২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:২০

পাঁচগুণের বেশি খরচ পড়বেএলএনজিতে শিল্প-কারখানার জন্য অশনি সংকেত

জ্বালানি খাতে আগামী দিনগুলো অশনি সংকেত নিয়ে আসছে। বর্তমানে যে দামে গ্যাস ক্রয় করা হচ্ছে এল এনজি আমদানির পর তা ক্রয় করতে হবে পাঁচগুণ বেশি দামে। বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় খুচরা মূল্য ৬ টাকা ২২ পয়সা। ২০১৮ সাল নাগাদ তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হলে এর দাম বেড়ে দাড়াবে ৩২ টাকা ৫৩ পয়সায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি ঘাটতি পূরণে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও জ্বালানি খরচ অনেক বাড়বে। সঙ্গে থাকবে নিরাপত্তা ঝুঁকি। এছাড়া উচ্চ মূলে জ্বালানি কিনে সংকটে পড়েবে শিল্প কারখানা। শুধু তাই নয় জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা বেড়ে গেলে গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে। জ্বালানির দাম বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, জ্বালানি চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধির কারনে সংকট সমাধানে তরল জ্বালানি, কয়লা, এলপিজি ও এলএনজি আমদানি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে জ্বালানি ঘাটতি পূরণে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও জ্বালানি খরচ অনেক বাড়বে। সঙ্গে থাকবে নিরাপত্তা ঝুঁকি।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, গ্রাহক পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের গড় খুচরা মূল্য ৬ টাকা ২২ পয়সা। ২০১৮ সাল নাগাদ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হলে এর দাম বেড়ে ৩২ টাকা ৫৩ পয়সায় দাঁড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্থলভাগের গ্যাস অনুসন্ধান করে এর ব্যবহার বাড়ানো এবং নিজস্ব কয়লা ব্যবহার না করা পর্যন্ত এই অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। বরং পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাতে জ্বালানির দাম বাড়তেই থাকবে। আর জ্বালানির দাম বাড়লে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হবে। দেশে শিল্প ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পরিসর বৃদ্ধির ফলে দিন দিন বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিভিন্ন খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২০ থেকে ৩৫০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ রয়েছে ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান না পাওয়ায় এ ঘাটতি প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। জ্বালানি বিভাগ বলছে, ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে বাধ্য হয়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এই দাম যাতে সহনশীল পর্যায়ে থাকে সে জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনাও রয়েছে। এলএনজি আমদানিতে কাতারের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক চুক্তি অনুযায়ী বছরে আড়াই লাখ ঘনমিটার এলএনজি গ্যাস আগামী ১৫ বছর আমদানি করা হবে।
আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ এলএনজি সরবরাহের আশা করছে সরকার। এ লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মাণ করা হচ্ছে ভাসমান টার্মিনাল। এর বাইরে টার্মিনাল নির্মাণের কথা রয়েছে ভারতের দুটি ও ব্যক্তি খাতে বাংলাদেশের আরও একটি কোম্পানির। আমদানিকৃত এলএনজি পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করে তা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
সূত্র জানায়, এলএনজি চালু হলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্যাস বিক্রি বাবদ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ জন্য আগে থেকেই ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ছে। চলতি বছর দু’দফায় গ্যাসের দাম বেড়েছে।
আগামীতে গ্যাসের সঙ্গে বিদ্যুৎ দাম আরও বাড়বে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সরকারের পরিকল্পনা হল-আমদানি করা কয়লা দিয়ে বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাসের জোগান দিতে এলএনজি আমদানি করা। পাশাপাশি দেশের মধ্যে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা। এক্ষেত্রেও বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালের জুলাইয়ে বন্ধ করা হয় আবাসিকে গ্যাস সংযোগ। ২০১৩ সালের মে মাসে তা তুলে দেয়া হলেও ২০১৬ সালের মার্চ থেকে তা পুনরায় বন্ধ করা হয়। আবাসিকে আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এজন্য তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারে ভোক্তাদের আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করছে সরকার। তবে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের তুলনায় এলপিজিতে খরচ অনেক বেশি।
পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ¬্যানে আবাসিকে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বিশে¬ষণ করে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা বলছে, পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের তুলনায় এলপিজিতে খরচ সাড়ে পাঁচগুণ।
গত বছর এ বিশে¬ষণ করে জাইকা। তখন এক বার্নার গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৬০০ টাকা। চলতি বছর দুই দফা বেড়ে তা দাঁড়িয়েছে ৯০০ টাকা। আর ১২ কেজি ওজনের এলপিজির দাম ধরা হয়েছে এক হাজার ৫০ টাকা।
বিশে¬ষণে দেখানো হয়, বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে মাসে ৭২ ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে ১২ টাকা ৫০ পয়সা। আর ঘনমিটারপ্রতি গ্যাসের হিট ভ্যালু ৩৯ দশমিক ৫৯ মেগাজুল। ফলে প্রতি মেগাজুল গ্যাসের দাম পড়বে ৩২ পয়সা। এদিকে এলপিজিতে প্রতি কেজি গ্যাসের দাম পড়ে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। আর কেজিপ্রতি গ্যাসের হিট ভ্যালু ৫০ দশমিক ৮০ মেগাজুল। ফলে প্রতি মেগাজুল গ্যাসের দাম পড়ে এক টাকা ৭২ পয়সা।
এ হিসেবে এলপিজিতে ৭২ ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়বে চার হাজার ৮৩৮ টাকা। অর্থাৎ পাইপলাইনের গ্যাসের তুলনায় এলপিজিতে গ্যাসের দাম প্রায় সাড়ে পাঁচগুণ। যদিও প্রতি সিলিন্ডারের দামের সঙ্গে পাইপলাইনের গ্যাসের পার্থক্য মাত্র ১৫০ টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, গ্যাসের বিকল্প ব্যবস্থা এখন সিলিন্ডার। এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে রান্নাবান্নার কাজও চলছে। পাশাপাশি শিল্প-কারখানায়ও চলবে। পৃথিবীর সব দেশে এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে শিল্প-কারখানা চলে। আমাদের দেশে আস্তে আস্তে সেটাই করতে হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে দেশে অনেক এলপিজি কারখানা হয়েছে। আরও বছরখানেক এ জন্য কষ্ট করতে হবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফায়জুল্ল¬াহ একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আবাসিকে পাইপলাইনে আর গ্যাস দেয়া হবে না বলে এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন মন্ত্রী। তাই এলপিজির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে পাইপলাইনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া এলপিজি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হচ্ছে। এতে এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, বর্তমানে অধিক ও অন্যায্য মূল্যে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ হচ্ছে। ২০২১ সাল নাগাদ জ্বালানি প্রবাহে আমদানি করা জ্বালানির অনুপাত গ্যাসের তুলনায় বেশি হবে। এতে ভবিষ্যৎ জ্বালানি সরবরাহ ব্যয়বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এর ফলে বিদ্যুৎ সহ সব সেবা ও পণ্যের দাম বৃদ্ধিও অব্যাহত থাকবে। এই ব্যয়বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অধিকাংশ মানুষের আয়বৃদ্ধি না হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাবে। তখন সর্বক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, আমদানি করা গ্যাস অনেক বেশি দামে কিনতে হবে। এতে দেশের শিল্প-বাণিজ্য এগোবে না। এ জন্য নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি গ্যাসের ওপর চাপ কমিয়ে কয়লার ব্যবহার বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাতে কয়লা থেকে অন্তত পাঁচ হাজার মেগাওয়াট নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১ মেগাওয়াটও উৎপাদন হয়নি। কয়লা থেকে যদি এই বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো তাহলে গ্যাসের ওপর চাপ কমত। সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাসময়ে তা বাস্তবায়ন না হলে এমন দুরবস্থা চলতেই থাকবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/292890-