২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:০৯

কোথায় নেই ভেজাল

খাদ্যে ভেজাল নতুন কিছু নয়। প্রায়ই এ নিয়ে চলছে অভিযান। জেল, জরিমানাও করা হচ্ছে। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না ভেজাল। জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে ভেজালের ভয়াবহ চিত্র। চকলেট থেকে প্রপার্টি প্রায় সবক্ষেত্রেই ভেজালের প্রমাণ তাদের হাতে। এতে দেখা যায়, দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে ভেজালের গণ্ডি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম ও গবেষণা বিভাগের পরিচালক ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নানা বিষাক্ত ও দূষিত ক্ষতিকর উপাদান অভিনব কায়দায় খাদ্য ও ব্যবহার্য পণ্যে মিশিয়ে ভেজাল করার বহু ঘটনা আমাদের অভিযানে ধরা পড়ছে। আমরা দায়ীদের কারা ও অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে ভেজাল কারবার বন্ধ হচ্ছে না। ভেজাল রোধে জনসচেতনতা খুবই কার্যকর। তাই সচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অর্ধদপ্তরের পর্যবেক্ষণে উঠে আসা দিতে দেখা যায়- ভেজাল হচ্ছে চালও। চকচকে ও আকষর্ণীয় করে বেশি দামে বিক্রির জন্য চালে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ইউরিয়া সার, মোম। তাছাড়া সাধারণ মোটা চাল অতিরিক্ত ছাঁটাই করে চিকন করে দেয়া হচ্ছে ধোঁকা। আর ডালে মেশানো হচ্ছে কাঠের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, বালি ও রং। ভেজাল হচ্ছে লবণও। এতে মেশানো হচ্ছে সিসা, বালি, গুঁড়া পাথর, কাকর ও রং। হলুদের গুঁড়ার সঙ্গে মিশছে সিসা, ডালের গুঁড়া, কাঠের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া, মটরের গুঁড়া, কাপড়ের রং, ক্ষার জাতীয় পদার্থ চুন ও সোডা, চালের কুঁড়া, কাউন ধান ও পচা মরিচের গুঁড়া। আর মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ইটের গুঁড়া, ডালের গুঁড়া, চুন ও সোডা, চালের কুঁড়া, কাউন ধান, পচা মরিচের গুঁড়া, টেক্সটাইলের রং, লোহার মরিচা, আটা, ময়দা ও পচা হলুদ। আসল ডিমের সঙ্গে বাজারে রয়েছে নকল ডিমও। আবার আসল ডিমও ভেজাল হচ্ছে ক্রোমিয়াম, সিসা ও রংয়ের মিশ্রণে। ধনিয়ার গুঁড়া ভেজাল হচ্ছে কাঠের গুঁড়া, রং, নষ্ট সেমাই, স’মিলের কাঠের ভুসি, আটা ও তেজপাতায়। পোস্তাদানায় মেশানো হচ্ছে সুজি। তাছাড়া বিভিন্ন মশলায় ভুসি, কাঠের গুড়া, বালি ও ইটের গুড়া তো থাকছেই। ভেজাল হচ্ছে তেল জাতীয় তরল খাদ্যপণ্যও। সয়াবিন তেল ভেজাল হচ্ছে রং মেশানো ডাল, ডালডা, অপরিশোধিত পামঅয়েল, ইঞ্জিনের তেল, তিল, গর্জন ও ব্যারনের তেলে। ভেজাল ঘিয়ে পাওয়া গেছে বিভিন্ন রং, সয়াবিন ও পামঅয়েল। তরল দুধ ভেজালে বা নকল দুধ তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে শ্যাম্পু, সাবান, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য, ফরমালিন, সাদা পাউডার, বেকিং পাউড়ার, ছানা, স্টার্চ, মাস্টার্ড অয়েল, ক্যালসিয়াম বাই কার্বনেট, দুধের মতো দেখতে সুগন্ধি। মধু তৈরি বা ভেজাল হচ্ছে চিনি, স্যাকারিন, পানি, রং ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যে। কনডেন্স মিল্ক ভেজাল হচ্ছে চালকুমড়া, পামঅয়েল, ভেজিটেবল অয়েল ও ক্যামিকেলে।
ভেজাল হচ্ছে শিশুখাদ্যও। চকলেটসহ বিভিন্ন শিশু খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে স্যাকারিন, মোম, ট্যালকম পাউডার, পোড়া মবিল, সোডা, নিম্নমানের আটা ও ময়দা এবং বিভিন্ন ধরনের রং ও রাসায়নিক দ্রব্য।
মাছ টাটকা রাখার জন্য ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিন। শুঁটকিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর ডিডিটি। বাদ যাচ্ছে না মৌসুমি ফলমুলও। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফলমুল হয়ে উঠছে বিষাক্ত। ক্ষতিকর। আম ও আনারসসহ অনেক ফলে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন ও নানা রাসায়নিক দ্রব্য। জাম, কলা, কমলা ও মাল্টায় মেশানো হয় বিষাক্ত ক্যামিকেল ও ক্যালসিয়াম কার্বাইড। ফলও পাকানো হচ্ছে এই ক্যালসিয়াম কার্বাইডে। শাক-সবজিতে মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর কীটনাশক রিনকর্ড, সিমবুন, সুমিসইডিন, হেপ্টাক্লোর, থায়াডিন ডিডিটি, ফরমালিন ইত্যাদি। তরকারি দূষিত করছে জর্দা, রং, কাপড়ের রং ও নানা রকম রাসায়নিক দ্রব্য।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, মুখরোচক মিষ্টি জাতীয় পণ্যগুলোও ভেজাল হচ্ছে। পাটালি গুড়ে মেশানো হয় রাসায়নিক দ্রব্য, মিষ্টিতে মিশছে স্টার্চ ও পাউডার। চিনিতে ইউরিয়া। আর দইয়ে মেশানো হচ্ছে টিস্যু পেপার।
কেক, জেলি ও সস তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম গন্ধ, রাসায়নিক দ্রব্য ও কাপড়ের রং। এনার্জি ড্রিঙ্কস তৈরি হচ্ছে ক্যাফেইন ও উত্তেজক পদার্থসহ সিলডেনাফিল সাইট্রেট। প্যাকেটজাত জুসে মেশানো হচ্ছে বেঞ্জয়িক এসিড। পাউরুটি, বিস্কুট ইত্যাদিতে ব্যবহার হচ্ছে ছত্রাক, পঁচা ডিম ও উপকরণ এবং বিষাক্ত রং। শরবত, ঠাণ্ডা পানি ও লাচ্ছিতে ব্যবহার হচ্ছে দূষিত পানি, বিষাক্ত রং, দূষিত পানির বরফ। মিনারেল ওয়াটারের নামে পান করানো হচ্ছে দূষিত পানি ও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। লাচ্ছি, জুস ও মিল্ক সেক তৈরি হচ্ছে মাছ হিমায়িত করার বরফ ও দূষিত পানি এবং মিষ্টি কুমড়ায়। কোমল পানীয় তৈরি হচ্ছে চিনি, সাবান ও সেভলন দিয়ে। স্ন্যাক ফুড, জ্যাম, জেলি, আচার ও চাটনি তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকর রং ও রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে। আইসক্রিমে মেশানো হচ্ছে কাপড় ও চামড়ার রং এবং দূষিত পানি, পচা ডিম, পচা নারকেল ও ক্যামিকেল।
এ ছাড়া কাঁচা মাংস টাটকা দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বাসী রক্ত ও রং। জীবন্ত পশুর মাংসও বিষাক্ত হয়ে উঠছে মোটাতাজাকরণের অপকৌশলে। কোরবানির আগে বা সারা বছর অসাধু ব্যবসায়ীরা গরু মোটা করার জন্য ব্যবহার করছে হরমোন ইনজেকশন, স্টেরয়েড, ডেক্সামেথাসন, ডেকাসন, ডাইক্লোফেন ইনজেকশন, বেটামেথাসন ও পেরিঅ্যাকটিন। বিষাক্ত ক্যামিকেলে ভেজাল হচ্ছে বিভিন্ন প্রসাধনী ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র। বিভিন্ন অভিযানে নকল পন্ডস পাউডার, সানসিল্ক শ্যাম্পু, ডাভ, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, হিমালয়া ফেসওয়াস পাওয়া গেছে। ব্যবহার্য তেলে পাওয়া গেছে ভাটিকা, কুমারিকা ও আমলা তেল। এমনকি ডিটারজেন্ট পাউডারেও ভেজাল।
লোভী ও অসাধু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের ভেজাল কারবার থেকে বাদ যায়নি জীবন বাঁচানোর ওষুধও। বিভিন্ন মানের ওষুধের পাশাপাশি ভেজাল তো রয়েছেই। এমনকি পুরো ওষুধই নকল হচ্ছে। এন্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে স্রেফ আটা ও লবণ দিয়ে।
এদিকে ২০১০ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত সাত বছরে পণ্যে ভেজালের জন্যই সংশ্লিষ্ট আইনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। আর অর্ধেকের বেশি অর্থদণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে এই অপরাধেই। গত ২৯ জুন পর্যন্ত ২৯ হাজার ৫৬২ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এ জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে ভেজালের দায়ে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৭৬৯ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ওই ৭ বছরে জরিমানা আদায় করা হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। যার মধ্যে ১১ কোটি টাকার বেশি অর্থদণ্ড কার্যকর হয়েছে ভেজালের জন্য।
ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, মানুষ প্রতিদিন কতভাবে যে প্রতারিত হচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না। অসাধু ব্যবসায়ীরা অভিনব কায়দায় নতুন নতুন কৌশলে লোক ঠকাচ্ছে। ভেজালের এত বাড় বেড়েছে যে, আসল পণ্যই যেন বাজার থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবু তা বুঝার উপায় নেই। কারণ ভেজাল বলে তো কেউ ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে না। আসল বলেই তো ভেজাল দেয়া হচ্ছে। 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=75324&cat=2/