২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১১:০৮

চিকুনগুনিয়ায় দীর্ঘ ভোগান্তি

সরকারি চাকরিজীবী সলেমান। বয়স পঞ্চাশ। কয়েক দিন আগে তিনি চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন কিছুটা সুস্থ হলেও গিঁটে গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে অফিস করছেন। তিনি জানান, জ্বরের সময় তিনি অনেকটা ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছিলেন। ব্যথার তীব্রতা অনেক বেশি ছিল। এই ভুক্তভোগী জানান, তাকে চিকিৎসক জানিয়েছেন এ ব্যথা দীর্ঘমেয়াদে থাকতে পারে। ফলে এই রোগী এখন নিয়মিত আতঙ্কে আছেন। এই প্রতিবেদককে বললেন, প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। বুয়েট মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী ইসমাইল ও তার চার সদস্যের পরিবারের সবাই কয়েকদিন ধরে চিকুনগুনিয়া জ্বরে ভুগেছিলেন। এই ব্যবসায়ী জানান, যার এই জ্বর হয়নি, তাকে বুঝানো যাবে না। এটা কত ভয়ানক অসুখ। আল্লাহ যাতে শত্রুকেও এ জ্বর না দেয়। তিনি জানান, তার জ্বর হয়েছে প্রায় এক মাস হয়েছে। কিন্তু জয়েন্টে বা গিরায় এতো ব্যথা হয় যে, হাঁটতে কষ্ট হয়। শুধু সলেমান বা ইসমাইল নন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বল্প সংখ্যক রোগী কয়েক মাস পর্যন্ত মারাত্মক ব্যথায় ভুগতে পারে। ব্যথার তীব্রতা এতই বেশি যে, আক্রান্তদের অনেকেই দীর্ঘ দিনের জন্য স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ রোগী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করে। শতকরা ১০ ভাগের কম রোগী জ্বর চলে যাবার পরও শরীরের বিভিন্ন জয়েন্ট বা গিরায় এবং মাংসপেশিতে প্রচণ্ড ব্যথায় ভোগে, যাদের অধিকাংশই দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। স্বল্পসংখ্যক রোগী কয়েক মাস পর্যন্ত মারাত্মক ব্যথায় ভুগতে পারে। তিনি বলেন, ব্যথার তীব্রতা এতই বেশি যে, আক্রান্তদের অনেকেই দীর্ঘ দিনের জন্য স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ এর তীব্রতা অনুভব করতে পারবে না। অনেক রোগী এমনভাবে বলে যে, তাদের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এদিকে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের ব্যথা কমাতে ব্যথানাশক (পেইনকিলার) দেয়া হচ্ছে। ভাইরাসজনিত এ জ্বরের প্রাদুর্ভাব রাজধানী ঢাকায় শুরু হওয়ার পর থেকে কিছু চিকিৎসক ব্যথানাশক দিয়ে ব্যথা কমিয়ে দেয়ার চিকিৎসা শুরু করেন। এসব দেখে এখন ওষুধের ফার্মেসিওয়ালারাও চিকুনগুনিয়ার রোগীকে ব্যথানাশক দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিজ্ঞানীরা চিকুনগুনিয়া রোগীদের জ্বর শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের আগে ‘পেইনকিলার’ দেয়া যাবে না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। তারা নির্দিষ্ট সময়ের আগে এসপিরিন (এনএসআইডি), কর্টিকস্টারয়েডসের ব্যবহারও নিষেধ করেছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, কর্টিকস্টারয়েডস, এনএসএআইডি এবং অন্যান্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে থ্রমবোসাইটোপেনিয়া, গ্যাসট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ব্লিডিং, রেনাল ফেইলুর এবং মৃত্যুও হতে পারে কোনো কোনো সময়। আইইডিসিআরের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. এসএম আলমগীর চিকুনগুনিয়ায় পেইনকিলার ব্যবহারসহ অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার প্রসঙ্গে জানান, চিকুনগুনিয়ায় প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না। জ্বর কমে যাওয়ার দুই-তিন দিন পর ব্যথানাশক দেয়া যাবে না। জ্বর কমে গেলেও শরীরে ভাইরাস থেকে যেতে পারে। দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকুনগুনিয়া টেস্ট হচ্ছে। টেস্টে চিকুনগুনিয়া নেই বলে নিশ্চয়তা দেয়ার পরই চিকিৎসকরা ব্যথানাশক ট্যাবলেট অথবা ইনজেকশন দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে ড. আলমগীর বলেন, বাইরের টেস্টগুলো সঠিক হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। দেখা যাচ্ছে, ওরা যেসব রোগীকে চিকুনগুনিয়া নেই বলে নিশ্চয়তা দিচ্ছে আইইডিসিআরের পরীক্ষায় অনেক সময় তাতে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। আবার উল্টোটিও হচ্ছে। যাদের বলা হচ্ছে তাদের দেহে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে আইইডিসিআরের পরীক্ষায় চিকুনগুনিয়া পাওয়া যায় না।

এদিকে, জুন-জুলাই মাস মশাবাহিত রোগের আধিক্য থাকলেও এ বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু দাবড়িয়ে বেড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির নেতৃবৃন্দ। অর্থাৎ এসব রোগের প্রাদুর্ভাব থাকবে আরো দুই মাস। শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির উদ্যোগে সমন্বিত পদ্ধতিতে এডিস মশা নিবারণ শীর্ষক মতবিনিময়ে তারা এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। এতে বক্তব্য রাখেন মেডিকেল এন্টিমোলজিস্ট তৌহিদ উদ্দিন আহমদ, মনজুর এ চৌধুরী, কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার প্রমুখ। তারা জানান, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা ও হলুদ জ্বরের জন্য দায়ী এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা। মশার এমন ভয়াবহ বিস্তারকে অপরিকল্পিত নগরায়নসহ সময়মতো ব্যবস্থা না নেয়াকে দায়ী করা হয়। এর পাশাপাশি অতি বর্ষণ, ঘন ঘন দীর্ঘদিন যাবত বৃষ্টি মশার ডিম পাড়ার অনুকূল পরিবেশ এ মশার বংশবিস্তার বাড়াতে সাহায্য করেছে। তাই এ সমস্যা আরো দীর্ঘায়িত হবে। এ ধরনের সংকট থেকে রেহাই পেতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগুনোর পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, মশক নিধন করতে হবে প্রাণীবিজ্ঞানীদের পরামর্শ নিয়ে। যেখানে মশা নেই সেখানে ওষুধ ছিটিয়ে পয়সা নষ্ট না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এ মশাকে তাড়াতে হবে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=75313&cat=3/