ষেত্রে সরকারের কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে এফবিসিসিআই সহ সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বলেন, সরকারের উদ্যোগে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ অনেক এগিয়েছে। প্রায় ২০টি অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু হয়েছে। বিদেশীদের এসব অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বিনিয়োগ বাড়বে। প্রচলিত পণ্যসহ অপ্রচলিত পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে।
তবে বিদেশী বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত ও কর আদায়ের ব্যবস্থা সহজ করা দরকার। বিনিয়োগে তাদের আগ্রহী করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি রফতানি চাকাও সচল হবে বলে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান কমলেও বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টো চিত্র। এখানে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হচ্ছে। এছাড়া সেসব দেশের সরকার ব্যবসাবান্ধব নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী পোশাকের দর কমলেও তারা পুষিয়ে নিতে পারছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ব্রেক্সিট ও সাম্প্রতিক হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলা তৈরি পোশাকের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া বাংলাদেশের বন্দরগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। সেখানে পণ্য বোঝাই জাহাজগুলোর দিনের পর দিন পড়ে থাকে পণ্য খালাস ও বোঝাই কোনোটিই করতে পারছে না সময়মত। ফলে লিডটাইমে ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, কারখানাগুলোতে গ্যাস সংকট, স্থানান্তরিত ও নতুন কারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়াসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। এসব কারণে রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

 

http://www.dailysangram.com/post/291775-