১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৬

উন্নয়ন আর উন্নতির দশ কাহন

উন্নয়নের গল্প-কাহিনী কল্প-কাহিনী হাওয়ায় উড়ছে এন্তার। কেউ কেউ জ্ঞানগর্ব অভিসন্দর্ভ লিখছেন মনের আনন্দে, পাওয়ার আনন্দে। কেউ আবার উন্নতির গল্প শোনাতে গিয়ে খুশিতে লুটোপুটি খায়। কবি নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, ‘টেবিল ভেঙে ফেলে থাপ্পর মেরে।’ উন্নতির গল্প শুনতে কার না ভাল লাগে। পত্রপত্রিকার পৃষ্ঠায় অতি বুদ্ধিমানরা উন্নতির ফর্দ পেশ করেন। সাথে উল্লসিত হয়ে বক্তৃতা বিবৃতি পাঠাতেও ভুল করেন না। সেসব উন্নতির সংবাদ মহাধুমধামে প্রকাশিতও হয়। দেশ সমাজ বাজার মার্কেট শাসন প্রশাসন বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় কবি ছবি কোথায় নাই উন্নতি! উন্নতির জোয়াড়ে দেশ পরিবেশ এখন টইটুম্বুর। শিক্ষা নিয়েও দিক্ষা হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যের। এটিও তো এক ধরনের উন্নতি। অর্থ-কড়ি কামানোর উন্নতি। হয়তো এ কারণেই পথের মোড়ে মোড়ে জ্ঞান বিতরণের উৎসব- পাশাপাশি অর্থ আহরণের উদগ্র বাসনা-কৌশল। ইদানীং পরীক্ষার হলে পৌঁছতে পারলেই পাস। খাতায় আঁকিবুকি কিছু থাক বা না থাক। কোলে এসে লাফিয়ে পরে সোনার হরিণ। যদিও ভর্তি পরীক্ষায় বাপের নাম লিখতে গিয়ে বানান ভুল করে শতে নব্বইজন। তাতে কি, পাস তো, একেবারে সোনায় মোড়া পাস। আর যাই হোক পাসের উন্œতি তো কেউ ঠেকাতে পারছে না। শিক্ষার হার বাড়ছে বানের পানির মতো। জ্ঞানের খাতা শূন্য থাক এতে কিবা যায় আসে।
যাদের নজরে উন্নতি ধরা পড়ছে না তারা আসলে বুরবুক। দৃষ্টিতে গোলমাল আছে তো বটেই। আস্ত ব্যাংক লোপাট করে ফেলছে। হাজার হাজার কোটি অর্থঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে সব হাওয়া করে দিচ্ছে। কৌশল না জানলে কি এমনটা করা সম্ভব? ব্যাংক লোপাটের খবর তো প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজ ওয়ালারা প্রকাশ করছে নাম-ঠিকানা সমেত। রাজভান্ডার লুটতেও দ্বিধা করছে না লুটেরাগোষ্ঠী। এখানেও বুদ্ধির প্রয়োজন। বলতেই হবে এদেশবাসীর বুদ্ধির উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট। তাই উন্নয়নের বন্যায় লুটপাটের কর্মযজ্ঞ বিপদসীমা ও বুদ্ধিসীমা অতিক্রম করে ফেলেছে বেশ আগেই।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরে আবদ্ধ থাকলে চলবে কেন? চোখ কান খোলা রাখতেই হয়। রাখছেও অনেকে। দৃষ্টিশক্তি প্রখর থাকলে চীন-জাপান তাইওয়ান কোরিয়া পাঞ্জাবীর পকেটে নিয়ে হাঁটা যায়। দূর আর দূর থাকে না। চকবাজার জিঞ্জিরা জাপান সব একাকার হয়ে যায়। নানা কিসিমের যন্ত্রপাতি হুবহু তৈরী করে মেডিন চীন বা জাপান লেখা স্টিকার লাগিয়ে দিলেই হলো। সুগন্ধি প্রসাধনী এগুলো তো পান্তাভাত। বুদ্ধি আর কৌশল জানা থাকলে নকল-আসলে তফাত বুঝা দায়। একটু কৌশলী হতে হয়। তেমনটা হয়েছেও অনেকে। এটা তো উন্নতিরই লক্ষণ। যাকে বলে উন্নত কৌশল। এমন উন্নয়নের প্রতি নজর ফেলতেই হয়।
পাঁচ হাজার কোটি টাকার উড়াল পুলে শেষাবধি খরচ গিয়ে ঠেকে পাঁচ লাখ কোটিতে। হয়তো তারও বেশি। কেবল প্রয়োজন কৌশল প্রয়োগের। সময় ক্ষেপণের কৌশল। অর্থকড়ি বিলি-বন্টনের বেলায় বুদ্ধি খরচ করতে পারলেই বিল খালাস। দেশ-জনগণের নাশ না হয় একটু আর একটু হবে তাতে কি! কন্ট্রাক্টরের উন্নতি কে ঠেকায়। আজকাল নজর ঘুরালেই এবংবিধ উন্নতির দৃশ্য। তবে আগে প্রয়োজন মগজের জমিতে উন্নত চাষবাস। মাশাআল্লাহ সেখানেও বাঁধভাঙা জোয়ার। সে জমিতে কুবুদ্ধি না সুবুদ্ধির চারা গজাচ্ছে তার খোঁজ নেবার কি দরকার? উন্নয়ন তো দৃশ্যমান। অবস্থানটা মগবাজারে তাতে কি। অপর প্রান্তের শ্রোতা তো আর দেখছে না, টঙ্গি বা কুমিল্লা একটা বলে দিলেই বা দোষ কি। মোবাইলের কথপোকথন এ রকমই হচ্ছে আজকাল। সত্য কথনের হাল-হকিকতের ধরনটা ইদানীং এমনই। একে বলা যায় প্রযুক্তিগত উন্নতি। এ জাতীয় উন্নতির সিঁড়িতে উঠে গেছে দেশবাসী। পথেঘাটে যানবাহনে মোবাইলের আলাপ-আলোচনায় কান পাতলেই সত্য কথনের (?) কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানানোর প্রযুক্তিতে উন্নতি করেছে ঢেড়। পত্রপত্রিকার খবর বা টিভির সংবাদে দৃষ্টি দিলেই সেই উপলব্ধি করা যায় ব্যাপারটা। দৃশ্যমান হয়। এই এলাকায়ও দেশ-জনতা উন্নতি করেছে অনেক। বলতে গেলে উন্নতি আর উন্নয়নের সয়লাব। সংবাদ পরিবেশনে বিভ্রমের কৌশলটা জানা থাকলেই কেল্লা ফতে। সত্য-মিথ্যা একাকার করে দেয়া যায় মুহূর্তে। এখানেও সাফল্য অনেক। উন্নয়ন আর উন্নতির আর একটি উর্বর এলাকা হলো আনাজপাতি, ফলফলাদি। এর সাথে যুক্ত করা যায় সমগ্র খাবার-দাবার। বোধহয় এই সেক্টরেই উন্নয়নের ছোঁয়া বেশ জুতসইভাবেই লেপটে গেছে। কে না জানে এগুলো হলো পচনশীল সামগ্রী। বৃক্ষ থেকে আহরণের পর পরই দুর্বল হতে থাকে। কোনো কোনোটি দু’একদিন থেকে বড়জোর সাপ্তাখাকেন পরই বেঢপ। পচন লাগা শুরু হয়। আম-জাম বেগুন-টমেটোর আয়ু নিঃশেষ হয়ে যায় প্রায়। এখানেও কৌশল আবিষ্কার। কার্বাইড ফর্মালিন আরো কি কি নাম জেন এসব মাখিয়ে দিলেই হলো। আয়ু আর কমবে না। একেবারে ঝকঝকে তকতকে সাপ্তার পর সাপ্তা। কি চমৎকার বুদ্ধি। একেই বলে উন্নতি। যদিও কবিরাজ-বৈদ্যরা প্রচার করেন বর্ধিত আয়ুর এই ফলফলাদি আর আনাজপাতি পেটে গেলে নাকি রোগবালাই শরীরে স্থায়ী আসন পেতে বসে। বসে বসুক। চিন্তার উন্নতির বিষয়টি তো আর অগ্রাহ্যের জো থাকছে না। মৎস্য বাজারেরও কম উন্নতি ঘটেনি। তাজা মাছের ভাজা খেতে কার না পছন্দ। হোক না সে মাছ ফরমালিনের পানিতে চুবানো। যেখানে নজর পরছে সেখানেই উন্নয়ন আর উন্নয়ন। যদিও বরফ বা ফ্রিজে জমা রেখে মাছের জেল্লা বেশ ক’দিন ধরে রাখা যায়। তবু ফরমালিন এস্তেমাল করাটা যেন ইদানীং একটা ফ্যাশন। বুদ্ধির তেলেছমাতি। যাকে বলে উন্নত চিন্তার কর্মযজ্ঞ।
প্রায় অর্ধশত বছর পার করে এলো দেশ-জনতা, স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন বসবাস। এরই মধ্যে শক্তির উন্নতিও কম বাড়েনি। পেশির সাথে সাথে চোয়ালের সঞ্চালন শক্তিও কিন্তু তীব্রতর হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হররোজ লড়াই যুদ্ধ লেগেই থাকে। মাথা ফাটাফাটি গলা কাটাকাটি আনন্দ উৎসবের মতোই উপভোগ করে বুরবুক দেশবাসী। এ জাতীয় উৎসবগুলোও তো উন্নতিরই সরব বার্তা। পেশির উন্নতি, শক্তির উন্নতি। এ রকমের পেশি সঞ্চালন ইদানীং তামাম দেশব্যাপীই বহমান। শক্ত চোয়ালের উঠানামা কেবল টিভির পর্দাতেই নয়, রাজপথেও দেখছে জনতা। এসব সভা-সমিতিতে উন্নত গলাবাজির সাথে অশ্বত্থনামা ইতিগজ’র মতো সত্য কথনও শুনছে মানুষ। উন্নয়নের বিস্তার ঘটেনি কোথাও। দৃষ্টির সীমায় কেবল উন্নতি আর উন্নতি। একবার পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশ নাকি দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। এটি কম খুশখবরি নয়। সবার শীর্ষে।
ইদানীং আরো একটি উন্নয়নের খবর বিস্তার লাভ করেছে দ্রুত। কান পাতলেই শোনা যায়, দৃষ্টি মেললেই নজরে আসে। যদিও অভিধানে বলা হয়েছে অসামাজিক কর্ম। আসলে এ কর্মটি সমাজেই ঘটে। অধিকাংশ সময়ই এ কর্মের সাথে জড়িত থাকেন সমাজপতিগণ। অর্থবান লোকেরা। তবে অর্থহীনরাও যে এই কর্মে যুক্ত নয় এমন কথা বলা যাবে না। এখন তো ব্যাপকহারেই এর চাষবাস হচ্ছে। বড় হোটেল থেকে ছোট হোটেল, দশতলা থেকে একতলা সব এলাকার দৃশ্যই এক। কি শিক্ষিত কি মূর্খ এই যজ্ঞে এসে সব গলাগলি। প্রায় প্রতিদিনই সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। পত্রপত্রিকা এইসব ‘আনন্দ’ সংবাদের শিরোনাম করেছে ‘ধর্ষণ’। এই ধর্ষণের ব্যাপক কর্ষণ হচ্ছে। বিস্তৃতি পাচ্ছে, বেগবান হচ্ছে। বছর কয়েক আগে তো কোনো এক ছাত্রনেতা ধর্ষণের শততম সংখ্যা উদযাপন করেছিল। পত্রিকায় প্রকাশও পেয়েছিল সে ‘আনন্দ সংবাদ’? দেখা যাচ্ছে উন্নয়ন উন্নতির কোমল হস্ত সমাজ এবং দেশের তালুতে স্পর্শ করেছে আদর সোহাগের সাথে। দেশ সমাজের উন্নতি হয়নি কি করে বলা যাবে?

 

http://www.dailysangram.com/post/291622-