১৪ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৬

গুম-অপহরণ : স্বস্তি এবং অস্বস্তি

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

কথায় বলে ‘সব ভালো তার শেষ ভালো যার’। কিন্তু ফরহাদ মজহারের কপালে শেষ ভালো সইল না। তার অপহরণ এবং অবশেষে উদ্ধার নাগরিকসাধারণকে স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে পত্র-পত্রিকায় যেসব প্রতিবেদন এবং আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ছাপা হয়েছে তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। এই সমাজে এবং এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক করার এবং তিলকে তাল করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। সব সময় এবং সব সরকারের প্রয়োজনে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো অতীতে যেমন দেখা গেছে, আজকেও তা সত্য। সম্ভবত এই সত্য বিবেচনায় দেশের শীর্ষ নাগরিকসমাজের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কবি, রাজনীতি বিশ্লেষক ও নাগরিক অধিকার নেতা ফরহাদ মজহার অপহরণ এবং ঘটনা নিয়ে অপপ্রচারের প্রতিবাদ জানায় ওই নাগরিকসমাজ। তারা সত্য উদঘাটনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সচেষ্ট হয়ে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্বেগ দূর করার আহ্বান জানান। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ৩ জুলাই ভোরে ফরহাদ মজহার অবহৃত হন। সাথে সাথে তার পরিবার, সুহৃদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে উদ্বিগ্ন নাগরিকসমাজ তাকে অনতিবিলম্বে অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায় ফিরিতে আনতে সোচ্চার হয়। র্যাব ও পুলিশের ত্বরিত পদক্ষেপের পর রাতেই তাকে উদ্ধার করায় নাগরিকসমাজে স্বস্তি ফিরে আসে। এরপর সবাই আশা করেছিলেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রকৃত অপহরণকারীদের শনাক্ত করবে, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনবে। তবে উদ্বেগ ও হতাশার বিষয় এই যে, ইস্যুটিকে এখন বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা কারো দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। এ ধরনের প্রচারণা ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে চালানোর সুযোগ করবে যা কিনা প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করবে। গুম-খুন আজকাল বাংলাদেশে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্যবান এই অর্থে যে, এখানে একটি শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি রয়েছে। এই সিভিল সোসাইটি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছে। সম্ভবত তাদের জন্য এ রকম দুঃসময় আর কখনো আসেনি। তারা ‘নাগরিকসমাজ’ ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ এবং অবশেষে ‘উদ্বিগ্ন নাগরিকসমাজ’ গঠনের পরেও উঠে দাঁড়াতে পারেননি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে বা যারাই বিবেকের তাড়নায় কথা বলতে চেয়েছেন তারা সবাই নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন : বিরোধী সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক ঐক্যের উদ্যোক্তা, পরিবেশ আইনবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির তথ্য ফাঁসকারী, রাজনৈতিক নেতার সন্তান এবং অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রÑ আসক-এর হিসাবে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত রহস্যজকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন। তাদের মধ্যে লাশ উদ্ধার হয় ৪৪ জনের। পরে গ্রেফতার দেখানো হয় ৩৬ জনকে এবং পরিবারের কাছে ফিরে আসেন ২৭ জন। বাকি ১৭৭ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।
এসব ঘটনা পরম্পরা এবং পরিসংখ্যান সর্বশেষ ঘটনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এই কারণে যে, সব ঘটনার শুরু, পরবর্তী প্রক্রিয়া এবং পরিণতি প্রায় একই রকমের। একটি সাদা অথবা কালো মাইক্রোবাস ঘরের কাছে অথবা পথের পাশে এসে দাঁড়াবে। জোরপূর্বক তিন-চারজন লোক আপনাকে তুলে নেবে ওই মাইক্রোবাসে। চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যাবে অজ্ঞাত স্থানে। সেই অজ্ঞাত স্থান হতে পারে মৃত্যুর ঠিকানা অথবা বৈধ-অবৈধ কয়েদখানা। দৃশ্যের একটু-আধটু হেরফের হতে পারে। রাস্তা থেকে নয় অথবা আকস্মিকভাবে নয় বরং যমদূত আপনার ঘরে এসে উপস্থিত হবে। পোশাক সাদা কিন্তু উদ্দেশ্য কালো। তারা বলবে আমরা ওমুক বাহিনীর লোক। কখনো কখনো পরিবারের কান্না ও প্রেসারে পরিচয়পত্রও দেখাবে। ভালো ভালো কথা বলবে। যখন খোঁজ নেয়া হবে তখন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা বলবে, ‘তারা কিছুই জানে না’। এ রকম অসংখ্য ঘটনার প্রমাণ আছে যে, ধরে নেয়ার অনেক দিন পরে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ তাকে আদালতে হাজির করেছে। ধরুন গ্রেফতার রংপুর থেকে আর তারা বলবে, ‘একদিন আগে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে’। আর বন্দুকযুদ্ধের গতানুগতিক গল্প তো আছেই। বিষয়টি মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়লে উচ্চ আদালত গ্রেফতার ও আদালতে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্তু কোথাও এসব নির্দেশনা মানা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি।
অপহরণের এসব ঘটনা কারা ঘটায় এ পর্যন্ত একটি ক্ষেত্রেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ঘটনাবলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, তারা সবাই বিরোধী পক্ষের লোক। সবাই সরকার থেকে ভিন্ন মত পোষণ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং নিপীড়নবিরোধী আলোচনা, আন্দোলন এবং আদর্শিক অবস্থান সবাইকে বিবেকতাড়িত করছিল। বাংলাদেশ তথা যেখানেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেখানেই নাগরিক সমাজ প্রতিবাদী হয়েছে। সুতরাং যারা ওইসব অপরাধ ঘটায় তারা প্রতিবাদী মানুষের ওপর ক্ষিপ্ত থাকবেÑ এটাই স্বাভাবিক। কোনো বন্ধু দেশের স্বার্থে তিনি যদি আঘাত করে থাকেন অথবা কোনো পরাশক্তির পরাক্রমকে তিনি যদি চ্যালেঞ্জ করে থাকেন তাহলে তার প্রতি ‘ড্রোন অ্যাটাক’ না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক। এসবই আমাদের অনুমিত সিদ্ধান্ত। সরেজমিন ময়নাতদন্ত করলে যেসব বিষয় আমাদের বিবেচনায় আসে, সেগুলো হলোÑ ১. এসব অপহরণ বা গুম সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং এজেন্সিগুলো হয়তো করে থাকবে। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের আপত্তির কোনো কারণ নেই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মহল সব কিছু অস্বীকার করছে। তাহলে সঙ্গত প্রশ্ন কারা এসব করছে? ২. দেশে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়ামেন বা আফ্রিকান গোষ্ঠীগত সহিংসতার মতো ঘটনা এখানে ঘটেনি। এক গোষ্ঠী কর্তৃক অপর গোষ্ঠীকে নির্মূলের ক্ষমতার লড়াই এখানে এখনো শুরু হয়নি। যদিও দ্বিধাবিভক্তির তত্ত্বগত লড়াই চলছে। আমরা এখনো বাস্তব লড়াই থেকে নিরাপদ আছি। সুতরাং সরকারের প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। যেহেতু বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছে, সেহেতু গণতান্ত্রিক পথ ও পন্থার কথা তারা জোরেশোরে বলছে। ৩. দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত রাজনৈতিক সরকারের প্রতিহিংসাকে পুঁজি করে অপরাধীরা অর্থ আদায় করে। এই সময়ে এসব ঘটনার ঘনঘটা যে ঘটছে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর তার প্রমাণ। সবচেয়ে রহস্যজনক আচরণ পুলিশের। ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর প্রযুক্তির সহায়তাই মোট ছয়বার তার অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। কেন ওই সময়ে পুলিশ তার উদ্ধারে ব্যবস্থা নিলো নাÑ সেটাই বরং বিস্ময়কর। বেলা ৩টার পর যখন সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় কেবল তখনই পুলিশ তৎপর হয়। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে রকম আশঙ্কার কথাই বলেছেন।
এই সীমান্ত অতিক্রমের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশে নানা ধরনের বিদেশী চক্র বিপজ্জনক তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেÑ এ রকম অভিযোগ অনুযোগ খোদ কর্তা ব্যক্তিদের পক্ষ থেকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ‘আইএস আছে, আইএস নাই’ বিতর্কটির সময়ের কথা উল্লেখ করা যায়। এরপর দূরবর্তী শত্রু দেশের সামরিক গোয়েন্দাদের প্রতি নানা ঘটনায় অঙ্গুলিসঙ্কেত হয়েছে অনেকবার। আর কারণে-অকারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে দায়ী করা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে গুজবের হাত-পা নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন গুজব রয়েছে যে, প্রতিবেশীরা সর্বনাশের মূল। সে কারণে দোষারোপের সমীকরণ সহজ হয়ে যায়। সত্য-অসত্য নিয়ে বিতর্ক এখন সমীচীন নয়। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে যেসব ঘটনাবলি নাগরিকসাধারণকে উদ্বিগ্ন করে থাকবে তা হলোÑ ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনাকে অপহরণ নয় বলে প্রমাণ করার প্রয়াস। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা খুলনা, যশোর অবশেষে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছেন। সেখানে তারা এক ভদ্র মহিলার সাথে বিষয়টির সংযোগ সাধনের চেষ্টা করছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কোনো কোনো পত্রপত্রিকা যেকোনো বিষয়কে শারীরিক সম্পর্কের দিকে টেনে নিতে পছন্দ করে। অথচ পরিবারের তরফ থেকে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার গত ১১ জুলাই গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর থেকে পেশাদারি আচরণ আশা করি। আমরা চাই তদন্তটা যথাযথ হোক। তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই আসতে পারে। কিন্তু তা যেন কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে’। উল্লেখ্য, ৮ জুলাই মাদকবিরোধী এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহিদুল হক বলেন, ফরহাদ মজহার সম্ভবত অপহরণের শিকার হননি। এর দ্বিতীয় দিন পরে পুলিশের তরফ থেকে বলা হয় যে, একজন নারীর জন্য টাকা সংগ্রহ করতে ৩ জুলাই ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট নারীকে দিয়ে আদালতে জবানবন্দী দেয়া হয়েছে বলে ওই নারীর অবস্থান নিয়েও বিভ্রান্তি প্রকাশিত হয়েছে।
সাধারণ নাগরিকদের সাথে পুলিশের কোনো বিরোধ নেই। বরং সাম্প্রতিককালে পুলিশ জনগণের বন্ধু হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ার যথেষ্ট বিজ্ঞাপন দিয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের মাথায় সঙ্গগতভাবেই এ প্রশ্নটি আসতে পারে যে, ফরহাদ মজহারের সাথে পুলিশের বিরোধ কোথায়? ফরহাদ মজহারের পক্ষ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে তো কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। বরং ত্বরিত উদ্ধারের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ফরহাদ মজহারের ইমেজ-ইজ্জত নষ্ট হলে কারো কারো উপকার হতে পারে। ফরহাদ মজহার একটি প্রগতিশীল মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাস করেন। সে দর্শন তাকে মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। যারা তার ‘বাড়াবাড়িতে’ অসন্তুষ্ট তারা হয়তো অনেক কিছুই করতে পারে। তাদের স্বার্থে, ‘জনস্বার্থের কোনো বাহিনী’ বা আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা গ্রহণযোগ্য নয়। যারা মানুষের সততা, সংহতি এবং ব্যক্তিত্ব নিয়ে কটাক্ষ করছেন তাদের প্রতি করুণাই করতে হয়। সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যম জগতের যেসব মানুষ রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে কারো চরিত্রহননের চেষ্টা করছেন, তারা আসলে তাদের হীন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সত্য এমন একটি অমোঘ সত্য যে, একদিন না একদিন তা প্রকাশিত হবে। অবশেষে আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি দিয়ে শেষ করি, ÒYou can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time.Ó লেখক : সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
mal55ju@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/235518