গত আট বছরে তিন গুণের বেশি উৎপাদন বাড়িয়েও সরকার এখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লাসহ কয়েকটি বড় শহর ছাড়া সর্বত্র চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কম। এর মধ্যে গ্রামের অবস্থা দেখলে মনে হয় না যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবপত্রে কখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতির তথ্য না থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ১৪ ও ১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপকদের সম্মেলনে এই বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। সম্মেলনে মহাব্যবস্থাপকেরা (জিএম) গ্রামাঞ্চলের করুণ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জিএম প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার জন্যও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
পিডিবির হিসাবে গতকাল শনিবার দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৯ হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট। কাজেই পিডিবির হিসাবে গতকাল দেশে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি বা লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, গতকাল রাত আটটা নাগাদ জেলায় বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল চাহিদার তুলনায় অর্ধেকের মতো। চাহিদা ছিল ১৭৩ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ ছিল ৮৮ মেগাওয়াট। ওই সময় বরগুনা, রংপুর এবং যশোরেও চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কম ছিল বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
গতকাল রাত ৯টা ১০ মিনিটে কারওয়ান বাজার এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) অন্যতম নির্বাহী পরিচালক রমিজ উদ্দিন সরকার জানান, একটি ট্রান্সফরমারে হঠাৎ ত্রুটি দেখা দেওয়ায় এই বিভ্রাট। ট্রান্সফরমারটি মেরামত করে দ্রুত চালু করার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন আগে ঝড়ে ভেঙে পড়া সঞ্চালন টাওয়ারটি এখনো চালু না হওয়ায় যমুনার পশ্চিম পারে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম দেওয়া যাচ্ছে। তবে ওই পারের সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে সেখানকার ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তেলভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ ইউনিট শুধু সর্বোচ্চ চাহিদার সময় চালানোর কথা, সেগুলোও সারাক্ষণ চালানো হচ্ছে। সাধারণভাবে আজ (গতকাল) কোনো লোডশেডিং থাকার কথা নয়।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আগামী বছর দেশে সাধারণ নির্বাচন। তাই সরকার চায় না এবারের মতো আগামী বছরও লোডশেডিং থাকুক। আবার বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রও চালু হয়নি। ২০২১ সালের আগে বড় একটি কেন্দ্রও চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার আরও তিন হাজার মেগাওয়াটের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। কারণ, তেলভিত্তিক কেন্দ্রই দ্রুত স্থাপন করা যায়।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, নীতিগতভাবে সরকারের এই উদ্যোগ সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি
মিশ্রণের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে ৩০ শতাংশের বেশি। কোনো কারণে তেলের দাম বাড়লে অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
অধ্যাপক তামিম বলেন, সরকার বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে চলেছে। তাই আপাতত সরকারের এ ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আপাতত তেলের দাম কম থাকায় এটা হয়তো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে না। তবে আগামী দুই বছরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বড় কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে আনতে না পারলে ঝুঁকি বাড়বে। কারণ, ধারণা করা হচ্ছে, তেলের বর্তমান নিম্নমূল্য আরও দুই বছরে বেশি অব্যাহত থাকবে না।
পরিস্থিতি কেমন
বর্তমানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ঢাকায় বসে বোঝা সম্ভব নয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় এবং প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহককে যারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, সেই পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সূত্র জানায়, দেশের সর্বত্র ছোট ছোট শহর-বন্দর ও গ্রামাঞ্চলে গড়ে দিনের অর্ধেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। বর্তমানে আরইবির চাহিদা ছয় হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু পায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াটের মতো।
এ বছর ঈদের সময়ও গ্রামাঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়েছে, যা গত দু-তিন বছর দেখা যায়নি। অথচ ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মফস্বল শহর, বন্দর ও গ্রামাঞ্চলে প্রতি মাসে প্রায় চার লাখ গ্রাহককে নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে যে চাহিদা বাড়ছে, সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না।
আবার উৎপাদন বাড়ালেই সব হয় না। গ্রাহকের কাছে বাড়তি বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামোর (উপকেন্দ্র, ট্রান্সফরমার, লাইন প্রভৃতি) ক্ষমতাও বাড়াতে হয়। এই কাজ যথেষ্ট সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। সেই কাজ চললেও সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চাহিদার তুলনায় উৎপাদনও কম। গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় ১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
এ কারণে ২০১০ সালে তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়েছিল (প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার), সেই কেন্দ্রগুলোই এখন পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। সেই কারণে সরকার ওই কেন্দ্রগুলোর মেয়াদও বাড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
আরইবি ছাড়া পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। এখানকার সর্বোচ্চ চাহিদা ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। কিন্তু কখনোই তা পায় না। সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ঘাটতি থাকে। নবগঠিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির আওতাভুক্ত এলাকা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ। সেখানে সর্বোচ্চ চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ সর্বোচ্চ ৮০০, সর্বনিম্ন ৬০০ মেগাওয়াট।
ঢাকায় ডিপিডিসির চাহিদা দেড় হাজার মেগাওয়াট আর ডেসকোর ৮৫০ মেগাওয়াট। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া এখানে পুরো চাহিদা অনুযায়ীই সরবরাহ থাকে। এ ছাড়া পিডিবির নিজস্ব কিছু বিতরণ এলাকা রয়েছে। অন্য সব বিতরণ কোম্পানির অভিযোগ, গ্রামাঞ্চল হলেও সেই এলাকাগুলোতে লোডশেডিং অপেক্ষাকৃত কম থাকে। কারণ, বিভিন্ন কোম্পানির এলাকায় বিদ্যুৎ ভাগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পিডিবির। অবশ্য পিডিবি এই অভিযোগ স্বীকার করে না। তাঁদের বক্তব্য, কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে কোন কোম্পানি কতটুকু পাবে, তা মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। সে অনুযায়ীই বিতরণ করা হয়। প্রকৃত সমস্যা হলো চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম এবং সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা।
পিডিবির সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে বিদ্যুতের উৎপাদন নয় হাজার মেগাওয়াটের মতো। তাদের হিসাবে চাহিদাও এ রকম। কিন্তু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, তারা যা প্রাক্কলন করেছিল, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে তার চেয়েও বেশি হারে। শহরে এই বৃদ্ধির হার প্রাক্কলনের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। গ্রামাঞ্চলে বেশি প্রায় ১৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আরইবির জিএম সম্মেলনেও এ কথা বলেছেন। ফলে চাহিদার যে হিসাব পিডিবি বলছে, তা সঠিক না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
তেলভিত্তিক তিন হাজার মেগাওয়াট
এই তিন হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে দেড় হাজার মেগাওয়াট হবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত বিশেষ আইনের আওতায়। এই আইনে বিনা দরপত্রে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিধান রয়েছে, যা নিয়ে কখনোই কেউ আদালতেও যেতে পারবেন না। এ কেন্দ্রগুলো থেকে সরকার বিদ্যুৎ কিনবে নির্ধারিত দামে। কোনোটি থেকে ৫ বছর এবং কোনোটি থেকে ১৫ বছর মেয়াদে।
৫০০ মেগাওয়াট করবে পিডিবিসহ সরকারি খাতের কোম্পানিগুলো। আর এক হাজার মেগাওয়াট করা হবে প্রচলিত দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বার্জ মাউন্টেড কেন্দ্রও থাকতে পারে। বেসরকারি খাতে যে দেড় হাজার মেগাওয়াট করা হচ্ছে, সেগুলো সব দিক থেকেই ২০১০ সালে করা ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রের মতো।
এই দেড় হাজার মেগাওয়াটের জন্য আগ্রহী বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ১৫ জুলাই থেকে আলোচনা শুরু করেছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সাতটি কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে বিদ্যুতের দাম নিয়ে কোনো কোম্পানিই সরকারের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়নি। সরকার ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রস্তাব করেছে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ২৮ টাকা। কিন্তু কোম্পানিগুলো ৮ টাকা ৭০ পয়সার কমে করতে রাজি নয়।
নতুন তেলভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই উদ্যোগ কোনোভাবেই জনবান্ধব নয়। এটি ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ। এতে বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্য ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি বাড়বে। তাঁর মতে, এটা সরকারের অনুসৃত নীতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কারণ, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র (বেইজলোড পাওয়ার প্ল্যান্ট) তৈরি করে বিদ্যুতের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা। নতুন তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের এই উদ্যোগ সে পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করবে।