১৫ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৬

দালালচক্রের কবলে সরকারি হাসপাতাল

ভোগান্তিতে রোগী ও স্বজনরা

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অসহায় রোগী ও স্বজনরা। বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা নিতে এসে পকেট খালি হয়ে পড়ছে। রোগী বা তাদের স্বজনদের টাকা যাচ্ছে এক শ্রেণীর দালালের পকেটে।
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালালচক্র। এই চক্রের হাতে কার্যত জিম্মি অসহায় রোগীরা। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা দালালদের অর্থ দেয়া ছাড়া কোনো সেবা পান না। দালাল ও হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মিলে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রের চাহিদা না মেটালে রোগীকে পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, কিডনি হাসপাতাল, মিডফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় চু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল নিউরোসাইন্স হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালের চিত্রই এক।
দেখা গেছে এসব হাসপাতালে দালালদের টাকা দিলে সেবা মেলে, না দিলে ভোগান্তির শেষ নেই। দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করে এসব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের দাবি, দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রায়ই দালালদের পুলিশে সোপর্দ করা হচ্ছে। জেল-জরিমানা বা দণ্ড খাটার পর তারা অগোচরে আবারো হাসপাতালে ভিড় করে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্প্রতি হাসপাতালে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য রোধে হাসপাতাল পরিচালকদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, রোগীর যথাযথ সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হাসপাতালে দালালদের অনুপ্রবেশ রোধে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন তারা হাসপাতালে ভিড়তে না পারে।
হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বাভাবিকভাবে সেবা না মেলায় দালালদের দ্বারস্থ হতে হয় তাদের। হাসপাতালে রোগী প্রবেশের পর থেকেই দালালদের অপতৎপরতা শুরু হয়। বহির্বিভাগ থেকে টিকিট কাটা, টেস্ট বাণিজ্য থেকে শুরু করে বেড পাওয়া সব ক্ষেত্রেই দালালদের দৌরাত্ম্য।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের এক একটি বেড রোগীদের কাছে যেন মূল্যবান। বেড পেতে রোগীদের ধরনা দিতে হয় নানাজনের কাছে। দালালচক্রের সাথে হাত না মেলালে বেড পাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিযোগ তাদের। আরো অভিযোগ রয়েছে, দালালরা শুধু রোগী নিয়েই ব্যবসা করে না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনের মোবাইল, টাকা ও মালামালসহ সর্বস্ব সুকৌশলে চুরি করে নেয়।
দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালে কিছু ওষুধ, বেড ও অপারেশন বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও সবকিছুতেই দালালদের দ্বারস্থ হতে হয়। যে কারণে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগীদের। এ েেত্র সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়ে গরিব মানুষ। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে এসে তারা ভর্তি হওয়ার পর নিরুপায় হয়ে সহায় সম্বল পর্যন্ত বিক্রি করছেন।
সূত্র মতে, রাজধানীতে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে সক্রিয় সহস্রাধিক দালাল। চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল মানুষকে টার্গেট করছে তারা। পঙ্গু হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দালালদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এদের সহযোগিতা নিয়েই প্রভাবশালীরা বেসরকারি হাসপাতাল-কিনিক পরিচালনা করেন। তারা দালালদের রা করতে অনেক কিছুই করেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার সর্ববৃহৎ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দালালচক্রের পরিধি ব্যাপক। কর্মচারী নেতাদের সহায়তায় হাসপাতালকে জিম্মি করে রেখেছে এই চক্রটি। প্রশাসনও এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। সূত্র মতে, দালাল চক্রটি কর্মচারী নেতাদের প্রতি মাসে মাসোহারা দেন। যে কারণে এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলে না। হাসপাতালে ২০০ এর বেশি দালাল রয়েছে বলে জানা গেছে। দালালরা হলেন সুমন, মিজান, কাওসার, রফিক, হাবিব, হামিদুল, কিশোর, আয়নাল, রফিকুল ইসলাম, খায়রুল, মনির হোসেন, কালা, শামসু, আবেদ আলীসহ শতাধিক। এ ছাড়াও হাসপাতালের ভিতরে বিভিন্ন টেস্টের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, প্রাইভেট হাসপাতালের এবং অর্ধশতাধিক বহিরাগত দালাল। এ দিকে চিকিৎসকদের পাশাপাশি ঢামেক হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মচারীও বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মার্কেটিংয়ের কাজে ব্যস্ত। তারা প্রতিদিন হাজিরা দেন হাসপাতালে। কিন্তু ঢামেকের নয়, কাজ করেন মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধি হিসেবে। সবকিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই।
রোগীদের সঙ্গে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে একটি বেড পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেও কখনোই একক চেষ্টায় বেড পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে ওয়ার্ডবয়দের সাথে হাত মেলালেই টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই বেড মেলে।
পঙ্গু হাসপাতাল
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) জিম্মি হয়ে পড়েছে দালালদের হাতে। আর তাদের সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে খোদ হাসপাতালেরই চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। সেবা নিতে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনদের অভিযোগ হাসপাতালের গেট থেকেই শুরু হয় দালালদের তৎপরতা। এ দালালদের কারণে রোগীদের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। সূত্র মতে, পঙ্গু হাসপাতালে ২০টি গ্রুপে দুই শতাধিক দালাল সক্রিয় আছে। গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম শওকত গ্রুপ, জাহিদ গ্রুপ, নাহিদ গ্রুপ, মজনু গ্রুপ, হাজেরা গ্রুপ, আল আমীন গ্রুপ, নাজিম গ্রুপ, রেজাউল গ্রুপ, শাহানা গ্রুপ, সুমন গ্রুপ, সিদ্দিক গ্রুপ, মোকারম গ্রুপ, আলী গ্রুপ, রুবেল গ্রুপ, বাশার গ্রুপ, শহিদুল গ্রুপ, জহির গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, কল্পনা গ্রুপ ও মরজিনা গ্রুপ। একেক গ্রুপে সিনিয়র-জুনিয়র মিলিয়ে আট থেকে ১০ জন দালাল। তাদের কেউ হাসপাতালের কোনো কর্মচারীর আত্মীয়, কেউ স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশীর্বাদপুষ্ট, আবার কারো আছে রাজনৈতিক পরিচয়। এ কারণে হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পান না। যদিও এই হাসপাতালে প্রায়ই অভিযান চালায় র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী। দালালদের গ্রেফতার করে সাজাও দেয়া হয়। কিন্তু তৎপরতা থামে না। জানা গেছে, গত এক বছরে দেড় শতাধিক দালালকে গ্রেফতার করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর এরা আইনি ফাঁকফোকরে জামিনে বেরিয়ে আসে। আবার তৎপরতা শুরু করে। এ হাসপাতালকে ঘিরে সক্রিয় দালালদের কেউ কেউ আট-১০ বারও জেল খেটেছে।
বিএসএমএমইউ
দালালদের অপতৎপরতা বন্ধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এখানেও দালালচক্র সক্রিয়। তবে এখানে অন্যান্য হাসপাতালের মতো বেড বাণিজ্য নেই। এখানে রয়েছে বহির্বিভাগে রোগী দেখানোর টিকিট পাওয়া, বৈকালিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবার টিকিট পাওয়া এবং বিভিন্ন টেস্টের জন্য রোগীদের পার্শ্ববর্তী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো নিয়ে একটি চক্রের বাণিজ্য। তবে চক্রটি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসারদের সমন্বয়ে গড়া একটি সিন্ডিকেট। জানা গেছে, দালাল প্রতিরোধে পরিচালকের নেতৃত্বে একটি পৃথক টিমও কাজ করছে। তারপরও অগোচরে দালাল সিন্ডিকেটটি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
কিডনি হাসপাতাল
কিডনি হাসপাতালে জরুরি বিভাগের রিসিপশনের সামনে এক রোগীর স্বজনকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন এক ওয়ার্ডবয়। সরকারি হাসপাতালে পরীা-নিরীা করাতে অনেক সময় লাগে, তাই রোগীকে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানালেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, দালাল প্রবেশে কিডনি হাসপাতালে রয়েছে কঠোর নজরদারি। হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে একটি বেড পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করেও কখনোই একক চেষ্টায় বেড পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে ওয়ার্ডবয়দের সাথে হাত মেলালেই টাকার বিনিময়ে খুব সহজেই বেড মেলে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার েেত্র ৯৫ শতাংশ ব্যয় সরকার বহন করে থাকে। সরকারি হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যের এবং ৩০ শতাংশ বেডের জন্য সামান্য ভাড়া নির্ধারিত আছে। এ ছাড়া রোগ নির্ণয়ের েেত্র রোগীকে স্বল্প পরিমাণ ইউজার ফি বহন করতে হয়। ভাড়ায় বেডে থেকে এবং ইউজার ফি প্রদানের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিলেও কোনো রোগীর মোট খরচের ১৫ শতাংশের বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। সরকারি হাসপাতালে একজন রোগীর আউটডোরে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা আর ভর্তি হতে ১৫ টাকা। ভর্তির পর থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসার সব ব্যয় সরকারই বহন করে থাকে।
সূত্র মতে, সরকারি হাসপাতালে দালাল প্রবেশে রয়েছে কড়া সতর্কবার্তা। কিন্তু সেটা যেন কেবলই কাগজে-কলমে। হাসপাতালের কর্মীদের যোগসাজশেই ঢুকে পড়ছে দালালরা। আর এসব দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা। বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা সেবা থেকে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235826