১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৪

অবকাঠামো সংকটে অর্থনীতি

গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও অবকাঠামো উন্নয়নে পিছিয়ে থাকায় সংকটে দেশের অর্থনীতি। এ খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তারপরও যেসব অবকাঠামো গড়ে উঠছে তার বড় অংশই টেকসই হচ্ছে না দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে। দেশের সড়ক-মহাসড়ক, বন্দর, সমুদ্রবন্দর, গভীর সমুদ্রবন্দর, নৌ, রেল, আকাশপথসহ জ্বালানি ও প্রযুক্তি- সব খাতেই চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়নের ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে। দুর্বল অবকাঠামোর কারণে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন না। ফলে অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিও ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বাস্তবতা থেকেই অবকাঠামোর সংকট এবং বিনিয়োগ খরার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সড়ক-নির্ভর। এসবের ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ। এর নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ছে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে। যদিও বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েই তাদের অর্থনীতির ভিত শক্ত করেছে এবং উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে।
এক জরিপে উঠে এসেছে, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ৮৮ ভাগই সড়কপথে পরিচালিত হয়। ৮ ভাগ নদীপথে এবং ৪ ভাগ কর্মকাণ্ড রেলপথে পরিচালিত হয়। বিকল্প সুযোগ কম থাকায় মানুষ ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথই বেশি ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু সড়কপথের অবস্থা খুবই করুণ। খানাখন্দ, দীর্ঘ যানজট ও যত্রতত্র টোল আদায়ে কমছে গাড়ির গতি। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা।
অবকাঠামো সংকটের বাস্তবতা স্বীকার করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি বিনিয়োগবিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, অবকাঠামোর এ ঘাটতি নিয়ে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৩০ সালে বিশ্বের ৩০তম বৃহৎ অর্থনীতির এবং ২০৪১-এর মধ্যে উন্নত দেশে পৌঁছানোর ভিশন বাস্তবায়িত হবে না। সব ক্ষেত্রেই অবকাঠামোর প্রভূত উন্নতি করতে হবে। এ খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমানে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ মাত্র জিডিপির ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেটা বাড়িয়ে জিডিপির ৭ শতাংশে নিতে হবে। সেই অর্থে দেশের উন্নয়নে এখনও বহুপথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সাম্প্রতিক একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনেও দেশের দুর্বল অবকাঠামোর চিত্র উঠে এসেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৬-১৭’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত দেশ তো বটেই, অবকাঠামো উন্নয়নে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত অনেক দেশের চেয়েও অনেক পিছিয়ে। প্রতিবেদন অনুসারে, অবকাঠামো খাতে বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৪তম। অন্যদিকে ‘গ্লোবাল ইনএবলিং ট্রেড রিপোর্ট’ অনুসারে, ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবকাঠামো অবস্থান ১২৩তম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়ছে। কিন্তু অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে কম। সদ্যবিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের জিডিপির আকার ছিল ১৯,৫৬,০৫৬ কোটি টাকা। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হয়েছে এর মাত্র ২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ না আসার পেছনে তারা দেশীয় সম্পদের সীমাবদ্ধতা, বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব কম থাকা এবং বিদেশি বিনিয়োগে ভাটাকেই দায়ী করছেন তারা।
অবশ্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাইলেই অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ এর চেয়ে বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে দাবি করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ জন্য সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে এখন থেকেই বিকল্প ও ফলপ্রসূ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তারা।
উদাহরণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভিয়েতনাম অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে গত ১০ বছর ধরে জিডিপির ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে আসছে। একইভাবে ভারত জিডিপির ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং চীন ৯ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া ১৯৭০-৯০ সাল পর্যন্ত অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিবছর তাইওয়ানের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সেই বিবেচনায় একেবারেই বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি ব্যয়ের হার সর্বনিন্ম। এর কারণ বাজেটে সরকারি ব্যয়ের ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা এবং কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি না হওয়া। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে অবকাঠামো খাতে। আবার এটিও ঠিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয় চাইলেই এর চেয়ে বাড়ানো সম্ভব হবে না। তাহলে সেটারও নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে জনজীবনে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এর জন্য যতটা সম্ভব সহনীয় রেখে কর জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণ এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে তার ফলপ্রসূ প্রয়োগের পরামর্শ দেন। মির্জ্জা আজিজুল বলেন, এর ফলে সরকারি ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়বে এবং অবকাঠামো উন্নয়নেও বেশি অর্থ ছাড়ের সুযোগ তৈরি হবে। তবে এ ক্ষেত্রে যে কাজই হবে তার গুণগতমান শতভাগ বজায় রাখতে হবে। যাতে নির্মিত অবকাঠামো টেকসই হয়। এ ছাড়া বেসরকারি খাতকেও অবকাঠামো খাতের বিনিয়োগে আনার তাগিদ দেন তিনি।
অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে চলতি বছর বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাসে বলেছে, বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে অবকাঠামো খাতে ২০২০ সালের মধ্যে ৭৪-১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। অপরদিকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশকে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৩০ সালে বিশ্বের ৩০তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে হলে অবকাঠামো খাতে প্রতিবছর জিডিপির ৫ শতাংশ হারে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর ২০৩০ সালের মধ্যে বিনিয়োগ প্রয়োজন ৩২০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবসায়ী নেতা একেএম আফতাব-উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। মহাসড়কগুলোয় যানবাহন চলাচল অবাধ করতে হবে। রেল ও নৌপথে যোগাযোগ উন্নয়ন ও সহজতর করতে না পারলে শুধু সড়ক-নির্ভরতা নিয়ে বেশিদূর এগোনো যাবে না। বন্দর, সমুদ্রবন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। একাধিক গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নেও যেতে হবে। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ করা গেলে দেশের অবকাঠামো একটা ভিত্তি পাবে। ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল উন্নয়নে এমআরটি এবং বিআরটি প্রকল্পগুলোও দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া দেশে পদ্মা সেতুসহ বড় আকারের অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্পের ব্যয় যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া ব্যবসা সূচকের উন্নতি হবে না। এ খাতে বিনিয়োগ কম হচ্ছে বলেই বিশ্বে দুর্বল অবকাঠামোর দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’-এ ১৮৯টি দেশের মধ্যে সক্ষমতা বিবেচনায় ব্যবসা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। অর্থাৎ একদম তলানিতে। একমাত্র বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই এ পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, কয়লা, এলএনজি টার্মিনাল, নতুন গ্যাস কূপ খনন, এলপিজি ব্যবহার বৃদ্ধিতেও বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মো. আতাউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে চলাচলের অন্যতম তিনটি পথ হচ্ছে- সড়ক, নৌ ও রেল। কিন্তু নৌপথে অবকাঠামো সংকটের কারণে এ পথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব একটা হচ্ছে না। আগে সারা দেশে নদীপথ ছিল ২৫ হাজার কিলোমিটারের উপরে। সব কটি পথই সচল ছিল। এখন সেটা ৫ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোরই সারা বছর নাব্য বজায় থাকছে। কিন্তু উজানের নদীগুলো বছরের বেশিরভাগই চলাচল অনুপযোগী থাকছে। অব্যাহতভাবে খনন কার্যক্রম না চলা এবং এ নদীপথ ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি মাস্টার প্ল্যান না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এর থেকে উত্তরণে নদীগুলো সারা বছর খনন অব্যাহত, নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথগুলো পুনরায় সচল করার উদ্যোগ নিতে হবে। এর জন্য যেখানে যে প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করতে হবে। আর সেটি করতে গেলে বড় বিনিয়োগ ছাড়া সম্ভব হবে না।
অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়ন আসতে পারে যেভাবে : বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সম্পদের সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি কৌশলী অনেক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সেসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অবকাঠামোর কাক্সিক্ষত উন্নয়নে সর্বোতভাবে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) উদ্যোগকে আরও জোরালো করতে হবে। ভারতের মতো হাইব্রিড পিপিপি চালু করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। এটা বাড়ানো জরুরি। বৈদেশিক অনুদান নেয়ার চেষ্টাও বাড়াতে হবে। পাইপলাইনে যেগুলো আটকে আছে তা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ওই অর্থ অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করা যেতে পারে। মালয়েশিয়ার মতো বন্ড ছেড়েও অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের মতো জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/07/14/139398/