ছাত্রলীগের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের দরজা-জানালা :শিপন আহমদ
১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৭

ছাত্রলীগে সংঘর্ষ : এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ভাঙচুর

পাঁচ বছরের মাথায় আবারো হামলা চালিয়ে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ব্যাপক ক্ষতি করেছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের হামলায় সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ও হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন হোস্টেল ভাঙচুরের ঘটনা নিশ্চিত করেছেন। হামলায় ছাত্রাবাসের প্রথম ব্লকের দু’টি করে দরজা-জানালা, দ্বিতীয় ব্লকের একটি দরজা ও জানালা, শ্রীকান্ত ব্লকের ছয়টি দরজা ও জানালা, পঞ্চম ব্লকের ১৪টি দরজা ও জানালা এবং চতুর্থ ব্লকের ১৬টি দরজা ও জানালা ভাঙচুর করে তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরী এবং ডায়মন্ডের নেতৃত্বে এ হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শিার্থীরা জানান, আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জিত সরকারের অনুসারী হোসেইন গ্রুপ ও টিটু গ্রুপের মধ্যে বুধবার রাতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হাতাহাতি হয়। রাতে হোস্টেলে দুই গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৫টার দিকে সশস্ত্র অবস্থায় টিটুর নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন ছাত্রলীগ ক্যাডার অতর্কিত হামলা চালায় কলেজ হোস্টেলে। এ সময় হোস্টেলের ৪ ও ৫ নম্বর ব্লকের শতাধিক করে দরজা জানালা ভাঙচুর করে। বেশ কয়েকটি কও ভাঙচুর করে তারা। প্রায় এক ঘণ্টা ভাঙচুরের পর তারা চলে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ এবং কলেজ প্রশাসন ঘটনাস্থলে যায়। এ নিয়ে হোসেইন গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জিদান আল মুসা জানান, বুধবার রাত থেকেই এই দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। রাতে পুলিশ চলে গেলে বৃহস্পতিবার ভোর রাতে ফের এসে তারা এ ঘটনা ঘটায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পরিস্থিতি এখন শান্ত। ভাঙচুরের ঘটনায় কলেজ কর্তৃপ অভিযোগ দিলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত বুধবার দুপুরে ছাত্রলীগ নেতা আরহামের প নিয়ে হোসাইন গ্রুপের নেতাকর্মীর সাথে বাগি¦তণ্ডায় জড়ান টিটু চৌধুরী এবং ডায়মন্ড। পরে টিটু এবং ডায়মন্ডকে টিলাগড়ে ধাওয়া দেন এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এ ঘটনার পরপর কলেজ কর্তৃপ সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সব ছাত্রবে ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করে শাহপরাণ থানার ওসি আনোয়ারুল আলম জানান, বিপুলসংখ্যক পুলিশ ছাত্রাবাসে মোতায়েন করা হয়েছে। খবর পেয়ে এমসি কলেজের অধ্য নিতাই চন্দ্র চন্দ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
তদন্ত কমিটি গঠন : ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার সময় ভাঙচুরের ঘটনায় সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কলেজে জরুরি বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শিার্থীদের হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপ। কলেজের অধ্য নিতাই চন্দ্র চন্দ জানান, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিার্থীদের নিরাপত্তা এবং অনাকাক্সিত ঘটনা এড়াতে শিার্থীদের সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে হোস্টেল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় দোষীদের খুঁজে বের করতে অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আব্দুল কুদ্দুসকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে এবং আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগ। তার ঠিক ৫ বছর ৫ দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার আবারো এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের সব কয়টি ব্লকের দরজা, জানালা ও রুম ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। ছাত্রলীগের কোনো গ্রুপ হামলার দায় সরাসরি স্বীকার না করলেও ছাত্রলীগ মহানগর শাখা জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় নির্দেশানুযায়ী, হামলার সাথে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হোস্টেলের বয় আব্দুল কুদ্দুস জানান, গতকাল সকাল ৯টার দিকে ২৫-৩০ জনের একটি দল ঢুকে ছাত্রাবাসে ভাঙচুর শুরু করে। ওই হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র মোহাম্মদ তোফায়েল জানান, হামলাকারীরা ছাত্রাবাসের সব কয়টি ব্লকেই ভাঙচুর চালিয়েছে। বিশেষ করে ৪ ও ৫ নম্বর ব্লক এবং শ্রীকান্ত ব্লকের বেশি তি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের জেলা ও মহানগর পর্যায়ের দুই নেতা জানান, টিটু চৌধুরী ও বেলাল আবেদীন ডায়মন্ডের নেতৃত্বে তাদের সহযোগীরা ছাত্রাবাসে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ছাড়াও হামলার সময় ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যদর্শীরাও এসব হামলাকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করেন। তারা দু’জনেই জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রঞ্জিত সরকারের অনুসারী। বুধবার রাতে ছাত্রশিবির কর্মীদের ছাত্রলীগে অবস্থান দেয়ার বিষয় নিয়ে এমসি কলেজের পাশে টিলাগড় পয়েন্টে টিটু চৌধুরীর সাথে রঞ্জিত সরকার সমর্থিত আরেকটি গ্রুপের কথা কাটাকাটি হয়। পরে তা ছাত্রাবাসে গিয়ে সংঘর্ষে গড়ালে হোসেন আহমেদ গ্রুপের সমর্থিত কর্মীরা টিটু চৌধুরী ও তার গ্রুপের অনুসারীদের ছাত্রাবাস থেকে বের করে দেয়। হোসেন আহমেদ জানান, বুধবার রাতের ঘটনার বদলা নিতেই বৃহস্পতিবার সকালে ছাত্রাবাসে হামলা চালায় টিটু চৌধুরী ও তার সমর্থকেরা। এ ব্যাপারে টিটু চৌধুরীর বক্তব্যের জন্য তার মোবাইল ফোন নাম্বারে কল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম তুষার জানান, ঘটনার পর কেন্দ্রের নির্দেশে অভিযুক্ত সব নেতাকর্মীকে ডেকে তাদের বিস্তারিত ঘটনার কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। তিনি জানান, হামলার ঘটনার সাথে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কেউই কোনো কমিটিতে পদধারী না, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ কর্মী। ঘটনার বিস্তারিত জেনে অভিযুক্ত সব ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৮ জুলাই এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলায় এখন পর্যন্ত তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। গত ৩১ মে, সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম উম্মে শারাবান তাহুরা বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। এর আগে পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন দুইবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে তা যথাযথ না হওয়ায় গ্রহণ করেননি আদালত।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235559