১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩২

ত্রাণের আশায় বানভাসি লাখো মানুষ

বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোতে গত চব্বিশ ঘণ্টায় উজানের পাহাড়ি ঢল এবং ভারত তিস্তা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেয়ায় যমুনা নদীর পানি আরো ৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি ব্যাপক অবনতি হয়েছে। উত্তরের জেলাগুলো ঘুরে দেখা গেছে এসব এলাকার বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। অনেক এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। বিশুদ্ধপানি, জ্বালানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বেড়েছে পানিবাহিত নানা ধরনের রোগ ব্যাধি। বন্যার পানি স্কুলে প্রবেশ করায় বগুড়ায় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ আছে। এসব এলাকায় মানুষের পাশাপাশি লাখ লাখ গবাদি পশুও খাদ্য সংকটে পড়েছে। পানির নিচে নষ্ট হওয়ার পথে বিভিন্ন ফসল। বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সারিয়াকান্দি ও ধুনট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সারিয়াকান্দি, ধুনট এবং সোনাতলা উপজেলার বিশ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

বগুড়ার বন্যা দুর্গত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভাণ্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে নিম্নাঞ্চলগুলোর লোকালায়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে গৃহ হারার সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘরে পানি প্রবেশের কারণে দুর্গত পরিবারগুলো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয়ের জন্য ছুটছে বন্যার্তরা। এদিকে লোকালয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করার কারণে বিশুদ্ধপানি, খাবার এবং তিব্র জ্বালানি সংকটে পড়েছে বন্যার্তরা।
এদিকে বন্যার্ত মানুষ ত্রাণের আশায় অধীর আগ্রহে বসে আছে। সরকারিভাবে যে পরিমাণ ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা অতি নগণ্য। শুধুমাত্র বগুড়া জেলার তিন উপজেলায় বর্তমানে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২ই জুলাই পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪০ পরিবার পানিবন্দি। এই হিসাব বেসরকারি ভাবে ২৫ হাজার পরিবার ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার পরিবারের মধ্যে ১৩ই জুলাই পর্যন্ত সারিয়াকান্দিতে ২০০ টন চাল, তিন লাখ নগদ টাকা, সোনাতলা উপজেলায় ২০ টন চাল, ৫০ হাজার নগদ টাকা, ধুনটে ২০ টন চাল। এই উপজেলায় নগদ কোনো অর্থ বিতরণ করা হয়নি।
এই ত্রাণ দুর্গত মানুষের তুলনায় অনেক কম। অপর দিকে ত্রাণের চালা, নগদ টাকা এখনো অনেক পরিবারের হাতে পৌঁছেনি।
সারিয়াকান্দি উপজেলার ধলিরকান্দি পুরাতন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া সাহেব আলী (৬২), আসাদ প্রামানিক (৬৪), মনেজা বেগম (৫০), গোলাপী বেগম (৭০) অভিযোগ করেন ত্রাণের কোনো প্যাকেট এখন পর্যন্ত তাদের হাতে পৌঁছেনি। তাদের অনেকেই একবেলা খেয়ে দিন পারি দিচ্ছিে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, বুধবার পর্যন্ত সারিয়াকান্দি উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর ৪ হাজার পরিবারকে সরকারিভাবে প্রায় ১২০ টন চাল, গম বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার চিঁড়া, গুড়, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।
বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর পানি ধারাবাহিক ভাবে বেড়েই চলেছে। এতে বন্যার পানিতে বন্দি হয়ে পড়েছে তিন উপজেলার ১৬ হাজার চল্লিশ পরিবার। দিন দিন পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। তিনি আরো জানান, ইতিমধ্যে এসব বানভাসি মানুষ সারিয়াকান্দি আশ্রয় প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছে ৭৬৫ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩৫৫ পানিবান্দি পরিবার। তাদের মাধ্যে পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সামগ্রী এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হবে।
গাইবান্ধায় ২ শিশুর মৃত্যু
উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বৃহস্পতিবার গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত দু’দিনে বন্যার পানিতে ডুবে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নে বুধবার রাতে স্বপ্না খাতুন এবং বৃহস্পতিবার দুপুরে ফুলছড়ি উপজেলার কাবিলপুরে পিনহা নামে দুটি শিশু মারা যায়। বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দি মানুষরা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি নিয়েও তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট এলাকায় অব্যাহত ভাঙনে এখন বিপন্ন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে, এ পর্যন্ত জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নে ১৯০টি গ্রামে ২ লাখ ১০ হাজার বন্যাকবলিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া নতুন করে ১২ হাজার ৭শ’ বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৪টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে সাড়ে ৩ হাজার লোক আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এদিকে ২৪১ হেক্টর জমির পাট, আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৮১ কিমি. সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় ৪টি উপজেলার ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।
আশ্রায়ণ প্রকল্পে হাটু পানি
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, কঞ্চিবাড়ি, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর ইউনিয়ন গুলোতে বন্যার পানি অপরিবর্তিত থাকায় বানভাসি মানুষরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। এতে করে বসতবাড়ি রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি আশ্রান প্রকল্পতেও বন্যার পানি ঢুকেছে। দেখা দিয়েছে বানভাসি মানুষদের চরম দুর্ভোগ। পানিবন্দি ৩০ হাজার মানুষের মাঝে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি। গত বুধবার উপজেলা প্রশাসন ৫শ বানভাসি পরিবারের মাঝে ২০ টন চাল, শুকনো খাবার ও ওষুধপত্র বিতরণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান নাফিউল ইসলাম জিমি জানান, সরকার যেভাবে বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ দিচ্ছে তার চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বন্যার সাথে তাল মিলিয়ে নদী ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তার গোটা ইউনিয়ন এখন বন্যায় নিমজ্জিত। বন্যা দুর্গত মানুষদের আশ্রায় দেওয়ার মতো কোন উঁচু স্থান না থাকায় তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এখন পর্যন্ত যে পরিমান ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জরুরি ভিত্তিতে বন্যার্তদের মাঝে পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণের আবেদন জানান তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান বলেন- ত্রাণসামগ্রী পৌঁছিলে জরুরি ভিত্তিতে তা বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসএম গোলাম কিবরিয়া জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী প্রেরণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পর্যাপ্ত ত্রাণের জন্য পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে বন্যায় ১৬৬ স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধির কারণে জেলার ১৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ও মাঠে পানি উঠেছে। এ কারণে বিকল্পপন্থায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস চালু রাখা হয়েছে বলে দাবি শিক্ষা অফিসের। বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রাথমিক অফিসার সিদ্দিক মো. ইউসুফ রেজা বলেন, ১৩৯টি বিদ্যালয়ের মাঠে এবং ২৭টির ভবন অভ্যন্তরে পানি উঠেছে। এ কারণে বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ভবনে কষ্ট করে হলেও ক্লাস চালু রাখতে শিক্ষকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ক্ষেত্রভেদে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির বাড়ি ও উঁচু স্থানের অস্থায়ী ভবনেও শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যালয়গুলোতে উপস্থিতির হার কমে গেছে। সিদ্দিক মো. ইউসুফ রেজা আরও বলেন, এসব বিদ্যালয়ের মধ্যে সদর উপজেলার ৫টি বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে কাজিপুর উপজেলার ফুলজোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নদীতে বিলীন হয়েছে। এদিকে, সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, বৃহস্পতিবার সারা দিনে যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পায়নি। বর্তমানে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার উপর নদীতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73968&cat=2/