১৫ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৭

এতো স্বর্ণ ভূতে জোগায়!

দেশজুড়ে রয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার স্বর্ণের দোকান। এরমধ্যে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সদস্য প্রায় ৫শ’ প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিনই এসব দোকানে চলছে বেচাকেনা। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই স্বর্ণের জোগানের কোনো দৃশ্যমান উৎস নেই। চোরাচালানের ওপর ভর করেই তারা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশ থেকে চোরাইপথে আসা বিপুল পরিমাণ এই স্বর্ণ দিয়েই দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করছে তারা। সূত্র বলছে, গত এক দশকে এক তোলা স্বর্ণও দেশে বৈধভাবে আমদানি করা হয়নি। ফলে চোরাইপথে স্বর্ণ আসায় সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে গোয়েন্দারা ব্যাপক অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তারা বলছেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নজরদারি আছে। আমদানিকৃত স্বর্ণ চোরাইপথে এসেছে প্রমাণিত হলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবেন। 

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, গত ৫ বছরে শুধু এ সংস্থার অভিযানেই আটক হয়েছে অবৈধভাবে আসা ১৬২২ কেজি ৭৭ গ্রাম স্বর্ণ। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৭৬৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এসব অভিযানে আটক করা হয়েছে চোরাচালানে সরাসরি জড়িত ১৩১ ব্যক্তিকে। কিন্তু সূত্র বলছে, প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করছে, অবৈধ পথে তার ১০ গুণেরও বেশি সোনা ঢুকছে দেশে। এর একটি অংশ বাংলাদেশে থাকছে। বাকি সোনা বিভিন্ন পথে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে ভারতে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর সোনার চাহিদা প্রায় ২১ টন। সারা বছর এ পরিমাণ স্বর্ণের অলঙ্কারই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত ১০ বছরে বৈধভাবে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। সর্বোচ্চ ৫ ভাগ এসেছে ব্যাগেজ রুলের আওতায়। বাকি ৯৫ ভাগ চাহিদার যোগান প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। ফলে অধিকাংশ সোনার ব্যবসাই অবৈধভাবে চলছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এ অবস্থায় ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার দোকানগুলোর সোনা ও ডায়মন্ডের উৎসের তথ্য জানতে চেয়ে ভ্যাট কমিশনারেটকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সম্প্রতি ঢাকার চারজন ভ্যাট কমিশনারকে পাঠানো ওই চিঠিতে জুয়েলারি দোকানগুলো সোনা ও হীরা বিক্রির বিপরীতে কী পরিমাণ রাজস্ব দিয়েছে তা জানাতে বলা হয়েছে। হিসাব অনুযায়ী ২১ টন সোনার সমপরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ ৪১১ ভরি। এর মধ্যে ৫ শতাংশ যাত্রীর সঙ্গে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসে। লাগেজ রুলে বলা হয়েছে, একজন যাত্রী ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার অথবা ২০০ গ্রাম ওজনের রৌপ্য অলঙ্কার সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ছাড়াই আমদানি করতে পারবে। এছাড়া ওই আইনে আরো বলা হয়েছে, একজন যাত্রী বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় অনধিক ২৩৪ গ্রাম (বিশ তোলা) ওজনের স্বর্ণবার বা স্বর্ণপিণ্ড এবং ২৩৪ গ্রাম রৌপ্যবার সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ সাপেক্ষে আমদানি করতে পারবেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি সোনা আনলে প্রতি ভরিতে তিন হাজার টাকা হিসাবে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। তবে ব্যাগেজ রুলের বেশিরভাগ স্বর্ণই আনছেন ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারকারীরা। সেক্ষেত্রে স্বর্ণের পুরোটাই আসছে চোরাচালান থেকে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজে বা বিমানে সোনার বার, স্বর্ণালঙ্কার পাচার হয়ে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশের একটি চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তবে শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, অবৈধ পথে সোনা আমদানি ঠেকাতে সব ধরনের কৌশল নিয়েছে তারা। ফলে বিমানবন্দরগুলোতে সোনা আটক হচ্ছে। পাশাপাশি বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ সোনা জব্দ করা হচ্ছে। ফলে আগের বছরগুলোর তুলনায় সামপ্রতিক সময়ে চোরাচালান কিছুটা কমেছে। সূত্রটি জানাচ্ছে, গত ২০১৩ সালের জুন থেকে চলতি বছর জুন পর্যন্ত তারা ১৬২২.৭৭ কেজি স্বর্ণ আটক করেছে।
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বর্ণ আমদানি প্রক্রিয়া খুবই কঠিন। ফলে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানিতে উৎসাহী নন ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বর্ণ আমদানিতে কোনো নীতিমালা নেই। এ ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই নীতিমালার দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। তবে বাজার অস্বচ্ছ হলেও সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার স্বর্ণের দোকান আছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০০ দোকান বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস)-এর সদস্য। জুয়েলারি সমিতির নেতারা বলছেন, স্বর্ণে শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে আমদানি হয় না। তবে তারা দাবি করেন, বিদেশ থেকে বাংলাদেশিরা যেসব সোনা নিয়ে আসে সেগুলো তারা কিনছেন। কিন্তু এর পরিমাণ মোট চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম। সমিতির হিসাবে দেশের স্বর্ণ দোকানগুলো প্রতিদিন গড়ে ২৫ কোটি টাকা বিক্রি করে। এ হিসাবে বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২১ টন। অর্থাৎ এই পরিমাণের স্বর্ণের অলঙ্কার দেশে কেনাবেচা হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশে এক তোলা স্বর্ণও বৈধভাবে আমদানি হয়নি। বৈধ আমদানি না থাকায় এ খাত থেকে কোনো শুল্কও আদায় হয়নি। এদিকে দেশে স্বর্ণের অবৈধ সরবরাহ ঠেকাতে বৈধ সরবরাহের পথ সহজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। একই মত শুল্ক গোয়েন্দাদেরও। ইতিমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বৈধ সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮-এর অনুচ্ছেদ ২৬ (২২) অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সোনা আমদানির সুযোগ সৃষ্টিতে অনুরোধ করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাজুসের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বৈধভাবে সোনা সরবরাহের ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়। এ বিষয়ে বাজুসের নেতারা এনবিআরের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে আলোচনা করেছেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=74108&cat=2/-