২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:১৮

মুনাফা বাড়াতে বিকল্প বিনিয়োগে ঝুঁকি বাড়ছে ব্যাংকিং খাতে

বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামোর সুবিধার অভাব ও চলমান পরিস্থিতিতে নতুন শিল্প বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। এক দিকে ঋণ আদায় কমে গেছে, এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে, অন্য দিকে আমানতকারীদের টাকা খাটানোর ক্ষেত্র কমে গেছে। এতে বিনিয়োগ থেকে আয় কমে গেছে ব্যাংকগুলোর। কিন্তু বছর শেষে মুনাফা বাড়িয়ে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করে। অনেকে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বাইরে এসে ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তাঋণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ভোক্তাদের। একই সাথে ঋণ যথাযথভাবে নবায়ন না করে কৃত্রিম মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ওপর ভর করেই বিদায়ী অর্থবছরের বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়ে গেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে ব্যাংকিং খাতে। কেননা এমনিতেই জামানত নিয়েও ব্যাংকের বড় বড় ঋণের বিপরীতে আদায় হয় না। হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ধকল ব্যাংক খাতকে এখনো ভোগাচ্ছে। এর বাইরে জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, যা ঝুঁকির পরিমাণ আরো বাড়ানো হচ্ছে এ খাতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বিদ্যুৎ-গ্যাস সঙ্কট দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে। এ সঙ্কটে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন না। ব্যাংকগুলো কোনো রকম চলমান প্রকল্পে বিনিয়োগ করে টিকে আছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের স্থবিরতায় যারা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা ব্যাংকের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, গত মার্চ শেষে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। জুন মাসের খেলাপি ঋণের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে কয়েকটি ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্য মতে, মার্চের তুলনায় জুন মাসে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে গেছে।
এদিকে বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো কম সুদে আমানত নিচ্ছে। এ কারণে আমানতের সুদ হার কমতে কমতে এখন ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাংক রেট অর্থাৎ ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর পরেও সংগৃহীত আমানত খাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
এর বাইরে ২০১০ সালের পর থেকে পুঁজিবাজারে যে ধস শুরু হয়; তার রেশ আজো কাটেনি। ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়েছিল ও ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগ ছিল তা আজো সমন্বয় হয়নি। অন্য দিকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, বেসিক ব্যাংকসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন রাখতে হচ্ছে তুলনামূলক বেশি হারে।
সব মিলিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা অব্যাহতভাবে কমছে। এদিকে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদি, বিভিন্ন সেবা বিল, অফিস ভাড়াসহ পরিচালন ব্যয় কমছে না, বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে।
এ পরিস্থিতিতে মুনাফা বাড়াতে ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করে দিয়েছে। বিনিয়োগ করছে ভোক্তাঋণ, ক্রেডিট কার্ডসহ জামানতবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে। পাশাপাশি যথাযথভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ না করে খেলাপি ঋণ নবায়ণ করা হচ্ছে। এতে কৃত্রিম মুনাফা বেড়ে গেছে। এ মুনাফার ওপর ভর করেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের নগদে লভ্যাংশ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বেশি ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ শ্রেণী বিভাজন করা যাচ্ছে না। ফলে পরিদর্শন করতে গিয়ে নানা বিপত্তিতে পড়ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকেরা।
ওই সূত্র জানিয়েছে, গ্রাহকদের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ক্রেডিট কার্ডের সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকদের ওপর উচ্চসুদসহ নানা সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হচ্ছে। ফলে এক দিকে মাত্রাতিরিক্ত সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে গ্রাহকদের পকেট কেটে নেযা হচ্ছে, অন্য দিকে জামানতবিহীন ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ঋণ ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ফেলছে ব্যাংকিং খাতকে। পরিস্থিতির সীমার বাইরে যাওয়ার আগেই সতর্কমূলক পদক্ষেপ নিতে না পারলে আরেক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238051