১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৯

ফের রেন্টাল বিদ্যুৎ

বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থবিরতা

কয়লাকে প্রধান জ্বালানি ধরে প্রণীত হয়েছিল বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান। কথা ছিল, ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে পরিকল্পনার স্থায়ী বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে স্বল্প মেয়াদের তেলভিত্তিক ছোট রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। কারণ, এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কিন্তু সরকারের এ পরিকল্পনা বারবার মাঠেই মারা যাচ্ছে। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে একপ্রকার স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলে তেলভিত্তিক ছোট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকেই ঝুঁকছে সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ব্যয়বহুল এই রেন্টাল ছাড়া সরকারের হাতে আপাতত আর কোনো বিকল্প নেই।


ইতিমধ্যে ১০ জেলায় মোট এক হাজার মেগাওয়াটের ১০টি তেলভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অনুমোদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরও তিন হাজার মেগাওয়াটের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এগুলো সবই তেলভিত্তিক ছোট প্রকল্প এবং ব্যয়বহুল। বেসরকারি এসব কেন্দ্র থেকে সরকারকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে অনেক বেশি দামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে যতদিন রেন্টাল বিদ্যুৎ যোগ

হবে, ততদিন ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। কারণ, বেসরকারি ব্যয়বহুল এই বিদ্যুৎ বেশি দামে পিডিবিকে কিনতে হয়। ফলে গ্রাহক পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। ছোট রেন্টাল বিদ্যুতের বহু প্রকল্প চালু হলেও ব্যয়সাশ্রয়ী বড় বড় প্রকল্প তেমন একটা চালু হয়নি। বিশেষ করে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস এবং কয়লাভিত্তিক স্থায়ী ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না হলে মানসম্মত বিদ্যুৎসেবা পাবে না গ্রাহক। একইসঙ্গে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও কমবে না। ব্যয়বহুল রেন্টাল প্রকল্পের ওপরই ভরসা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম। তাই সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেই ঝুঁকছে। কিন্তু তেলের দাম বেড়ে গেলে দেশের অর্থনীতি চাপ সামলাতে পারবে না।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউস সমকালকে বলেন, বড় প্রকল্পগুলো সময়মতো চালু হচ্ছে না। তাই তেলভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া আপাতত কোনো বিকল্প নেই।

মাস্টারপ্ল্যান ব্যর্থ :২০১০ সালে যখন বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়, তখন বলা হয়েছিল ২০১৭ সালে ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে গ্যাস থেকে, ২৪ শতাংশ আসবে কয়লা থেকে এবং তেল থেকে আসবে ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে গ্যাস থেকে আসছে ৬২ শতাংশ, তেল থেকে আসছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কয়লা থেকে আসছে মাত্র ২ শতাংশ বিদ্যুৎ। অর্থাৎ কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো একপ্রকার স্থবির। নানা কারণে এগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্ধারিত মেয়াদে কোনোটিই চালু হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করতে চায়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদন করার কথা। কিন্তু তিনটি প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন ছাড়া বাকি কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্পগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে সরকার আবারও মাস্টারপ্ল্যানে পরিবর্তন আনছে। এবার এলএনজিকে প্রাধান্য দিয়ে মাস্টারপ্ল্যান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ আমদানি করা এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে কয়লাভিত্তিক সব কেন্দ্র চালু হবে না। তিনি জানান, সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ভবিষ্যতে চালু হতে পারে। এ জন্য সরকার বিকল্প হিসেবে এলএনজির কথা চিন্তা করছে। উল্লেখ্য, কয়লাভিত্তিক ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল সরকার।

এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, তেলের দাম কম বলে সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সাহস করছে। কিন্তু হঠাৎ তেলের বাজার অস্থিতিশীল হলে পুরো দেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়বে। একই কথা খাটে এলএনজির ক্ষেত্রে। এলএনজির দামও বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, সাশ্রয়ী ও স্থায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার বিকল্প এখনও গড়ে ওঠেনি। সরকারকে কয়লার দিকেই বেশি নজর রাখা উচিত।

গ্যাস ও তেলভিত্তিক বড় প্রকল্প :বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট (দক্ষিণ) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চুক্তি সই হয়। ঠিকাদার স্পেনের আইসোলাক্স। ২০১৭ সালের মে মাসের মধ্যে এ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রটির চুক্তি সই হয় ২০১৪ সালের আগস্টে। গত বছরের অক্টোবরে একটি ইউনিট চালুর কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। এভাবে সিরাজগঞ্জ ৪১৪, ভোলা ২২০, সিদ্ধিরগঞ্জ ৩৩৫, গ্যাসভিত্তিক আশুগঞ্জ ৪৫০, ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রগুলো ২০১১-১২ সালের দিকে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে অনেক প্রকল্পের চুক্তিই সই হয়নি, আবার চুক্তি হলেও অর্ধেক কাজ হয়নি। খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ দেওয়া হয়েছে অনভিজ্ঞদের কাছে। ফলে উদ্যোক্তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।

পিছিয়ে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প :সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে মাস্টারপ্ল্যানে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সরকারি, অন্য দেশের সঙ্গে যৌথভাবে ও বেসরকারি খাতে এ ধরনের ২৩টি প্রকল্প রয়েছে। যেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৬২২ মেগাওয়াট। রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ী এই তিনটি ছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পের বলার মতো অগ্রগতি নেই। বাকি সবই একপ্রকার স্থবির। বিদ্যুৎ বিভাগের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পগুলো দেখাশোনা করে এমন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এসব প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত জমি পাওয়াও একটি বড় বাধা। কয়লা পরিবহনের সুবিধা রয়েছে_ এমন পর্যাপ্ত জমি অধিগ্রহণে জটিলতা রয়েছে। পরিবেশের বিষয়টিও চিন্তায় ফেলেছে সরকারকে। বিশেষ করে রামপাল ও বাঁশখালী প্রকল্পবিরোধী আন্দোলন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

জানতে চাইলে এ বিষয়ে ড. ম. তামিম বলেন, অধিকাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমদানি করা কয়লা দিয়ে চালানো হবে। আমদানি করা কয়লা হ্যান্ডল করার মতো অবকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। তাই প্রকল্পগুলো পিছিয়ে পড়ছে। সরকারকে দ্রুত এ অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সরকারি প্রকল্প সাতটি, উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতে আট প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার ৮১৭ মেগাওয়াট। অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের আট প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা ৮ হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট।

আরও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র :বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সরকার চলতি বছর দেশের ১০ জেলায় প্রতিটি ১০০ মেগাওয়াটের ১০টি ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পরিকল্পনা নেয়। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বাগেরহাট, বগুড়া, জামালপুর, ফেনী, মেঘনাঘাট, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও শান্তাহারে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেয়েছে। বাকিগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন। এই প্রকল্পগুলো দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতেও আাগামী দুই বছরের চাহিদা পূরণ নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তাই আরও তিন হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭শ' মেগাওয়াটের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭০০ মেগাওয়াট হবে বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রগুলো বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ আইনের মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে কক্সবাজারে ২০০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ২০০ মেগাওয়াট এবং চাঁদপুর, নওয়াপাড়া ও বাগেরহাটে ১০০ মেগাওয়াটের বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের মিরসরাইতে ৩০০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহের ভালুকাতে ২০০ মেগাওয়াট এবং মাগুরা, যশোর, লালমনিরহাট, নওগাঁর নিয়ামতপুর ও জয়পুরহাটে ১০০ মেগাওয়াটের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। অন্য এলাকার চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বাকি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সরকার চাইছে আগামী বছরের মধ্যে এই কেন্দ্রগুলো উৎপাদন শুরু করবে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় দুই ডজন কোম্পানির ৬০টির মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। এর মধ্যে ইউনাইটেড পাওয়ার মোট এক হাজার ৩৫০ মেগাওয়াটের আটটি প্রকল্পের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। আরেক বড় কোম্পানি সামিট গ্রুপ ৯৫০ মেগাওয়াটের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তাব দাখিল করেছে।

 

http://bangla.samakal.net/2017/07/14/307965