একের পর এক মৃত্যুর ঘটনার পরও সীতাকুণ্ডে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এখনো পাহাড়ের নিচে বসবাস করছে মানুষ : নয়া দিগন্ত
২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:২০

অপরাধীদের আখড়া জঙ্গল ছলিমপুর

সীতাকুণ্ডের ‘জঙ্গল ছলিমপুর, এ যেন আরেক সাম্রাজ্য’। এখানে বর্তমানে বাস করছে প্রায় চল্লিশ হাজার ছিন্নমূল মানুষ। দিন দিন বাড়ছে এর সংখা। এখানে তেমন প্রয়োগ করা যায় না রাষ্ট্রের আইনকানুন। চল্লিশ হাজার মানুষকে প্রায় এগারটি সামাজে ভাগ করে প্রয়োগ করা হয় ‘ছিন্নমূল বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠনের তৈরি করা কানুন। এ সংগঠনের ব্যানারে দুর্গম জঙ্গল ছলিমপুরে হাজার হাজার একর সরকারি পাহাড় দখল করে অবাধে বেচাকেনা চলছে। এ সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা ভূমিদস্যুরা এখানে পাহাড়ের দখল বিক্রির ব্যবসা করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের পাশে হওয়ায় বিভিন্ন অপরাধী অপরাধ করে সহজেই এখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ফলে এ জায়গাটিকে এখন অপরাধীদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় সেখানে দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপই নিতে পারছে না প্রশাসন। ফলে সরকারি সম্পত্তি লুটেপুটে খাওয়ার পাশাপাশি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে এটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার ভোররাতে পাহাড়ধসে একই পরিবারের পাঁচ সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু হলে জঙ্গল ছলিমপুর আবার আলোচনায় আসে। সাংবাদিকেরা অতীত এখানে ঢুকতে না পারলেও শুক্রবারের ঘটনায় তারা সেখানে ঢুকতে সক্ষম হন। সেখানে একটি ভোটকেন্দ্র থাকায় রাষ্ট্রের যেকোনো নির্বাচনে এ কেন্দ্রটিকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ কৌতূহল থাকে। সেখানে রায়েছে প্রায় সাত হাজার ভোটার। দুর্গমতার কারণে সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের চেয়ে সংগ্রাম পরিষদের লোকজনেরই কদর বেশি থাকে। এখানে হাজার হাজার একর পাহাড় দীর্ঘ সময় ধরে কয়েকটি ভূমিদস্যু চক্রের দখলে রয়েছে। এসব চক্রের সদস্যরা যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের কিছু প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থেকে অবৈধভাবে পাহাড়ের দখল ক্রয়-বিক্রয় করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ সময়ে সেখানে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী-ভূমিদস্যু কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। আর নিজেদের এই অবৈধ সাম্রাজ্য ধরে রাখতে প্রত্যেকটি চক্র বিশাল বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী লালন পালন করে। সেখানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভূমিদস্যু চক্রের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নি¤œ আয়ের মানুষ সরকারি পাহাড় ক্রয় করে সেখানে বাস করে। মূলত পাহাড়গুলো সরকারি হওয়ায় ভূমিদস্যুরা এগুলোর দখল বিক্রি করে। যাদের সমতল ভূমিতে চড়া দামে জমি কেনার সামর্থ্য নেই তারাই অল্প মূল্যে জায়গা কেনার লোভে জঙ্গল ছলিমপুরে পাহাড় ক্রয় করেন।
জানা যায়, এখানে জমি কিনতে নি¤œ আয়ের মানুষের এত আগ্রহের মূল কারণ হলোÑ জঙ্গল ছলিমপুর চট্টগ্রাম মহানগরীর খুব কাছে অবস্থিত। এখান থেকে অতি অল্প সময়ে বায়েজিদ হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করা যায়। তাই রিকশাচালক, সিএনজি অটোরিকশা চালকসহ বিভিন্ন চাকরি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত একশ্রেণীর মানুষ এখানে জায়গা কিনে প্রতিদিন চট্টগ্রামে যাতায়াত করে কাজকর্ম করার সুবিধা ভোগ করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই সুবিধার কারণে দুর্গম পাহাড় হলেও জঙ্গল ছলিমপুরের প্রতি একশ্রেণীর মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। অবশ্য জঙ্গল ছলিমপুর পরিদর্শন করলে এখন আর ওই এলাকাকে নি¤œ আয়ের মানুষের বাস বলে গণ্য করা যাবে না। সেখানে এখন বড় বড় ভবনও নির্মিত হয়েছে। সরকারি জায়গার ওই অবৈধ ঘরগুলোতে এখন সরকারি বিদ্যুৎ সংযোগসহ নানান সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধা তারা কিভাবে পেল এ নিয়েও কোনো মাথাব্যথা নেই কারো। এভাবেই দীর্ঘ কয়েক যুগে জঙ্গল ছলিমপুর হয়ে উঠেছে ভিন্ন আরেকটি সাম্রাজ্য।
স্থানীয়দের মতে দীর্ঘ দিন ধরে জঙ্গল ছলিমপুরে দখলবাজি চললেও এসব দখলবাজির ঘটনা এখন নজিরবিহীন হারে বেড়ে চলেছে। একসময় এখানে বিএনপি রাজনীতিতে জড়িত ভূমিদস্যু আলী আক্কাসের নেতৃত্বে গড়ে তোলা বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী পাহাড়ের পর পাহাড় দখল ক্রয়-বিক্রয় করে পুরো এলাকাটিতে সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলে। সে সময় আলী আক্কাস এতই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কাউকেই কোনো তোয়াক্কা না করে ওই পাহাড়ের প্রবেশ পথে একাধিক গেট দিয়ে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। এমনকি সেখানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও প্রবেশ করতে দেয়া হতো না। কিন্তু এরপরও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যায়নি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। র্যাব সেখানে কয়েক দফা অভিযানের পর একপর্যায়ে ২০১০ সালের ২৩ মে র্যাবের ক্রস ফায়ারে আলী আক্কাস মারা যায়। আলী আক্কাস মারা যাওয়ার পর কিছু দিন সেখানে দখলবাজি থামলেও সময়ের সাথে সাথে তা আবার বাড়তে থাকে। ছিন্নমূল এলাকার বেলায়েত হোসেনসহ আরো অনেকে জানান, বর্তমানে সেখানে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও ছিন্নমূল হকার বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানের নেতৃত্বে ভূমিদস্যু চক্র আগের মতোই অপতৎপরতা চালাচ্ছে। তিনি প্রায় চল্লিশ হাজার বস্তিবাসীকে এগারটি সমাজে ভাগ করে নিজেদের তৈরি করা কানুন দিয়ে এ এলাকাকা শাসন করছেন। তিনি আরো বলেন, ওই এলাকাটি এতই দুর্গম যে চাইলেও অতি অল্পসংখ্যক পুলিশ বা অন্য বাহিনী সেখানে অভিযান চালাতে পারে না। সেখানে অভিযান চালাতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশাল ফোর্স প্রয়োজন। এ ছাড়া এলাকাটি বিশাল হলেও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে সেখানে ঠিক কত একর পাহাড় রয়েছে এবং বর্তমানে ওই এলাকার বাসিন্দা কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নির্ধারণ করা যায়নি। একই অবস্থার কারণে ওই এলাকাটি সন্ত্রাসী, খুানি চক্রের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপরাধ সংঘটিত করে অপরাধীরা জঙ্গল ছলিমপুরে গিয়ে আত্মগোপন করছে। অন্য দিকে এখানে বসবাসকারী ভূমিদস্যু চক্র অনেকটা নিজের ইচ্ছায় চলতে থাকায় অবৈধ পাহাড় দখল বন্ধ বা পাহাড়ের অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয়ার সরকারি উদ্যোগ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আয়োজিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ১৭তম সভায় এ নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো: জিল্লøুর রহমান। এ অনুষ্ঠানে সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুরে পাহাড় দখল করে প্রভাবশালীরা বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এ কথা শুনে জেলা প্রশাসক বলেন, এ কথা আমাকে আগেই জানানো উচিত ছিল। আমি জানলে তাদের থামানোর উদ্যোগ নিতাম, সরকারকে জানাতাম। এত দিন এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডিসি। জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ওই এলাকায় পাহাড় প্রভাবশালীদের দখলে আছে এটা সত্যি। তবে কী পরিমাণ পাহাড় অবৈধ দখলে আছে কিংবা সেখানে কত লোক বাস করছে এর কোনো পরিসংখ্যান আগে ছিল না। আমি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবো।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বলেন, এটা বসবাসের জায়গা নয়, বাজার, শহর বানানোর জায়গা নয়, এখানে বিদ্যুৎ আসার কথা নয়; কিন্তু এসেছে। এখানে থাকলে তারা বাঁচবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা পাহাড়ধসে মারা যেতে পারেন। তাদেরকে এখন সরানো খুব জরুরি।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238061