২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:২২

এবার বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন

চামড়াশিল্পের সংকট কাটছে না। সময় মতো অর্ডার না পাওয়াতে বায়ার হারাচ্ছে দেশের চামড়াশিল্প। বায়ার (ক্রেতা) একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে তা আর ফিরে পাওয়া সহজ হবে না। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে চামড়াশিল্পে রফতানিতে ধস নেমেছে। ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ বাংলাদেশের চামড়াশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে ভারত। একটি অসাধু ব্যবসায়ীচক্র আমাদের চামড়াশিল্প ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এখনই সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে গ্যাস সংযোগ দেয়া না হলে এ শিল্প আর ধরে রাখা যাবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর হাজারীবাগে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় সেখানকার ট্যানারিগুলোর উৎপাদন ইতোমধ্যে বন্ধ রয়েছে। নতুন গ্যাস সংযোগ না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতেও। ফলে দেশের চামড়াশিল্পে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ট্যানারি দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ খাত। শীর্ষে থাকা তৈরি পোশাক খাতের কাছাকাছি একমাত্র চামড়াশিল্প যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে দেশের এ খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে ট্যানারির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। থেমে গেছে রফতানিও। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের চামড়াশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ট্যানারি এসোসিয়েশন (টিএবি) সূত্র জানিয়েছে, হাজারীবাগের কারখানাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় কারখানা বন্ধ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মাস। এতে করে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ বাতিল হবে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প ঐতিহ্যবাহী পাট শিল্পের মতোই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। সামনে কুরবানির ঈদ পরিস্থিতি আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে।
অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের রফতানি খাতে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পণ্য রফতনিতে মোট আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমেছে। রফতনি লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের স্থলে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২১৭ কোটি ডলার কম। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৬১টি পণ্যের মধ্যে ৩৮টির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। রফতনি আয় হ্রাস পাওয়ার কারণ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আমাদের সময়কে বলেছেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
রফতনি আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে তৈরি পোশাক ও চামড়াজাত পণ্য খাত থেকে। উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও সাভারে বিসিকের প্লটে ট্যানারি কারখানাগুলো স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এতে চামড়াশিল্প থেকে গত অর্থবছরে রফতনি আয় কম হয়েছে। যার পুরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে।
চামড়া অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে এখাত। এতে করে বাতিল হওয়ার অর্ডার চলে যাচ্ছে প্রতিবেশি দেশে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,দীর্ঘদিন ধরেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ট্যানারি স্থনান্তর করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ বুড়িগঙ্গা নদীকে বাচানোর অজুহাতে সাভারে ট্যানারি স্থনান্তর করা হলো। অথচ এখনও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইসিপি) কাজ শেষ না হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে ট্যানারি মালিকরা বর্জ্য এখন ধলেশ^র নদীতে ফেলছেন। প্রশ্ন হলো তাহলে নদী কি বাচলো না মরলো। ধলেশ^র নদীর মৃত্যু হলে এর দায়ভার কে নিবে।
অথচ এ খাতে রফতনি আয় বাড়াতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। রফতনিতে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। তাই এ খাতে রফতনি আয় বাড়াতে হলে যত দ্রত সম্ভব সাভারের ট্যানারি নগরীতে গ্যাস সংযোগ দিতে হবে।
ট্যানারি-মালিকদের অভিযোগ, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না করেই হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) পক্ষ থেকে আদালতে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে।
চামড়া শিল্পনগরীতে গ্যাস সংযোগ না দিয়েই বিসিক আদালতে জানায় যে, হেমায়েতপুরে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের মিথ্যা তথ্য দেয়ার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও অভিযোগ মালিকদের। তারা বলছেন, বিসিক আদালতে আরও জানায় যে, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইসিপি) দু’টি মডিউল প্রস্তুত রয়েছে। ট্যানারি-মালিকরা সাভারে না যাওয়ায় মেশিনগুলো নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেয়া হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে সাভারে ৫০টি কারখানার শোধনও সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্যগুলো ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি দূষিত এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে যোগ করেন ট্যানারি-মালিকরা।
তাদের দাবি, সম্ভাবনাময় ট্যানারি খাত রক্ষা করতে দ্রত হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হবে। চামড়া শিল্পনগরীতে ট্যানারি-মালিকদের জমি রেজিস্ট্রেশন করে দিতে হবে। একই সঙ্গে ট্যানারি-মালিকরা যাতে সহজে ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারেন সে ব্যবস্থাও করতে হবে।
একাধিক ট্যানারি-মালিক বলেন, শিগগিরই ট্যানারির উৎপাদন স্বাভাবিক করা না গেলে বিদেশি ক্রেতা হারাবে বাংলাদেশ। এতে শুধু ট্যানারি-ব্যবসায়ীরাই নয়, দেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রফতানি আয়েও।
গত অর্থ বছরের মাত্র দুই মাসে এখাতে রফতানি আয় কমেছে ২১৭ কোটি মার্কিন ডলার। যদি অবস্থার কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে চলতি অর্থ বছরে অবস্থা কি দাড়াবে তা বলা খুবই কঠিন। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,এ শিল্প ধরে রাখাই কঠিন হবে। এমনিতেই বিশ^ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশি ভারত এখাতে বেশি পরিমানে নগদ প্রণোদনা দেয়ার বাজার দখল করে নিচ্ছে তারা। কুরবানি এলে ৫০ ভাগ চামড়াও দেশে রাখা যায় না। কাচা চামড়া পাচার হয়ে যায়।
গত ৮ এপ্রিল হাজারীবাগে থাকা কারখানার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানিসহ সব ধরনের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর থেকে হাজারীবাগের কারখানাগুলোর উৎপাদান বন্ধ রয়েছে। হাজারীবাগের সংযোগ বিচ্ছিন্নের আগে ও পরে ট্যানারি-মালিকদের পক্ষ থেকে সাভারে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য একাধিকবার দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমানে দেশের ট্যানারি খাত কঠিন সময় পার করছে। এ পরিস্থিতি থেকে চামড়াশিল্প রক্ষা করতে হলে নগদ প্রণোদনা দিতে হবে। চামড়া শিল্পনগরীতে জমি রেজিস্ট্রির পাশাপাশি দ্রত গ্যাস সংযোগও দিতে হবে।
জমি রেজিস্ট্রেশন করে না দেয়ায় ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে না ট্যানারি মালিকরা। আর এ কারণেই বরাদ্দ পাওয়া প্লাটে দ্রত উন্নয়ন কাজ শেষ করতে পারছে না ট্যানারি মালিকরা। এতে করে উৎপাদনে যেতেও দেরি হচ্ছে। এদিকে বায়ার এসে ফিরে যাচ্ছেন। যারা অডার পেয়ে সময় মতো সরবরাহ দিতে পারেননি তাদের অর্ডারও বাতিল হয়েছে। অসহায় ট্যানারি মালিকরা কোনভাবেই এই শিল্পকে রক্ষা করতে পারছেন না। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগও দেয়া না হলে আসন্ন কুরবানির পশুর চামড়া ক্রয় করা তাদের জন্য কঠিন হবে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ট্যানারি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, গার্মেন্টসের কাছাকাছি যদি কোনো খাত রফতানি আয় করতে পারে, সেটি চামড়াশিল্প। সাভারে পুরোপুরিভাবে ট্যানারি কার্যক্রম চালানো গেলে এ খাত থেকে রফতানি আয় অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু শিগগিরই ব্যবস্থা না নিলে রফতানি-ই বন্ধ হয়ে হবে।
এরই মধ্যে অনেক ক্রেতা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, একবার বায়ার (ক্রেতা) হারালে তা আর ফিরে পাওয়া সহজ হবে না।
হাজারীবাগের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্নের সময় বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিযেশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, দেশের চামড়াশিল্প ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেননা গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকলে এ শিল্প ধ্বংস হতে বাধ্য। চামড়া শিল্পনগরীতে অবিলম্বে কার্যক্রম চালানো না গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর তখনই বায়াররা অন্য দেশে চলে যাবে। আমাদের চামড়া বাইরে পাচার হয়ে যাবে। এদিকে, পাটশিল্পের মতো দেশের চামড়াশিল্পও ধ্বংসের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চামড়াশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে ভারত। দেশের স্বার্থ বিরোধী কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের চামড়াশিল্প ধ্বংসের পায়তারা করছে। এ বিষয়ে সরকারের আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

 

http://www.dailysangram.com/post/292887-