২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:১৭

ধরাছোঁয়ার বাইরে মানুষ চোরাচালানি দালালেরা

মালয়েশিয়ায় ১৯৫৪ সালের অভিবাসন আইনের ৬৫ ধারায় সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশীরা। এই ধারাটি বাংলাদেশীদের জন্য আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। 

এ দিকে সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশী শ্রমিক ধরপাকড় অভিযানের মধ্যেও থেমে নেই আকাশপথে ‘পিপল স্মাগলিং’। আর এই জঘন্য কাজটি দেদার চালাচ্ছে দুই দেশের বিমানবন্দরের কিছু অসৎ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার নিয়োগকারী দালালেরা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই দালালেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়া হাইকমিশন যদি যাচাই-বাছাই করে ভিসা দিত তাহলে বৈধ ব্যবসায়ী, পর্যটকসহ নানা পেশার মানুষ টাকা খরচ করে বিমানবন্দরে নেমে হয়রানির শিকার হতেন না। এরপরও বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের কারা অবৈধপথে গ্রামের সহজ-সরল মানুষকে মালয়েশিয়া যেতে উৎসাহিত করছে তা দেখার জন্য তো হজরত শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টাই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নজরদারি করছেন। কারা পিপল স্মাগলিংয়ের সাথে জড়িত সেটি গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ার কথা। তারা মনে করেন সরকার তথা মন্ত্রণালয় যদি ইচ্ছা করে তাহলে পিপল স্মাগলিং বন্ধ করতে বেশি সময় লাগার কথা না।
এক প্রশ্নের জবাবে একজন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এ প্রতিবেদককে বলেন, আকাশপথে প্রতিদিন যেসব ব্যক্তিকে (থেকে যাওয়ার উদ্দেশ্য ব্যক্তির) পাসপোর্ট, ভিসা লাগিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে সেটি কিন্তু মানবপাচার নয়। এটি হচ্ছে মানুষ চোরাচালান। ইংরেজিতে বলা হয় পিপল স্মাগলিং। কিন্তু অধিকাংশ সময় এই পিপল স্মাগলিংকে দেশী-বিদেশী মিডিয়াতে মানবপাচার বলে চালানো হচ্ছে। এতে দেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিটি দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশের একটি সুপ্রিম অথরিটি থাকে। ওই ধারায় তারা যে কাউকে ওই দেশে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠাতে পারে। যার কারণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠক ও অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে ঢুকতে না দিয়ে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ফেরত পাঠিয়েছে। শুধু আদিলুর রহমান নন, একইভাবে প্রায়ই তারা পাসপোর্ট ভিসা ঠিক থাকার পরও ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষকে ফেরত পাঠাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। এমন ঘটনাও ঘটছে, যাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের ওই দেশে ব্যবসায়বাণিজ্য আছে। তার মতে, এই বিষয়টি ইমিগ্রেশনের নয়, কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়াতে ধরপাকড় অভিযান শুরুর পর ফেরত আসার সংখ্যা ইদানীং কমেছে। আগে শতকরা ৩০ ভাগ ফেরত আসত। এখন সেটি ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। বিষয়গুলো আমরা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আসলে এই ঘটনাগুলোর সাথে দালাল চক্র জড়িত। তা ছাড়া আমরা এখন কোনো যাত্রীকে সন্দেহ হলে ঢাকাতেই তাকে আটকে দিচ্ছি।
এ দিকে মালয়েশিয়ার দু’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা যাকে খুশি তাকে ফেরত পাঠানোর ঘটনা দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। প্রতিদিনই সন্দেহজনক টুরিস্ট যাত্রী মনে করে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের হাজতখানায় ঢুকাচ্ছে। পরে তাদের কাছ থেকে খাবার ও ঘুমানো বাবদ রিংগিত ও ডলার আদায় করা হচ্ছে বলে ভুক্তভোগী যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদেরকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পর দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।
বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, মালিন্দ্য, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ, ইউএস বাংলা ও মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এসব ফ্লাইটে প্রতিদিন টুরিস্ট, ভিজিটর, প্রফেশনালসহ বিভিন্ন ধরনের লোকজন মালয়েশিয়া যাতায়াত করছেন।
মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা যখন তখন ১৯৫৪ সালের ইমিগ্রেশন আইনের ৬৫ ধারায় সন্দেহজনক যাত্রী ফেরত পাঠাতে পারেন। ফেরত পাঠানোর কারণ বলতে তারা বাধ্য নন। অভিযোগ রয়েছে, এই ধারাটি এখন বেশি প্রয়োগ হচ্ছে বাংলাদেশীদের ওপর। ওই কর্মকর্তার মতে, এ ক্ষেত্রে কেএলআই-১ ও কেএলআই-২ বিমানবন্দরে যারা সন্দেহজনক যাত্রী হিসেবে আটক হচ্ছেন তাদের পাসপোর্ট, ডলার জমা রেখে একটি হলুদ কাগজ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেখানে লেখা থাকছে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট-১৯৫৪ সালের ৬৫ ধারা। এরপরই যাত্রীকে বিমানবন্দরের হাজতখানায় নেয়ার আগে ওই ধারার কাগজ হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে থাকা ও খাবার খরচ বাবদ ২০০-৩০০ রিংগিত দাবি করা হয়। এরপর কয়েক দিন হাজতে রেখে ফিরতি ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২ জুলাই মধ্য রাত থেকে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের ধরপাকড় অভিযান শুরু হয়। এ পর্যন্ত ১২ শ’ বাংলাদেশীসহ কয়েক হাজার অবৈধ বিদেশী ধরা পড়েছেন। বর্তমানে তারা দেশটির বিভিন্ন বন্দীশিবিরে আটক আছেন। এরপরও এখনো দুই দেশের ইমিগ্রেশনের কিছু অসৎ কর্মকর্তার সাথে মৌখিক চুক্তি করে নামধারী টুরিস্টদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো অব্যাহত রেখেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। নজরদারির মধ্যে একজন অবৈধ যাত্রীকে ইমিগ্রেশন পার হতে গেলে দালালদের কমপক্ষে ৮ হাজার রিংগিত গুনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কুয়ালালামপুরের আমপাং এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অভিবাসন পুলিশ পিপল স্মাগলিং গ্রুপের আস্তানা থেকে ১৪ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করে বলে মালয়েশিয়ার দ্য মালয় মেইল ও স্টার অনলাইনের খবরে জানানো হয়েছে।
অভিবাসন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুক সেরি মুস্তাফা আলী জানান, চক্রের তিন বাংলাদেশী এজেন্ট কয়েকজনকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে এসে একটি বাড়িতে আটকে রেখেছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে ওই বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তিনি আরো বলেন, অভিযানে ২০টি মোবাইল ফোন এবং ২৮ হাজার ৫০০ রিংগিত পাওয়া গেছে। উদ্ধার হওয়া ১৪ জনকে দু’টি কক্ষে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল। অভিযানের সময় ওই দু’টি ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/238050