২৩ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ১০:৫১

সরকারি-বেসরকারি পকেটমার

মঈনুল আহসান

পাবলিকের পকেট যে কাটে সে-ই পকেটমার। ছোটবেলায় শুনেছি হাটবারগুলো ছিল এদের দৌরাত্ম্যের দিন। বিচিত্র সব কাহিনী শোনা যেত এদের নিয়ে। এরা নাকি টাকা-পয়সা গিলে ফেলতে পারে। তাই ধরা পড়লেও এদের কাছে পাওয়া যায় না কিছুই। তাদের এসব দক্ষতা নাকি পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া। অর্থাৎ তারা বংশগতভাবেই পকেটমার। এখন প্রতিটি শহরই একেকটা হাটবাজার আর প্রতিটি দিনই হাটবাজারের দিন। পুরো শহরজুড়েই এখন তাদের দাপট, পুরো শহরই তাদের কর্মক্ষেত্র, প্রতিটি দিনই তাদের দিন।
এদের নিপুণ কর্মদক্ষতার সাথে সবাই কম-বেশি পরিচিত। ঝকঝকে দিনের আলোতেও এরা সমান দক্ষ। হাজার হাজার মানুষের চোখে ভেল্কি লাগিয়ে এরা কিভাবে কাজ সাফাই করে তা প্রত্যেক ঢাকাবাসীকেই দু-একবার হলেও দেখতে হয়েছে। দেখেছি চোখের সামনে, দেখতে হয়েছে অসহায়ভাবে, কিছুই করার ছিল না। আশপাশ ঘিরে ছিল তাদেরই লোকজন। আনসার-পুলিশও ছিল, তবে নিরাপদ দূরত্বে। ছিনতাইয়ের শিকার নারীর চিৎকারে সাড়া দিয়ে কেউই এগোয়নি ছিনতাইকারীকে ধরতে। ভাবটা এমন যেন এটা কোনো ব্যাপার হলো? কখনো এদের কবলে পড়িনি। ঢাকা শহরে জীবন কাটিয়েও এদের খপ্পরে না পড়া বিস্ময়কর বটে। সম্ভবত সব সময়ই একটু বেশি সতর্ক ছিলাম; তাই হয়তো বেঁচে গেছি। তাদের হাত থেকে বেঁচে থাকার রেকর্ড শেষ পর্যন্ত তারা এবার ভেঙেই ছাড়ল। জীবন জড়িয়ে থাকা চেনা এই শহরে অবশেষে ধরা খেতে হলো অতি সম্প্রতি। মোবাইলের যুগ না হলে হয়তো ঘটনাটা ঘটত না। কারণ ওই বস্তুটিকেই শুধু সব সময় সামলে রাখা যাচ্ছিল না। এমনিতেই অনেক বছর পর দেশে ফেরার কারণে ব্যস্ততা ছিল খুব। হাতে ছিল অনেক কাজ, শপিং ছিল নিয়মিত। সব সময়ই দুই হাত ভরা থাকত বাজারের ব্যাগে। তাই রিকশায় চলার সময় সব কুল সামলানো ছিল দুরূহ। যথেষ্টই সতর্ক ছিলাম সব সময়, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে সেলফোনটা আর খুঁজে পেলাম না।
দ্রুতই মেনে নিলাম পরিস্থিতি, দেশে ফেরার আগেই মোবাইল খোয়ানোর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কারণ সব সূত্র থেকেই ওই জিনিসটার প্রতি দেশের পকেটমার সমাজের অত্যধিক আসক্তির কথা শুনে আসছিলাম নিয়মিত। সেজন্য সাথে এনেছিলাম তিন-তিনটা ফোন। বস্তুত ডিজিটাল এই যুগে এ রকম ব্যাকআপ ছাড়া চলাফেরা করা নিতান্তই বোকামি।
নিজেকে স্মার্ট ভাবছিলাম বটে কিন্তু কখন, কোথায়, কিভাবে যে ফোনটা খোয়ালাম, অনেক চিন্তা করেও হদিস করতে পারলাম না। আবার নিজের ‘ধরা না খাওয়া’র রেকর্ড অক্ষুণœ রাখাতে মানতেও চাইছিলাম না যে ফোনটা পকেটমার নিয়েছে; বরং রিকশায় উঠতে পকেট থেকে কোথাও পড়ে গিয়ে থাকবেÑ এমন যুক্তিতেই অটল থাকার চেষ্টা করেছি, যদিও বাড়ির অন্যরা তা মেনে নিতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ভালো ব্যাকআপের কারণে ভুলেই গেলাম মোবাইল খোয়ানোর শোক। দামি ফোনগুলো বাসায় রেখে সবচেয়ে কমদামিটা সাথে নিতাম চলাফেরার সময়।
সকালেই আবার ছুটতে হবে। দেশের কাজগুলো গুছিয়ে আবার কত বছরের জন্য বাইরে যেতে হবে তা কে-ই বা জানে। তাই পুরো রিচার্জড হতে দরকার ছিল ভালো ঘুম। এর আগে ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েদিলাম পুরনো নম্বরের ‘মৃত্যু সংবাদ’, দিলাম নতুন নম্বর। ডিসেম্বর মাসে দেশে মশা ছিল না, আবহাওয়াও ছিল অনুকূল, তাই ঘুম হচ্ছিল ভালো। কিন্তু সেই ঘুম ভেঙে গেল নতুন ফোনের শব্দে। ফোন তুলে দেখি বাজে রাত ১টা, ও প্রান্তে শ্যালিকা। মহাবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে এত রাতে?
দুলাভাই, আপনার ফোন থেকে কেউ একজন রিং দিচ্ছে। প্রথমে তৃণা-তান্নাকে করেছে, এখন করছে আমাকে। মনে হচ্ছে, মেয়েদের নাম আন্দাজ করে ফোন দিচ্ছে। ব্যাটাকে টাউট মনে হলো। জানতে চায় আমি কে, ফোনটা কার, ফোনের মালিক কী করে ইত্যাদি। টোপ মনে হচ্ছে, তাই এত রাতেই কল দিলাম, খুব সাবধানে থাকবেন। কোনোভাবেই এদের খপ্পরে পড়া যাবে না।’
এ দেখি নতুন তামাশা, ফোন ‘কোরবানি’ দিয়েও রেহাই নেই। ঘটনা শুনে পরদিন সকাল থেকে সারা দিন জনে জনে শোনাতে লাগল মোবাইল টাউটারির জানা-অজানা সব বিচিত্র কাহিনী, উদ্দেশ্য আমাকে অ্যালার্ট করে দেয়া। আমিও অ্যালার্ট হয়ে গেলাম যতটা সম্ভব। কারণ ব্যাকআপের দামি ফোনগুলো আর খোয়ানোর ইচ্ছা ছিল না।
দু’দিন কাটল ভালোই, ভাবলাম এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম বোধহয়। কিন্তু তৃতীয় দিন মধ্যরাতে আবার বাঁধলো গোল, শুরু হলো লোমহর্ষক নাটক। তখন শুয়েছি মাত্র, এরই মধ্যে কাজের মেয়ের চিৎকার, মামা ওঠেনÑ ফোন পাওয়া গেছে। কাঁচা ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কী হচ্ছে, মেয়েটাই বা কী বলছে। যতটুকু বুঝলাম তার মর্ম হলো, কেউ একজন আমার হারানো ফোন থেকে রশিদ ভাইকে কল দিয়ে বলেছে তারা ফোনটা ফেরত দিতে চায়, কিন্তু কোথায় কাকে কিভাবে দিতে হবে তা বুঝতে পারছে না। রশিদ ভাই তাদেরকে দিয়েছেন বাসার ঠিকানা, বলেছেন ফোনটা আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে। ওরা বলেছে, তারা থাকে ওই ঠিকানার আশপাশেই, ১০ মিনিটের মধ্যেই বাসায় এসে ফোনটা দিয়ে যেতে পারবে।
মধ্যরাতে বাসায় এসে চুরি যাওয়া ফোন দিয়ে যাবে অপরিচিত লোকজন, এটা কেউ মানতে পারছিল না। এত রাতে গেট খোলা ঠিক হবে কি না তাও কেউ বুঝতে পারছিল না। ঘটনার ঘনঘটায় সবাই এতটাই হতবাক ছিল যে, কী করতে হবে তা কেউ যেন ভাবতে পারছিল না। বড়বোন আমাকে গেটে যেতে বারণ করলেন। উনার ধারণা, ফোন ফেরত দিতে আসা একটা কৌশল মাত্র, আসল উদ্দেশ্য প্রবাসীকে চিনে যাওয়া। আশঙ্কা যথার্থ এবং সেটা আরো প্রকট হলো যখন বলা হলো, কাল ভোরে লোকগুলো বাড়ি চলে যাবে তাই যে করেই হোক ফোনটা ওই মধ্যরাতেই ফিরিয়ে দিতে চায়। কেউ আর গেটের দিকে এগোচ্ছে না। শেষে আমিই হাঁটা দিলাম গেট সোজা, যা থাকে কপালে। দেখাদেখি পিছু নিলো অন্যরা।
তালা দেয়া কলাপসিবল গেটটা না খুলে ভেতরেই দাঁড়ালাম। দেখি একজন, দু’জন করে আট-দশজন লুঙ্গি পরা যুবক একে একে জড়ো হচ্ছে গেটের বাহিরে। সামনে সেই ফোন হাতে এক চটপটে যুবক। গড়গড় করে একদমে সে বলে গেল, ‘রাস্তার মাথায় বালুর মধ্যে পইড়া আছিল ফোনডা। একজনের নাম করে বলল, ‘হ্যায় দেইখা কুড়াইয়া নিছে’, বলে পেছনে লুকোনো একজনকে দেখিয়ে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়েই বুঝলাম ছেলেটা মিথ্যা বলছে। ফোনের গায়ে সামান্য স্ক্র্যাচ বা ধুলোবালু লাগার বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই। পকেটমারের দায় এড়াতে কুড়িয়ে পাওয়ার গল্প ফেঁদেছে আর কি। কিন্তু কথা বাড়ালাম না, সবাইকে লম্বা একটা ধন্যবাদ দিয়ে সকালে দেখেশুনে বাড়ি যেতে বললাম আর ফোনটা যে পেয়েছিল তার হাতে গেটের ফাঁক গলেই ধরিয়ে দিয়েছিলাম কয়েক শ’ টাকার বকশিস।
সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখি, সবার মনেই অবিশ্বাস আর শঙ্কা। সবাই নিশ্চিত যে পুরো গ্যাং এসে চিনে গেছে আমাকে। রীতিমতো ‘শাঁখেরকরাতে’র অবস্থা, বাঁচার কোনো রাস্তা যেন আর খোলা নেই। কিছুই করার ছিল না, যা হওয়ার তাই হবে। কিছু ঘটলে অবস্থা বুঝে সামলাতে হবে। তাই ফিরে পাওয়া ফোনটা পকেটে ফেলে আবার নেমে পড়লাম ঘর আর বাইরের কাজে।
কিন্তু আমি ভুলে গেলেও ঘটনা আমার পিছু ছাড়ল না। দুই দিন পর রাস্তায় মুখোমুখি পড়ে গেলাম মাঝবয়সী এক যুবকের। মুখভর্তি তার মেহেদি রঙ দাড়ি। রাস্তা চলতে দেখা হয় সব সময়, সালাম-কালামও হয়। তাই মুখটা পরিচিত। তবে কখনো কথা হয়নি, তাই নাম জানি না। সেই যুবক সামনাসামনি হতেই বলল, ‘হেরা আপনার ফোন ঠিকমতো ফেরত দিছে তো? আমি কইছি অক্ষণ উনার ফোন ফিরাইয়া দিবি, নইলে তোরার ঠ্যাং ভাইঙ্গা ফালামু।’ মনে মনে চমকে উঠেছি। কিন্তু মুখে প্রশান্ত হাসি নিয়ে মাথা নেড়ে বলেছি, ‘হ্যাঁ, ঠিকমতো পেয়েছি, থ্যাংক ইউ।’ কথা বাড়ায়নি, তবে মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে গেছে পুরো ঘটনা।
এই মেহেদি রঙ দাড়িওয়ালা হলো ওই এলাকার পকেটমারদের সরদার, আর সেই যুবকের দল যারা বাসায় এসেছিল ফোন ফিরিয়ে দিতে, তারা হলো এর পুরো গ্রুপ। ওই যুবকেরা আমাকে চিনত না। রাস্তার মোড়ে তারা পিকপকেট করেছে রুটিনমতোই, সেগুলো তুলে দিয়েছে সরদারের হাতে। আর সরদার সাহেব ফোন দেখে, বর্ণনা শুনে বুঝে গেছে যে, তার দলের শিকার হয়েছি আমি। তারপরই ঘটেছে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। সরদারের নির্দেশে তারা খুঁজে বের করেছে ফোন ফেরত দেয়ার সহজ পথ। অতঃপর দলবেঁধে বাসায় এসেছে আমাকে ঠিকমতো চিনে যেতে। তবে আবার টার্গেট করার জন্য নয়, বরং যাতে ভুল করেও আর কখনো আমার পকেটে হাত দিতে না হয় সেজন্য। সরদার সাহেব আমার প্রতি কেন এতটা মানবিক হলেন তা আমার জানা নেই। তবে চলতি পথে যতবারই তার মুখোমুখি পড়েছি তাকে দেখেছি আমার প্রতি অতি বিনয়ী, কখনো সে আমার সাথে সালাম-কালাম মিস করেনি। তবে তাকে মসজিদে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
বড়ই বিচিত্র মানুষের মন। সে রূপ বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। যেমন অবলীলায় পকেট কেটে সর্বস্বান্ত করতে পারে একজনকে, সেই আবার আরেকজনকে ছেড়ে দেয় সম্মান করে। এই করছে অপরাধ, আবার পরক্ষণেই হচ্ছে অনুতপ্ত। পাপ-পুণ্য আর ভালো-মন্দের এই টানাপড়েন খুব বেশি দেখা যায় অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় আক্রান্ত সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর মধ্যে। শিক্ষিতদের মনোজগৎ আবার ভিন্ন। তাদের সংস্কৃতিতে অনুতাপ-অনুশোচনা আছে বলে মনে হয় না। তাদের মধ্যে আছে শুধুই নিজের স্বার্থ রক্ষার উদগ্র বাসনা, যা কলুষিত মনেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
দুই.
আমাদের শিক্ষাদীক্ষার ধরন ও মান যে মনকে কলুষমুক্ত করতে যথেষ্ট নয়, তা দেশের অফিস-আদালতে যারা কোনো কাজে গেছেন তারা বিলক্ষণ জানেন। তেমন অভিজ্ঞতা একেবারেই হয়নি, সেরকম লোক বাংলাদেশে বিরল; এমন ব্যক্তি অবশ্যই মহাভাগ্যবান। আমিও সেই ভাগ্যবানদের দলেই ছিলাম এতকাল। ভিনদেশী জীবনের কারণে দেশের অফিস-আদালত মাড়াতে হয়নি খুব একটা। কিন্তু সেই রেকর্ডও ভেঙে গেল এবার। ভেঙে দিলো থানার ভোটার আইডি অফিস।
দেশে না থাকলেও মাতৃভূমির আইডি বলে কথা। ভাবলাম দেশে যখন এসেছি তখন দেখিই না আইডিটা করা যায় কি না। গেলাম সেই অফিসে। অতি স্মার্ট অফিসার। কথাবার্তায় চোস্ত, স্যুট-টাই পরা কেতাদুরস্ত। আইনকানুনে দৃঢ় এবং খুবই চটপটে ও বুদ্ধিদীপ্ত। আমাকে চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিলেন করণীয়। আশ্বস্ত করলেন প্রক্রিয়া মেনে কাজ করলে অসুবিধা হবে না বলে। দেখলাম প্রয়োজনীয় সব কাগজ আছে সাথে। লাগবে শুধু ওয়ার্ড কমিশনারের সার্টিফিকেট। হাতে আছে দশ-বারো দিন, ঢের সময় নিঃসন্দেহে।
অফিস থেকে ফিরেই নেমে পড়লাম কমিশনারের খোঁজে। হোঁচট খেলাম শুরুতেই। অফিস তার কয়েকটা। কোনটা পার্টি অফিস, কোনটা আবার সালিসের আখড়া। এ রকম এক অফিস থেকে বলা হলো সকালের দিকে বাসায় যোগাযোগ করতে, ওটাই নাকি কমিশনার সাহেবের সরকারি অফিস। রীতিমতো গোলক ধাঁধার অবস্থা। ঠিক সেই সময় সহায়ক হিসেবে পাশে পেলাম পাড়ার ছোট ভাই আমিনকে। আমিন বলল, ‘এভাবে হবে না, আপনি বাসায় যান, কমিশনারের ব্যাপারটা আমি দেখছি।’
সন্ধ্যার দিকে আমিন নিয়ে গেল কাছেই আরেকটা অফিসে। আমি শুধু আমিনকে ফলো করলাম, ভাবলাম এই বুঝি আসল অফিস। কিন্তু না সেখানেও নেই কমিশনার সাহেব। ওটাও উনার অফিস নয়। ওটা হলো উনার লোকাল এজেন্টের অফিস। অফিস ঘরটা না থাকলে এজেন্টকে লোকাল মাস্তান বলা যেত। নামও তার ঠিক তেমনই। চেহারা-সুরত, কথাবার্তা সবই জাতমতো। তিনি বুঝে নিলেন আমার কাগজপত্র। কমিশনারের কাছে পৌঁছানোর আশ্বাস দিলেন আর হাতিয়ে নিলেন এক হাজার টাকা। কোনো রসিদ দিলেন না, কোথায় খরচ হবে তাও বললেন না। শুধু বললেন, ‘আপনে চিন্তা কইরেন না, সার্টিফিকেট রেডি হইলে আমিনরে ফোন দিমুনে, সে আপনারে সার্টিফিকেট পৌঁছাইয়া দিবো।’ আর কিছু করার ছিল না অপেক্ষা করা ছাড়া। বল এখন অজানা কোনো এক কোটে, সেই কোট সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই।
কাজ তত সহজে হলো না। মাঝে এক সময় ফোনে কথা বললেন কমিশনার সাহেবের সেক্রেটারি। অযথাই একগাদা ভুল বের করে জিজ্ঞেস করে করে কারেকশন করলেন বলে মনে হলো। পূর্বোক্ত এজেন্টের প্রসঙ্গে তিনি যেভাবে টেনে টেনে কথা বলছিলেন, তাতে এটাও মনে হলো যে ভাগ আদায় করা তার জন্য সম্ভবত সহজ হবে না, হয়তো তিনি কিছুই পাবেন না। আবার রাজা সাহেবের কারণেই আমার কাছেও কিছু চাইতে পারছেন না। বেচারা সেক্রেটারি, চাকরি হয়তো করে সরকারের। কিন্তু সামাল দিতে হয় পাবলিকের ঘাড়ে চেপে বসা ‘জনপ্রতিনিধি’ আর তার সাগরেদদের, অতি জটিল কাজ বটে।
সেক্রেটারি জানালেন কমিশনার সাহেবের বিস্তর ব্যস্ততার কথা, সব ব্যস্ততাই রাজনৈতিক। আসলে জনতার কথা বলে গদিতে বসে এখন তিনি ব্যস্ত আখের গোছাতে, জনতা এখন অপশনাল। তার পরও আমার কাজটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করে দেয়ার আশ্বাস দিলেন সেক্রেটারি সাহেব। খুব সদয় মনে হলো আমার প্রতি।
অবশেষে সেই সার্টিফিকেট পেলাম সাত দিনের মাথায়। হাতে তখন বাকি মাত্র তিন দিন। সে অবস্থাতেই গেলাম ভোটার আইডি অফিসে। অফিসার দ্রুত দেখা দিলেন আমাকে। মনে হলো অপেক্ষায় ছিলেন আমার জন্য। একই রকম বুদ্ধিদীপ্ত, চটপটে। আমার সামনেই দু-তিনজনকে ধরে ফেললেন খাপ ছাড়া কাগজপত্রসহ, নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেন শক্ত জেরার চোটে। আর আমার কাছে জানতে চাইলেন এত দিন দেরি করার কারণ। বললাম, কমিশনার কাহিনী। ক্ষুব্ধ হলেন আর বিস্মিত হলেন হাজার টাকা বখরার কথা শুনে। মুখে একচোট নিলেন জনপ্রতিনিধিদেরকে। বুঝা গেল দেশের পাবলিক হলো সরকারি কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধিদের টানাটানির রশি; দু’পক্ষের টানে জনতার জান আর ঠিক থাকে কিভাবে।
ভদ্রলোক বুঝিয়ে বললেন ডেড লাইন উতরে যাওয়া কাজের ক্ষেত্রে উনার দায় ও দায়িত্ব। বলে রাখা ভালো যে, প্রবাসীদের ক্ষেত্রে আইডির দরখাস্ত করতে কোনো ধরাবাঁধা সময়সীমা থাকার কথা নয়। নির্দিষ্ট সময় ধরে প্রবাসীরা দেশে ফিরতে পারেন না। তবে সে বিষয়ে কিছু না বলে বরং বললাম, উনার যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেভাবে সম্ভব হলেই শুধু কাজটা করতে। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান, বুঝে ফেললেন আমি ঝামেলামুক্ত থাকতে চাইছি। সেক্রেটারিকে ডেকে ধরিয়ে দিলেন আমার কাগজপত্র। আমি বেরিয়ে এলাম ডেটা এন্ট্রি করার জন্য। কিন্তু সেক্রেটারি বের হলেন বেশ কিছু পরে।
চটপটে অফিসারের সেক্রেটারিও পরিপাটি, চটপটে। বয়স বেশি নয়। মুখভর্তি কালো দাড়ি। কম্পিউটার অন করার ফাঁকে তিনি বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না কাজটা করতে আসলে কিছু খরচাপাতি আছে।’ দেখলাম, বেচারা আমার দিকে তাকাতে পারছে না। জানতে চাইলাম কী রকম সেই খরচাপাতি। তিনি বললেন, পাঁচ হাজার টাকা। আমি এতটা আশা করিনি, আমার ধারণা ছিল দুই-তিন হাজারের বেশি চাইবে না। বললাম, ‘পাঁচ হাজার খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। তিনের মধ্যে সারা যায় না।’ তিনি চোখ কম্পিউটারে রেখেই বললেন, ‘আসলে আমাকে যেমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেটাই বললাম, এর কম নেয়ার নির্দেশনা নেই।’ বুঝলাম আমাকে দাঁড় করিয়ে সময় নেয়া হয়েছিল, এই নির্দেশনা নিতেই।
দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, পরদিন বন্ধ আর শনিবার দুপুরে আমার রিটার্ন ফ্লাইট। অতএব ‘আক্কেল সেলামিই’ ছিল তখন আমার সামনে এক মাত্র পথ। সৌভাগ্যবশত শেষ মুহূর্তের কেনাকাটার জন্য বেশ কিছু টাকা ছিল সাথে। সেটা দিয়েই সামাল দিতে হলো সেই সরকারি পকেটমারদের।
তিন.
দেশের অশিক্ষিত-কুশিক্ষিত পকেটমারদেরও বিবেক আছে, আছে নীতিবোধ। মানুষের প্রতি সম্মান ও মমত্ববোধও আছে তাদের মধ্যে। সেই নীতিবোধের কারণেই তারা যা পায় তাই খায় না, তাই ধরে না। অপরাধের জন্য অনুতপ্তও হয় কখনো কখনো, কিন্তু শিক্ষিত পকেটমাররা একেবারেই বিবেকহীন, নীতিবোধশূন্য। ক্ষমতার অনুপাতে হয় এদের চাহিদা। শিক্ষা যত ক্ষমতাও তত, চাহিদাও ততোধিক। এরা হাতের কাছে যা পায় তাই ধরে, তাই খায় এবং সেটা করে প্রকাশ্যে জানান দিয়ে, বেসরকারি সমগোত্রীয়দের মতো লুকোচুরির কারবার এরা করে না। অনুতাপ এদেরকে স্পর্শ করে না, মায়া-মমতার ধার এরা ধারে না। ছোট অপরাধে হাত পাকিয়ে এরা বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে বড় অপরাধের ওপর, পড়ে যায় অপরাধের নেশায়। সেই নেশা অবশেষে ছাড়িয়ে যায় তাদের পেশাকেও।
সরকারি এই পকেটমার গোষ্ঠীর বেসরকারি নাম ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। সেই সার্ভেন্ট হতে তাদেরকে অনেক পাস দিতে হয়, অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হয়। অতঃপর সার্ভেন্ট নাম ধারণ করেই এরা চেপে বসে পাবলিকের ঘাড়ে। এদেরই অন্য পিঠ হলো আমাদের কথিত ‘জনপ্রতিনিধির’ দল। এরা আকারহীন তরল পদার্থের মতো, অবস্থা অনুযায়ী অনবরত বদলাতে থাকে এদের কাজকর্ম ও অবস্থান। তাই এদেরকে ধরা মুশকিল, বুঝাও মুশকিল। পাবলিকের দুয়ারেই এদের বসবাস। তাই জনতার পকেট এদের জন্য থাকে অবারিত। চাহিবা মাত্র আমজনতা এদের চাহিদা পূরণে হয় বাধ্য।
এই দুই গোষ্ঠী মিলেই দেশের সরকার আর সেই সরকারের সেরা প্রজেক্টগুলোর একটি হলো বাংলাদেশের মোবাইল ফোন সার্ভিস। দেশের এই সার্ভিস যেন একটা রাজহাঁস, গলাভর্তি খাবার নিয়ে আকাশের দিকে মুখ তোলা মাত্রই আবার খিদে পায়, তারপর আবার খায়, খাওয়ার ওপরেই কাটে এর জীবন। আমলা ও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা ছাড়া শুধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয় এমনভাবে জনগণের রক্ত শোষণ করা। বিদেশে মোবাইল সার্ভিসের সাথে স্মার্টফোন দেয়া হয় বিনাপয়সায়। মাসব্যাপী টক, টেক্সট, ডেটা পাওয়া যায় আনলিমিটেড, ফ্রি। ফোনও টেকে বহু দিন। বাংলাদেশে এসব দুঃস্বপ্ন। বিপুল ক্যাশ ঢেলে কেনা ফোনও টেকে না বেশি দিন। আর ফ্লেক্সিলোডের পর ব্যালান্স যে কিভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এর কারণ অবশ্যই গোষ্ঠীস্বার্থ। দেখেশুনে মনে হয়, বেসরকারি পকেটমারের কাছে থেকে কখনো কখনো পার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সরকারি পকেটমারদের থেকে মানুষের মুক্তির আশা নিতান্তই দুরাশা মাত্র।
এ জন্যই সোনা ফলা শ্যামল বাংলা আজ হয়ে পড়েছে বসবাসের অযোগ্য। মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে চায়। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে সাগর-মহাসাগর, মরু-অরণ্য মাড়িয়ে হলেও যেতে চায় এমন কোথাও, যেখানে আছে জীবনের অতি সাধারণ অধিকারগুলো নিয়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম নিশ্চয়তা। এ কারণেই আজকের বিশ্বে এমন জনপদ পাওয়া যাবে না, যেখানে নেই বাংলাদেশের কোনো মানুষ। এদের অনেকেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সরকারি পকেটমারদের কাছে সর্বস্বান্ত হয়ে। সর্বস্ব খোয়ানো এমন হতভাগাদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশকে ঠিক করতে হলে দেশটাকে আকাশে তুলে উল্টে ফেলে শুরু করতে হবে নতুন করে। তা ছাড়া এ দেশে মানুষের মুক্তি অসম্ভব।’ বড়ই দুর্ভাগ্যজনক প্রিয় জন্মভূমির আজকের এই পরিণতি। সার্চ : Mainul AhsanÕ at www.amazon.com
লেখক : লস এঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র্রপ্রবাসী
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237973

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/237973