১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৪

ব্যাংকিং খাতে তিন মাসে সুদ মওকুফ ৩০০ কোটি টাকা

শত কোটি টাকাই চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের

ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা বাড়ছে। এতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। সেই সাথে বাড়ছে সুদ মওকুফের পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ মওকুফ করা হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই শত কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করা হয়েছে রূপালী ব্যাংকের প্রায় ৫৪ কোটি এবং সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৪৩ কোটি টাকা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। আর রাজনৈতিক প্রভাবেই সুদ মওকুফ করা হচ্ছে, যা ব্যাংকিং শৃঙ্খলার পরিপন্থী। ব্যাংকের সুদ মওকুফ করায় এক দিকে যেমন ব্যাংকের আয় কমে যায়, পাশাপাশি নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন এমন গ্রাহকদের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে বেড়ে যায় ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা। ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
জানা গেছে, সাধারণত: দু’টি ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করা হয়। একটি হলো, দীর্ঘ দিন যাবত যেসব ঋণ পরিশোধ করা হয় না, এককালীন পরিশোধের শর্তে ওইসব ঋণের কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। তবে, এক্ষেত্রে ব্যাংক যেন লোকসানের সম্মুখীন না হয়, অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ ও ব্যয় যেন উঠে আসে সে দিকে খেয়াল রাখা হয়। অপরদিকে ঋণ পুনঃতফসিলের সময় কিছু সুদ মওকুফ করা হয়। এটা করার ফলে একদিকে ব্যাংকের দীর্ঘ দিনের খেলাপি ঋণ আদায় হয়। এতে ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা বেড়ে যায়। অপরদিকে আয়ও বাড়ে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যাথাযত নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক চাপ থাকে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদ মওকুফ করে নেন। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাংক। কেননা, ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে। কিন্তু ঋণের সুদ আদায় না হওয়ায় বেড়ে গেছে ব্যায়। শুধু সুদ মওকুফের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে না, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক চাপ থাকে। যেমন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহক ব্যাংকে যে জামানত দেয়, তা যথাযথ হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধকী জমি বা সম্পদ অতিমূল্যায়িত করা হয়।
চার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আশায় সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে।
রূপালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অতীতের চেয়ে এখন ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক চাপ, স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে সরকারি এ চার ব্যাংকে সুদ মওকুফ বেড়ে গেছে। চাপও রয়েছে সুদ মওকুফ করার। এভাবে অনেকেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। সুদ মওকুফ বেশি হওয়ায় ব্যাংকের আয়ও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সুদ মওকুফের মাধ্যমে একটি খাত বা ব্যক্তিকে সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু সুদ মওকুফ বেশির ভাগ সময় যথাযথভাবে করা হয় না। অনেকেরই ক্ষমতাসীনদের সাথে যোগসূত্র থাকে। আর এ যোগসূত্রের ভিত্তিতেই রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের সুদ মওকুফ করে থাকে। এ কারণেই সরকারি ব্যাংকগুলোর বেহাল অবস্থা। তিনি বলেন, সুদ মওকুফের এ সংস্কৃতি ব্যাংকিং শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এ কারণে যতটুকু সম্ভব সুদ মওকুফ থেকে এড়িয়ে চলা।
ব্যাংকগুলো থেকে সুদ মওকুফের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করেছে ১০২ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৩০টি সুদ মওকুফ করেছে ১৭৮ কোটি টাকা, এবং তিন বিদেশী ব্যাংক সুদ মওকুফ করেছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশি সুদ মওকুফ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক ১১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ইসলামী ব্যাংক ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যমুন ব্যাংক ২৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, পূবালী ব্যাংক ৩২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক ১১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ১৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235553